নারীই সমস্ত দুর্দশার কারণ

নারীকে অপরাধী সাব্যস্তকরণঃ ডিহিউম্যানাইজেশনের প্রথম ধাপ

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ওপর চরম নির্যাতন বা অধিকার হরণের আগে শাসক বা শক্তিশালী অংশটি যে কাজটি প্রথম করে থাকে, সেটি হচ্ছে সেই গোষ্ঠীকে জনসমক্ষে অপরাধী বা সকল সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা। এটিই নিপীড়নের জন্য পথ প্রস্তুত করার সবচেয়ে কার্যকর এবং চিরায়ত কৌশল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ইহুদিদেরকে জার্মান সমাজের সকল দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী করে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসী, বিশেষ করে মুসলিম ও মেক্সিকানদের, আমেরিকার সব সমস্যার জন্য দোষারোপ করেছিলেন। এই কৌশল তাই শুধুমাত্র অতীতের বিষয় নয়; বর্তমান সময়েও এটি চলে আসছে—নিপীড়িতকে অপরাধী বানিয়ে তার বিরুদ্ধে সহিংসতা বৈধ করার একটি কৌশল।

একই কৌশল লক্ষ করা যায় ধর্মীয় বর্ণনায়। বিশেষ করে আব্রাহামিক ধর্মগুলো—ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম—নারীর প্রতি ব্যবহৃত হয়েছে এই একই অপবাদ নির্মাণের অস্ত্র। এদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে নারীকেই মানবজাতির সকল দুর্দশা ও অধঃপতনের মূল হোতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। আদম-হাওয়ার কাহিনী তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সেখানে আদমের নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পেছনে হাওয়াকে দায়ী করা হয়—যে কিনা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আদমকে প্ররোচিত করেছিল। অথচ গল্পের কাহিনীকাঠামোতে পুরুষ এবং নারী দু’জনই সমভাবে উপস্থিত থাকার পরও অপরাধের দায় নারীর ওপর সুনির্দিষ্টভাবে চাপানো হয়।


আদম হাওয়ার গপ্পো

আব্রাহামিক ধর্মের নৈতিক কাঠামোর গভীরে একটি কেচ্ছা খুব কৌশলেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই কারনেই নারী হয়ে ওঠে ‘প্রথম পাপের কারণ’, ‘প্রথম অপরাধী’। এর ফলে নারীর শরীর, তার আকাঙ্ক্ষা, তার স্বাধীনতা—সবই প্রশ্নবিদ্ধ ও অপরাধের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে ডিহিউম্যানাইজেশনের (মানবিকতা হরণ) এক সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার ভিত্তিতে নারীকে পুরুষের অধীনস্থ রাখা, নিয়ন্ত্রণ করা, তার ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনকে ধর্মীয় বৈধতা প্রদান করা হয়।

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন প্রপাগান্ডা নয়। এটি পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত। পুরুষতান্ত্রিক ধর্মব্যবস্থায় যখন নারীকে ‘সমস্যার মূল কারণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তখন নারী নিপীড়নের বিপরীতে জনমতের প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ তখন সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, ‘নারীর কারণে আমাদের সকল সমস্যা’, ‘নারীই শয়তানের মাধ্যম’। ঠিক যেভাবে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছিল: ‘তাদের কারণেই আমাদের সমস্যাগুলো হচ্ছে।’

নবী মুহাম্মদও এই চিরাচরিত কৌশল থেকে আলাদা ছিলেন না। ইসলামিক হাদিস ও ইতিহাসের বিবরণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি বারবার নারীকে পৃথিবীর দুঃখ-কষ্টের মূল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বিভিন্ন হাদিসে নারীকে ‘অবাধ্য প্রাণী’, ‘দোজখের অধিকাংশ অধিবাসী’ এবং পুরুষের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার বস্তু’ বলা হয়েছে। হাওয়ার অপরাধের কথা বলে বর্তমান নারীকে অপরাধী সাব্যস্ত করার এই ধারণা প্রচারিত হয়। মূলত, অতীতের একজন নারীর কথিত অপরাধের দায় বর্তমান নারীজাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নারী নিপীড়নকে স্বাভাবিক ও বৈধ করার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, প্রাচীন ধর্মীয় কাহিনীগুলোকে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করার ফলে আজকের আধুনিক যুগেও এই প্রপাগান্ডার প্রভাব থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারেনি। নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বারবার ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে দমন করার চেষ্টা হয়, আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকে আদিম সেই গল্প—‘হাওয়া নারী বলেই আমাদের দুর্দশা শুরু’। সুতরাং, মানবজাতির ইতিহাসে নারী নিপীড়নের শুরু ও ধারাবাহিকতার পেছনে রয়েছে এক সুপরিকল্পিত দোষারোপের গল্প—যা শুধু গল্প নয়, বরং বৈধতা দানের একটি কৌশল। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও নৃশংসতম প্রপাগান্ডা।


হাদিসের বর্ণনা এবং প্রাসঙ্গিক ভিডিও

ইসলাম ধর্ম অন্য অনেক ধর্মের মতই নারীকেই সমস্ত সমস্যার মূল মনে করে এবং নারীকে দমন করার উদ্দেশ্যেই খুব পরিকল্পিত উপায়ে এই কাজটি করে। আসুন শুরুতেই বাঙলাদেশের প্রখ্যাত মুফতি ইব্রাহিমের বক্তব্য শুনে নিই,


এবারে আসুন প্রাসঙ্গিক হাদিস পড়ি,

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৬০/ আম্বিয়া কিরাম (‘আঃ)
পরিচ্ছদঃ ৬০/১ক. আল্লাহ তা‘আলার বাণী।
৩৩৩০. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে একইভাবে বর্ণিত আছে। অর্থাৎ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈল যদি না হত তবে গোশত দুর্গন্ধময় হতো না। আর যদি হাওয়া (আঃ) না হতেন তাহলে কোন নারীই স্বামীর খিয়ানত করত না।
* (৫১৮৪, ৫১৮৬) (মুসলিম ১৭/১৯ হাঃ ১৪৭০, আহমাদ ৮০৩৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩০৮৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০৯২)
* বনী ইসরাঈল আল্লাহ তা’আলার নিকট থেকে সালওয়া নামক পাখীর গোশত খাওয়ার জন্য অবারিতভাবে পেত। ‎তা সত্ত্বেও তা জমা করে রাখার ফলে গোশত পচনের সূচনা হয়। আর মাতা হাওয়া নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণে আদম ‎‎(‘আঃ)-কে প্রভাবিত করেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)