Table of Contents
ভূমিকা
মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কথিত সর্বাপেক্ষা প্রিয় রাসুল নবী মুহাম্মদ, যিনি ছিলেন সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচাইতে বেশি জ্ঞানী এবং মহাবিশ্বের রহস্য সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক অবগত, আল্লাহ পাক নিজেই যাকে জিবরাইলের মাধ্যমে মহাবিশ্বের অনেক রহস্য জানিয়েছেন, সাত আসমানে যিনি ঘুরে এসেছেন, যার আঙুলের ইশারায় নাকি চাঁদ দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিল, যিনি নাকি সূর্যকেও থামিয়ে দিতে পারতেন, সেই নবী মুহাম্মদই একবার সূর্যগ্রহণ দেখে এমন ভয় পেয়েছিল যে, তার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। আজকালকার বাচ্চা ছেলেপেলেরাও সূর্যগ্রহণ কী তা জানে এবং বোঝে। তারা সূর্যগ্রহণের সময় কোন ভয় পায় না। অথচ নবী এটি দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন কেয়ামত হচ্ছে। কেন, সেই সময়ে জিবরাইল কোথায় ছিল? তার তো এসে বলা উচিত ছিল, হে নবী, এটি একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা, ভয়ের কিছু নেই। এই প্রবন্ধে আমরা সেই বিষয়টিই আলোচনা করবো।
হাদিসের বিবরণ
মুখতাসার সহীহ আল-বুখারী
১৬. কিতাবুল কুসুফ (সূর্যগ্রহণের বর্ণনা)
পরিচ্ছেদঃ সূর্যগ্রহণের সময় যিকির করা
আলোকিত প্রকাশনী নাম্বারঃ ৫৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৫৯
৫৬০: আবু মুসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা সূর্যগ্রহণ হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দন্ডায়মান হলেন। তিনি কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার ভয় করছিলেন। তিনি মসজিদে আগমণ করলেন। তিনি এত লম্বা কিয়াম, রুকূ এবং সিজদা করলেন যা আমি তাঁকে আর কখনও এরূপ করতে দেখিনি। তিনি বললেনঃ এ সমস্ত নিদর্শন কারো জন্ম গ্রহণ বা মৃত্যু বরণ করার কারণে প্রেরিত হয় না; বরং আল্লাহ তাআলা এগুলোর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন। তোমরা যখন কোন নিদর্শন দেখতে পাবে তখন তোমরা আল্লাহর যিকির, তাঁর নিকট দু’আ করা এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার দিকে ধাবিত হও।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ মূসা আল- আশ’আরী (রাঃ)

এবারে আসুন মুসনাদে আহমদ হাদিস গ্রন্থ থেকে একটি হাদিস পড়ে নিই, [3]

এবারে আসুন আমরা জেনে নিই, সূর্যগ্রহণ কী এবং এটি কেন হয়।
সূর্যগ্রহণঃ প্রাকৃতিক সত্য থেকে ধর্মীয় ভ্রান্তি পর্যন্ত
সূর্যগ্রহণ একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা। এটি ঘটে তখন, যখন চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে সূর্যের আলো আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে। ফলে পৃথিবীর নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে সূর্য কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই ঘটনা নির্ভর করে তিনটি জ্যোতিষ্ক — সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবীর — অবস্থান ও সরলরেখায় (alignment) আসার উপর, যাকে বিজ্ঞানীরা “Syzygy” (গ্রিক: σύζυγος — এক সরলরেখায় সংযুক্ত হওয়া) বলে অভিহিত করেন [4]।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
চাঁদ প্রতি ২৯.৫ দিনে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে আসে — যাকে আমরা আমাবস্যা (New Moon) বলি। কিন্তু চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের সঙ্গে প্রায় ৫ ডিগ্রি কোণে হেলানো থাকায় প্রতি মাসে গ্রহণ ঘটে না। সূর্যগ্রহণ কেবল তখনই ঘটে, যখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর সঠিকভাবে পড়ে এবং তিনটি জ্যোতিষ্ক একই সরলরেখায় থাকে [5]।
এই ছায়া দুই প্রকার —
- Umbra: গভীর ছায়া অঞ্চল, যেখানে সূর্য সম্পূর্ণরূপে ঢাকা পড়ে।
- Penumbra: আংশিক ছায়া অঞ্চল, যেখানে সূর্যের কিছু অংশ দৃশ্যমান থাকে।
চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ১,৭০০ কিমি বেগে ছুটে চলে, তাই পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময়সীমা সর্বাধিক ৭ মিনিট ৩২ সেকেন্ড [6]।
সূর্যগ্রহণের ধরন
| ধরন | বৈশিষ্ট্য |
|---|---|
| পূর্ণ সূর্যগ্রহণ (Total Eclipse) | চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে, সূর্যের Corona দৃশ্যমান হয় |
| আংশিক সূর্যগ্রহণ (Partial Eclipse) | সূর্যের একটি অংশ চাঁদে ঢাকা পড়ে |
| বলয়গ্রাস বা Annular Eclipse | চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে থাকায় সূর্যের চারপাশে উজ্জ্বল বলয় দৃশ্যমান হয় |
প্রাচীন কুসংস্কার ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা
ইতিহাসে প্রায় সব সমাজই সূর্যগ্রহণকে একসময় ভয় ও রহস্যের প্রতীক হিসেবে দেখেছে। এই ভয়ের সুযোগ নিয়েই বহু ধর্মীয় কাহিনি ও কুসংস্কার জন্ম নেয়।
চীনা ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা
প্রাচীন চীনে বিশ্বাস করা হতো, একটি “স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গিলে ফেলে” গ্রহণ ঘটায়। তাই তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ড্রাগনকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করত [7]। ব্যাবিলনীয় পুরোহিতরা গ্রহণকে রাজাদের জন্য অশুভ লক্ষণ মনে করে বিশেষ উৎসর্গের আয়োজন করতেন [8]।
ভারতীয় পৌরাণিক ব্যাখ্যা
ভারতীয় পুরাণে বলা হয়, ‘রাহু’ নামের অসুর দেবতাদের প্রতারণা করেছিল, ফলে বিষ্ণু তার মাথা কেটে দেন। কিন্তু তার কাটা মাথা সূর্য ও চাঁদকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে, ফলে গ্রহণ ঘটে [9]। এই ধারণা আজও দক্ষিণ এশিয়ার বহু অঞ্চলে লোকবিশ্বাস হিসেবে টিকে আছে।
সূর্যগ্রহণ ও ধর্মপ্রচার
ধর্মীয় নেতারা ও উপনিবেশবাদী মিশনারিরা সূর্যগ্রহণের ভয়কে ব্যবহার করে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে — এর ঐতিহাসিক উদাহরণ বহু।
কলম্বাসের “গ্রহণ-বাটপারি” (1504)
ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন জ্যামাইকায় আটকে পড়েন, স্থানীয় আদিবাসীরা তাকে খাদ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কলম্বাস জানতেন যে ১৫০৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে, যা তিনি ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্যালেন্ডার থেকে জানতেন। তিনি স্থানীয়দের হুমকি দেন যে “তাদের দেবতা রুষ্ট হয়ে চাঁদকে গিলে ফেলবেন।” যখন গ্রহণ সত্যিই ঘটে, আদিবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে কলম্বাসকে “দেবতার দূত” মনে করে খাদ্য ও সহযোগিতা দেয় [10]। এই ঘটনাকে ইতিহাসবিদরা বলেন “Eclipse Diplomacy” — যেখানে বিজ্ঞান ও অজ্ঞতা মিলিয়ে ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
মিশনারি কৌশল ও আদিবাসী সংস্কৃতি
আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রাথমিক মিশনারিরাও স্থানীয় জনগণের অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রহণের সময় “তাদের ঈশ্বরের ক্ষমতা” প্রদর্শনের নাটক করতেন [11]। তারা বলতেন, “যে ঈশ্বর সূর্যকে ঢাকতে পারেন, সেই ঈশ্বরই তোমাদের রক্ষা করবেন।” এইভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানকে ধর্মীয় অলৌকিকতায় রূপান্তরিত করা হতো।
বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও সূর্যগ্রহণ গবেষণা
বিজ্ঞান যখন ধর্মীয় ভয় থেকে মুক্তি পেল, সূর্যগ্রহণ তখন এক গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দিল।
১৮৬৮ সালে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিয়ের জানসেন ও ইংরেজ বিজ্ঞানী নরম্যান লকার সূর্যের বায়ুমণ্ডলে হিলিয়াম (Helium) গ্যাস আবিষ্কার করেন — পৃথিবীতে এই উপাদান তখনও শনাক্ত হয়নি [12]।
১৯১৯ সালের পূর্ণ সূর্যগ্রহণে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন সূর্যের চারপাশে তারকার আলো বাঁকানোর প্রভাব মেপে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (General Relativity) প্রমাণ করেন [13]। এটি ছিল মানব ইতিহাসে বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরীক্ষামূলক সাফল্য।
আধুনিক যুগে সূর্যগ্রহণ
আজ সূর্যগ্রহণ কেবল পর্যবেক্ষণের সৌন্দর্য নয়, বরং শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসারের অনন্য মাধ্যম।
NASA ও ESA প্রতি বছর গ্রহণের নির্ভুল সময় ও পথনির্দেশিকা প্রকাশ করে এবং বিশ্বব্যাপী লাইভ সম্প্রচার করে [14]। বিশেষ ফিল্টারযুক্ত সোলার গ্লাস ব্যবহার করে হাজারো মানুষ একসাথে এই মহাজাগতিক দৃশ্য উপভোগ করে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও যুক্তিনির্ভর চিন্তার বিকাশ ঘটে।
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর; তাই কখনোই খালি চোখে গ্রহণ দেখা উচিত নয়। সঠিক পদ্ধতি হলো সোলার ফিল্টার, পিনহোল প্রজেকশন, অথবা টেলিস্কোপে সোলার ফিল্টার সংযুক্ত করে পর্যবেক্ষণ করা।
উপসংহার
সূর্যগ্রহণ একসময় দেবতার রোষ, অশুভ লক্ষণ বা ধর্মীয় ‘মিরাকল’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে — এটি নিছকই মহাকাশের এক নিয়মতান্ত্রিক, পূর্বাভাসযোগ্য প্রাকৃতিক ঘটনা। যেখানে একসময় পুরোহিত বা মিশনারিরা ভয়ের মাধ্যমে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, আজ সেখানে বিজ্ঞানের যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ মানুষকে মুক্ত করেছে অন্ধবিশ্বাস থেকে।
সূর্যগ্রহণ আমাদের শেখায় — প্রকৃতি রহস্য নয়, কিছু প্রাকৃতিক নিয়মের সমষ্টি। অন্ধবিশ্বাসের স্থলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বের হয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখা এবং যুক্তি দিয়ে যাচাই করাই আমাদের প্রগতির পথ। নবী মুহাম্মদের আমলে এটি যেরকম কেয়ামতের আতঙ্ক বা মারাত্মক ভয়ের বিষয় ছিল, আজকের দিনে সেটি কোন ভয়ের বা আতঙ্কের বিষয় নয়। এভাবেই জ্ঞান অর্জন এবং যুক্তিপ্রমাণের ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভয়কে জয় করতে পারি।
[ai_review]
তথ্যসূত্রঃ
- মুখতাসার সহীহ আল-বুখারী, হাদিসঃ ৫৬০ ↩︎
- মুখতাসার সহীহ আল-বুখারী, ইসলামী দাওয়া সেন্টার উম্মুল হামাম রিয়াদ সৌদি আরব, পৃষ্ঠা ২৩১ ↩︎
- মুসনাদে আহমদ, ২য় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৬৫ ↩︎
- NASA Eclipse Science, 2024 ↩︎
- Royal Astronomical Society, 2020 ↩︎
- NASA Goddard Space Flight Center, 2022 ↩︎
- Needham, Science and Civilisation in China, 1959 ↩︎
- Stephenson, Historical Eclipses and Earth’s Rotation, 1997 ↩︎
- Vishnu Purana, 2.12–13 ↩︎
- Columbus, Journal of the Fourth Voyage, 1504; NASA Historical Eclipses, 2018 ↩︎
- Comaroff & Comaroff, Of Revelation and Revolution, 1991 ↩︎
- Lockyer, Proceedings of the Royal Society, 1868 ↩︎
- Dyson et al., Philosophical Transactions of the Royal Society A, 1920 ↩︎
- NASA Eclipse Portal, 2025 ↩︎
