Table of Contents
ভূমিকা
ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাক হচ্ছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চালাকি করা, ধূর্ততা বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া, এসব আমাদের মত সাধারণ মানুষের সাধারণ কাজ হতে পারে। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক কেন এই ধরণের কাজ করতে যাবেন, তা এক অবাক করার মত বিষয়। যার কাছে সর্বময় ক্ষমতা, যিনি হুকুম দিলে মহাবিশ্ব গ্রহ নক্ষত্র নিমিষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়, তিনি মানুষের কৌশল দেখে পাল্টাপাল্টি কৌশল করছেন, সমানে সমান হয়ে কূটকৌশল করছেন, বিষয়টি আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। যেন দুই পাড়ার দুই মাস্তানের যুদ্ধ, যেখানে দুইজনই একজন আরেকজনকে পরাজিত করতে প্রতারণা করছে! এই প্রবন্ধে আমরা বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করবো।
আল্লাহ কি কূটকৌশলী?
সূরা আল-ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে الماكرين শব্দটি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আল্লাহ সবচেয়ে বড় প্রতারক বা ধূর্ত। আপনারা চাইলে এই শব্দটির অনুবাদ বিভিন্ন ডিকশনারিতে খুঁজে দেখুন, এটির অর্থ হচ্ছে প্রতারক বা ধূর্ততার সাথে যে কৌশল করে বা কুটকৌশলী। কিন্তু এই আয়াতটির বাঙলা অনুবাদে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহকে মোলায়েম করে কৌশলী বলা হয়েছে [1] –
আরবীঃ ومكروا ومكر الله والله خير الماكرين
এবং তারা কৌশল করেছিল এবং আল্লাহ্ও (জবাবে) কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।
— Taisirul Quran
আর তারা (কাফিরেরা) ষড়যন্ত্র করেছিল ও আল্লাহও কৌশল করলেন এবং আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তারা কুটকৌশল করেছে এবং আল্লাহ কৌশল করেছেন। আর আল্লাহ উত্তম কৌশলকারী।
— Rawai Al-bayan
আর তারা কুটকৌশল করেছিল, আল্লাহ্ও কৌশল করেছিলেন; আর আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
And they [i.e., the disbelievers] planned, but Allah planned. And Allah is the best of planners.
— Saheeh International
( কোরআনঃ সূরা আল-ইমরান আয়াত ৫৪ )
এবারে আসুন আরো কয়েকটি আয়াত পড়ি [2] [3] [4] –
স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।
— Taisirul Quran
আর স্মরণ কর, যখন কাফিরেরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে কিংবা নির্বাসিত করবে। তারাও ষড়যন্ত্র করতে থাকুক এবং আল্লাহও (স্বীয় নাবীকে বাঁচানোর) কৌশল করতে থাকেন, আল্লাহ হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ কৌশলী।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যখন কাফিররা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দী করতে অথবা তোমাকে হত্যা করতে কিংবা তোমাকে বের করে দিতে। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম।
— Rawai Al-bayan
আর স্মরণ করুন, যখন কাফেররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্য, বা হত্য করার অথবা নির্বাসিত করার জন্য। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও (তাদের ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে) ষড়যন্ত্র করেন; আর আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
And [remember, O Muḥammad], when those who disbelieved plotted against you to restrain you or kill you or evict you [from Makkah]. But they plan, and Allah plans. And Allah is the best of planners.
— Saheeh International
( কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৩০ )
তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকে নির্ভয় হয়ে গেছে? নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর কৌশল হতে কেউ নির্ভয় হতে পারে না।
— Taisirul Quran
তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে ? সর্বনাশগ্রস্থ সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেহই নি:শঙ্ক হতে পারেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ হয়ে গিয়েছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত কওম ছাড়া আল্লাহর কৌশল থেকে আর কেউ (নিজদেরকে) নিরাপদ মনে করে না।
— Rawai Al-bayan
তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকেও নিরাপদ হয়ে গেছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর কৌশলকে নিরাপদ মনে করে না [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
Then, did they feel secure from the plan of Allah? But no one feels secure from the plan of Allah except the losing people.
— Saheeh International
( কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৯৯ )
দুঃখ কষ্ট মানুষকে স্পর্শ করার পর আমি যখন তাদেরকে অনুগ্রহ আস্বাদন করতে দেই, তখন তারা আমার নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে কুট কৌশলের আশ্রয় নেয়। বল, ‘কৌশল গ্রহণে আল্লাহ হলেন ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন, তোমরা যে সব কূটচাল গ্রহণ কর আমার ফেরেশতাগণ তা লিপিবদ্ধ করে রাখে।’
— Taisirul Quran
আর যখন আমি মানুষকে কোন নি‘আমাতের স্বাদ উপভোগ করাই তাদের উপর কোন বিপদ পতিত হওয়ার পর, তখনই তারা আমার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে দুরভিসন্ধি করতে থাকে। তুমি বলে দাওঃ আল্লাহ অতি দ্রুত কলাকৌশল তৈরী করতে পারেন। নিশ্চয়ই আমার মালাইকা/ফেরেশতাগণ তোমাদের সকল দুরভিসন্ধি লিপিবদ্ধ করছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যখন আমি মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা স্পর্শ করার পর রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, তখন তারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়। বল, ‘আল্লাহ কৌশলকারী হিসেবে অধিক দ্রুত’। নিশ্চয় আমার ফেরেশতারা তোমাদের কুট-কৌশল লিখে রাখে।
— Rawai Al-bayan
আর দুঃখ দৈন্য তাদেরকে স্পর্শ করার পর যখন আমরা মানুষকে অনুগ্রহের আস্বাদন করাই তারা তখনই আমাদের আয়াতসমূহের বিরুদ্ধে অপকৌশল করে [১]। বলুন, ‘আল্লাহ্ কৌশল অবলম্বনে আরো বেশি দ্রুততর [২]।‘ নিশ্চয় তোমরা যে অপকৌশল কর তা আমাদের ফিরিশতারা লিখে রাখে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
And when We give the people a taste of mercy after adversity has touched them, at once they conspire against Our verses. Say, “Allah is swifter in strategy.” Indeed, Our messengers [i.e., angels] record that which you conspire.
— Saheeh International
( কোরআনঃ সূরা ইউনুস আয়াত ২১ )
তাফসীর গ্রন্থ থেকে আয়াতের ব্যাখ্যা
এবারে আসুন তাফসীর গ্রন্থ থেকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা পড়ে নেয়া যাক, [5]


শব্দানুবাদের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
এখানে একটি গভীর সমস্যা অনুবাদকেন্দ্রিক। ‘মকর’ শব্দটি আরবিতে সাধারণত ‘ধোঁকা’, ‘চাতুরি’ বা ‘ষড়যন্ত্র’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেমনটি Ibn Manzur-এর Lisan al-Arab-এও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “المَكْرُ: الخِدَاعُ” (অর্থ: মকর হচ্ছে প্রতারণা) [6]। কিন্তু আধুনিক বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদে আল্লাহর এই বৈশিষ্ট্যকে অনেক সময় ‘পরিকল্পনাকারী’ বা ‘চতুর’ বলে লঘু করে উপস্থাপন করা হয়, যেন তা ইতিবাচক কিছু। বাস্তবে এটি ঈশ্বরের ভাবমূর্তি রক্ষায় একধরনের ভাষাগত কৌশল, যাকে “ঈশ্বরতাত্ত্বিক রিডাকশনিজম” বলা চলে [7]। অথচ বহু তাফসীরকারকই স্বীকার করেছেন যে, এই আয়াতগুলো মূলত কাফেরদের বিরুদ্ধে কৌশলের প্রেক্ষাপটে এসেছে, এবং এই আয়াতে আল্লাহর একরকম ‘ধোঁকাবাজ’ বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পায়, যেহেতু একই শব্দ দ্বারাই আল্লাহর ঐ গুণটির কথাও বলা হয়েছে।
কৌশল, প্রতারণা ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব
কোরআনে আল্লাহকে নৈতিকতার চূড়ান্ত আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার প্রতিটি কাজ বা নির্দেশ ন্যায়ের মাপকাঠি। কিন্তু সেই একই কোরআনে “وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ” (“তারা কৌশল করেছিল, আর আল্লাহও কৌশল করেছিলেন, আর আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী”) [8] এবং “وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ” [9]–এর মতো আয়াতে ঈশ্বর নিজেই কৌশলী বা ষড়যন্ত্রকারী রূপে চিত্রিত হচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্বের সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ সত্তা কেন মানুষের মতো কৌশল অবলম্বন করবেন? কৌশল বা ‘মকর’ যদি ‘চতুর পরিকল্পনা’ হয়, তবে ঈশ্বরের কাছে এ ধরনের মানবীয় কৌশল গ্রহণ কি আল্লাহর মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক নয়? এই দ্বান্দ্বিকতা কেবল ভাষাগত নয়, এটি ঈশ্বরের নৈতিক অবস্থান নিয়েও গভীর প্রশ্ন তোলে। মানুষ সাধারণত নানা ধরণের কৌশলের আশ্রয় নেয় তার সীমাবদ্ধতার কারণে। উদাহরণ স্বরূপ, আমি একজন বলশালী মানুষের সাথে মল্লযুদ্ধে পারছি না। আমার এই শারীরিক অক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতা আমাকে নানা ধরণের কূটকৌশলের সাহায্য বাধ্য করবে। আমি হয়তো তার এমন জায়গাতে আঘাত করতে চাইবো, যেখানে আঘাত করলে সে দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু আমার এই অক্ষমতা বা শারীরিক সীমাবদ্ধতা না থাকলে আমার কৌশল করার প্রয়োজনীয়তাই দেখা দিতো না। আমি স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে লড়াই করতাম।
কিন্তু আল্লাহর দাবী অনুসারেই, তার তো সেইসব সীমাবদ্ধতা নেই। তাহলে তিনি কেন কূটকৌশল করবেন? একইসাথে, আল্লাহ যদি “সর্বোত্তম ষড়যন্ত্রকারী” হন, তবে প্রতারণার মতো মানবিক অপরাধ কীভাবে তার সৃষ্টিতে দোষনীয় হয়?
তথ্যসূত্রঃ
- সূরা আল-ইমরান, আয়াত ৫৪ ↩︎
- সূরা আনফাল, আয়াত ৩০ ↩︎
- সূরা আনফাল, আয়াত ৯৯ ↩︎
- সূরা ইউনুস, আয়াত ২১ ↩︎
- তাফসীরে মাযহারী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২০৬, ২০৭ ↩︎
- Lisan al-Arab, root: م ك ر ↩︎
- Frank Griffel, Al-Ghazali’s Philosophical Theology, 2009 ↩︎
- সূরা আলে ইমরান ৩:৫৪ ↩︎
- সূরা আনফাল ৮:৩০ ↩︎