ইসলামে আগুন দিয়ে জ্বীন নামক প্রাণী সৃষ্টি!

ইসলামি ঐতিহ্যে জ্বিন এমন এক অতিপ্রাকৃত সত্তা, যাদেরকে মানুষের মতই বুদ্ধিসম্পন্ন কিন্তু দৃষ্টিগোচর নয় বলে ধরা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এরা মানুষের মতই বোধবুদ্ধি সম্পন্ন, ধর্ম পালন করে, নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, বিবাহ করে, সন্তান জন্ম দেয় এবং কিয়ামতের দিন হিসাবের মুখোমুখি হবে। এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি কোরআনের কয়েকটি আয়াত, যার মধ্যে অন্যতম সূরা আর-রহমানের এই অংশ [1]

আর জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন আগুন হতে।
— Taisirul Quran
আর জিনকে সৃষ্টি করেছেন নির্ধূম অগ্নিশিখা হতে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে।
— Rawai Al-bayan
এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন নির্ধূম আগুনের শিখা থেকে [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

উপরের অনুবাদগুলো থেকে স্পষ্ট যে, ক্লাসিক্যাল ও সমকালীন বাংলা তাফসিরকারদের মধ্যে মূল ধারণাটি একই থাকে: জ্বিন হচ্ছে ‘ধোঁয়াবিহীন আগুন’ বা ‘নির্ধূম অগ্নিশিখা’ থেকে সৃষ্ট সত্তা। অর্থাৎ কোরআনের مَارِجٍ مِّن نَّارٍ শব্দযুগলকে তারা সরাসরি এক ধরনের আগুন বা আগুনের শিখা হিসেবেই বুঝছেন, যা দৃশ্যমান ধোঁয়া ছাড়া জ্বলতে পারে। ধর্মীয় সাহিত্যে তাই জ্বিনকে প্রায়ই এমন এক ‘অদৃশ্য অগ্নিময় জীব’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যারা নাকি মানুষের চোখের আড়ালে থেকেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

এখানে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো আগুন আসলে কী? আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে আগুন কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নয়; আগুন হচ্ছে মূলত একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া—বিশেষ করে দাহ্য পদার্থের দ্রুত অক্সিডেশন প্রক্রিয়া, যেখানে তাপ ও আলো নির্গত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এতে আংশিক আয়নিত গ্যাস বা প্লাজমার বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়। অর্থাৎ আগুন নিজে “কাঠ”, “লোহা” বা “পানি”-র মত কোনো স্থায়ী পদার্থ নয়; বরং নির্দিষ্ট শর্তে সংঘটিত একটি অস্থায়ী প্রক্রিয়া, যা জ্বালানি শেষ হলে নিজেও নিভে যায়।

এই বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞার সাথে কোরআনিক বর্ণনাটিকে পাশাপাশি রাখলে একটি মৌলিক টেনশন দেখা যায়। যখন বলা হয়, “জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন আগুন থেকে”, তখন এখানে আগুনকে যেন একটি স্থিতিশীল, গঠনযোগ্য বস্তু হিসেবে ধরা হচ্ছে—যে আগুন দিয়ে “শরীর” বা “মাহিয়্যাত” বানানো যায়। এটি মূলত প্রাচীন গ্রিক ও প্রাক-ইসলামিক আরব চিন্তায় প্রচলিত চার উপাদানের (মাটি-জল-বায়ু-আগুন) বিশ্বদৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে আগুনকে একটি মৌলিক উপাদান (element) হিসেবে ভাবা হতো। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের আলোকে এই ধারণা সম্পূর্ণ অপ্রচলিত ও প্রাক-বৈজ্ঞানিক।

আরেকটি সমস্যা হলো, যদি জিন সত্যিই “ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা” থেকে গঠিত কোনো সত্তা হত, তাহলে তার প্রকৃতি হওয়ার কথা অত্যন্ত অস্থায়ী ও অনির্দিষ্ট। আর ইসলামী বর্ণনায় জিনকে কেবল অস্থায়ী শিখা হিসেবে নয়, বরং মানুষের মতই দীর্ঘস্থায়ী সত্তা হিসেবে ধরা হয়, যারা নাকি শত শত বছর বেঁচে থাকতে পারে, সমাজ সংগঠন করতে পারে, এমনকি মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। এটা পদার্থবিদ্যার দৃষ্টিতে একেবারেই অসংগত কল্পনা।

ধর্মীয় আপোলজেটিক প্রবন্ধগুলোতে প্রায়ই একটি বিকল্প ব্যাখ্যা হাজির করে—কেউ বলে “ধোঁয়াবিহীন আগুন” আসলে কোনো এক ধরনের এনার্জি, কেউ বা বলে এটি প্লাজমা বা “অদৃশ্য রেডিয়েশন”-এর রূপক। কিন্তু সমস্যা হলো, কোরআন যেখানে আগুন শব্দটি ব্যবহার করেছে, সে ভাষা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে “এনার্জি” বা “প্লাজমা” সংক্রান্ত আধুনিক ধারণার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আধুনিক ব্যাখ্যাতে এসব অর্থ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া মূলত টেক্সটকে বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে দেখতে চাওয়ার পরবর্তী কালের প্রচেষ্টা, টেক্সটের স্বাভাবিক অর্থ নয়। এরকম ব্যাখ্যা মূল দাবি—“আগুন দিয়ে অদৃশ্য প্রাণী তৈরি করা যায়”—কে বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে না; বরং দেখায় যে, টেক্সটটি আধুনিক জ্ঞানের সাথে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই তা বাঁচাতে ক্রমাগত নতুন নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করতে হচ্ছে।

সুতরাং, সমালোচনামূলক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে “ধোঁয়াবিহীন আগুন থেকে জিন সৃষ্ট”—এই ধারণাটি মূলত প্রাক-আধুনিক পুরাণভিত্তিক এক ধরনের বিশ্বদৃষ্টিকে প্রতিনিধিত্ব করে। আগুনকে স্বতন্ত্র পদার্থ ধরে তা দিয়ে জীব তৈরি হওয়ার ধারণা আধুনিক রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, এমনকি জীববিজ্ঞানের ন্যূনতম বোঝাপড়ার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একে বাস্তবের বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করলে তা অবধারিতভাবেই প্রাগৈতিহাসিক রূপকথার পর্যায়েই পড়ে; সর্বোচ্চ, এটি সেই সময়কার মানুষের কল্পনা ও জগৎ-বোঝার সীমাবদ্ধতার একটি নৃবৈজ্ঞানিক দলিল হিসেবে পড়া যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়।


তথ্যসূত্রঃ
  1. কোরআন ৫৫ঃ১৫ ↩︎