Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 স্পিনোজার ঈশ্বরঃ ব্যক্তিগত ঈশ্বর নন
- 3 স্পিনোজার প্রস্তাবিত ঈশ্বরের ধারণা
- 4 ঈশ্বর ও জগত অভিন্নঃ স্পিনোজার ব্যাখ্যা
- 5 স্পিনোজাঃ ধর্মবাদীদের চোখে ছিলেন “নিকৃষ্ট শয়তান”
- 6 মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ও ঈশ্বরের সমালোচনা
- 7 প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা থেকে স্পিনোজার ঈশ্বরের পার্থক্য
- 8 নৈতিকতা ও ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পিনোজার ধারণা
- 9 আইনস্টাইনের স্পিনোজার ঈশ্বরে আস্থা
- 10 প্রচলিত ঈশ্বর বনাম স্পিনোজার ঈশ্বর
- 11 উপসংহার
ভূমিকা
বারুখ স্পিনোজা (Baruch Spinoza) ছিলেন ১৭শ শতকের একজন ডাচ-ইহুদি দার্শনিক, যিনি পাশ্চাত্য দার্শনিক চিন্তায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আনেন। তার সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত ধারণাগুলোর মধ্যে একটি হল তার “ঈশ্বর” বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি। তার মতে, ঈশ্বর ও প্রকৃতি (God or Nature) একই জিনিস — অর্থাৎ ঈশ্বর মানেই প্রকৃতি, এবং প্রকৃতি মানেই ঈশ্বর। এই ধারণাকে বলা হয় “Pandeism” বা “Pantheism” [1]।

তিনি তার যুগান্তকারী কাজ “নীতিশাস্ত্র” (“Ethics”)-এর জন্য সুপরিচিত, যেখানে তিনি অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান এবং নৈতিকতা সম্পর্কিত তার বিস্তৃত এবং সুসংগত দার্শনিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করেছেন [2]। স্পিনোজার চিন্তাভাবনা তার সমসাময়িক ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল, যার ফলে তিনি বহু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন [3]। যৌবনে রাব্বিনিক (রাবাইদের) পুরোহিততন্ত্র বা মোল্লাতন্ত্রকে কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা এবং ইহুদি মতবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে ১৬৫৬ সালে তাকে আমস্টারডামের ইহুদি সম্প্রদায় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয় [4] [5]। স্পিনোজা ঐতিহ্যবাহী জুডিও-খ্রিস্টান বিশ্বদৃষ্টির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মহাবিশ্বের একটি নতুন চিত্র তুলে ধরেন [6]। তার ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং নৈতিকতা সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রায়শই এই ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় মতবাদ থেকে ভিন্ন ছিল; এতটাই ভিন্ন ছিল যে, সেই ঈশ্বরকে পরবর্তী সময়ে স্পিনোজার ঈশ্বর বলে অভিহিত করা হতে থাকে [7]। স্পিনোজার প্রস্তাবিত দার্শনিক মতকে তার সমসাময়িকরা নীতিহীন এবং নাস্তিক্যবাদী মতবাদ হিসেবে নিন্দা করেছিলেন [8] ।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা, তার দর্শনের মূলনীতিগুলি বিশ্লেষণ করা, সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করা এবং আইনস্টাইন কেন তার ঈশ্বরে আস্থা রাখতেন তা খতিয়ে দেখা। আইনস্টাইনের বক্তব্যকে অনেক স্থানেই ভুলভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাকে এমনকি ইসলামের আল্লাহতে বিশ্বাসী বলেও প্রচার প্রচারণা চালানো হয়, যেখানে আইনস্টাইন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেছিলেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা এবং এর তাৎপর্য সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। আসুন শুরুতেই একটি বক্তব্য শুনে নেয়া যাক,
স্পিনোজার ঈশ্বরঃ ব্যক্তিগত ঈশ্বর নন
স্পিনোজা তার প্রধান কাজ “নীতিশাস্ত্র”-এ ঈশ্বরের একটি সুসংহত এবং দার্শনিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এই গ্রন্থের প্রথম অংশে তিনি ঈশ্বরকে একটি “পরম অসীম সত্তা” (ens absolute infinitum) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যা অসীম সংখ্যক গুণাবলী (attributes) নিয়ে গঠিত [9]। তিনি লিখেছেন,
By God, I understand a being absolutely infinite — that is, a substance consisting of infinite attributes, each of which expresses eternal and infinite essence.
ঈশ্বর বলতে আমি পরম অসীম সত্তা বুঝি, অর্থাৎ, অসীম সংখ্যক গুণাবলী সম্পন্ন একটি সত্তা, যার প্রতিটি গুণ একটি শাশ্বত এবং অসীম নির্যাস প্রকাশ করে [10] [11]।
এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, ঈশ্বরকে তিনি একটি অনন্ত সত্তা হিসেবে দেখেছেন, যিনি সবকিছুতে আছেন এবং যার বাইরে কিছুই নেই। এই ধারণা বহু প্রচলিত ধর্মীয় ধারণা এবং প্রায় সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারনার বিপরীত।
স্পিনোজার দর্শনে “সত্তা” (substance), “গুণাবলী” (attributes) এবং “প্রকার” (modes) এই তিনটি ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিনোজা মনে করেন যা কিছু বিদ্যমান তা হয় সত্তা, না হয় প্রকার [12]। সত্তা হলো যা নিজের মধ্যে বিদ্যমান এবং নিজের মাধ্যমেই বোধগম্য; এর অস্তিত্ব বা ধারণার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না [13]। গুণাবলী হলো সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যা যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় এবং যা সত্তার সারমর্ম গঠন করে [14]। যদিও সত্তার অসীম সংখ্যক গুণাবলী রয়েছে, মানুষ কেবল দুটি গুণাবলী সম্পর্কে অবগত: চিন্তা (thought) এবং বিস্তার (extension), যা ভৌত জগৎ-এর সাথে সম্পর্কিত [15]। প্রকার হলো সত্তার ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন বা অভিব্যক্তি, যা অস্তিত্বের জন্য সত্তার উপর নির্ভরশীল [16]। এই তিনটি ধারণা স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে ঈশ্বর হলেন একমাত্র অসীম সত্তা, যার অসীম গুণাবলী রয়েছে এবং জগৎ সেই সত্তারই বিভিন্ন প্রকার বা অভিব্যক্তি [17]।
ধারণা | সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য |
সত্তা [18] | যা নিজের মধ্যে বিদ্যমান এবং নিজের মাধ্যমেই বোধগম্য; এর অস্তিত্ব বা ধারণার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না [19]। |
গুণাবলী [20] | সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যা যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় এবং যা সত্তার সারমর্ম গঠন করে [21]। যদিও সত্তার অসীম সংখ্যক গুণাবলী রয়েছে, মানুষ কেবল দুটি গুণাবলী সম্পর্কে অবগত: চিন্তা (thought) এবং বিস্তার (extension), যা ভৌত জগৎ-এর সাথে সম্পর্কিত [22]। |
প্রকার [23] | সত্তার ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন বা অভিব্যক্তি, যা অস্তিত্বের জন্য সত্তার উপর নির্ভরশীল [24]। এই তিনটি ধারণা স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে ঈশ্বর হলেন একমাত্র অসীম সত্তা, যার অসীম গুণাবলী রয়েছে এবং জগৎ সেই সত্তারই বিভিন্ন প্রকার বা অভিব্যক্তি [25]। |
স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা বিস্তারিতভাবে জানার জন্য “নীতিশাস্ত্র” একটি নির্ভরযোগ্য দার্শনিক উৎস। এই গ্রন্থের প্রথম অংশে (বিশেষ করে প্রস্তাবনা ১-১৫) ঈশ্বরের মৌলিক ধারণাগুলি উপস্থাপন করা হয়েছে [26]। এখানে স্পিনোজা স্ব-কারণ (self-caused) সত্তা হিসেবে ঈশ্বরের প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এবং অনন্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন [27]।

স্পিনোজার প্রস্তাবিত ঈশ্বরের ধারণা
সর্বেশ্বরবাদ ও অদ্বৈতবাদঃ ঈশ্বরের ধারণার ভিত্তি
স্পিনোজার দর্শন মূলত সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) এবং অদ্বৈতবাদ (Monism)-এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি “ঈশ্বর অথবা প্রকৃতি” (Deus sive Natura) এই বিখ্যাত সূত্রের মাধ্যমে ঈশ্বর এবং প্রকৃতির অভিন্নতা স্থাপন করেন [28]। এর অর্থ হলো ঈশ্বর জগৎ থেকে পৃথক কোনো সত্তা নন, বরং জগৎ এবং প্রকৃতি স্বয়ং ঈশ্বর [29]। স্পিনোজা মনে করেন কেবল একটি মাত্র সত্তা বিদ্যমান, যা ঈশ্বর বা প্রকৃতি নামে পরিচিত, এবং সবকিছু সেই সত্তারই অংশ [30]। তার মতে, একাধিক স্ব-কারণ সত্তা থাকতে পারে না, কারণ যদি থাকত তবে দুটি অসঙ্গতিপূর্ণ সত্তা প্রাকৃতিক নিয়মের শর্তাবলীকে সহজতর করত না [31]। তাই, স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদের ভিত্তি হলো ‘সত্তা’-র প্রয়োজনীয় অস্তিত্বের ধারণা [32]। তিনি মনে করেন সত্তা কেবল একটাই হতে পারে (অদ্বৈতবাদ), এবং এই একটি সত্তা কেবল ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যা প্রকৃতির অন্য নাম [33]।
“Deus sive Natura” ধারণাটি স্পিনোজার দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু [34]। এই ধারণার তাৎপর্য হলো এটি ঈশ্বরকে জগৎ থেকে আলাদা কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা হিসেবে না দেখে জগতের অন্তর্নিহিত এবং অপরিহার্য অংশ হিসেবে বুঝতে সাহায্য করে [35]। স্পিনোজার ঈশ্বর জগৎকে সৃষ্টি করেননি, বরং তিনিই জগৎ [36]। এই ধারণা প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা থেকে বহুলাংশে ভিন্ন, যেখানে ঈশ্বরকে জগৎের একজন স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দার্শনিক উৎস যেমন স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি এবং ইন্টারনেট এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফিতে স্পিনোজার এই ধারণা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ঈশ্বর ও প্রকৃতির অভিন্নতাঃ ‘Deus sive Natura’
স্পিনোজা ঈশ্বর এবং প্রকৃতিকে অভিন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যা ‘Deus sive Natura’ (ঈশ্বর তথা প্রকৃতি) নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবিত ঈশ্বরের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বজগৎ এবং এর সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের প্রকাশ বা অংশ; ঈশ্বর এবং প্রকৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি মনে করেন, ঈশ্বর কোনো ব্যক্তিগত সত্তা নন, বরং সমগ্র অস্তিত্বের সমষ্টি। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্যানথেইজমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে ঈশ্বরকে সর্বত্র বিরাজমান হিসেবে দেখা হয়। স্পিনোজার মতে, প্রকৃতির নিয়ম ও শৃঙ্খলা ঈশ্বরের প্রকাশ, এবং এই নিয়মগুলো অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য। তাই, প্রকৃতির গভীর জ্ঞান অর্জন করা মানে ঈশ্বরের প্রকৃতি বোঝা।
আবেগ ও মানব স্বাধীনতা: আবেগের দাসত্ব থেকে মুক্তি
স্পিনোজা আবেগকে মানব জীবনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে দেখেছেন, যা আমাদের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। তিনি আবেগকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন: সক্রিয় (যা আমাদের নিজস্ব প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত) এবং নিষ্ক্রিয় (যা বাহ্যিক কারণ দ্বারা সৃষ্ট)। মানুষ প্রায়শই নিষ্ক্রিয় আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, যা তাকে ‘দাসত্বে’ আবদ্ধ করে। স্পিনোজার মতে, এই আবেগের প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করে আমরা সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই। এই প্রক্রিয়ায়, আমরা আবেগের উপর ক্ষমতা অর্জন করি এবং সত্যিকারের স্বাধীনতা লাভ করি। তিনি বলেন, “যতই আমরা আমাদের আবেগগুলোকে বুঝতে পারি, ততই আমরা সেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।”
নৈতিকতা ও সুখঃ যুক্তিবুদ্ধির মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন
স্পিনোজার নৈতিক দর্শনে, বুদ্ধি ও জ্ঞান অর্জনকে সর্বোচ্চ গুণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, প্রকৃত সুখ ও পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য আমাদের উচিত বুদ্ধি ও যুক্তির অনুসরণ করা, যা আমাদের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ায়, আমরা আমাদের সত্যিকারের স্বার্থ ও মঙ্গল চিনতে পারি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হই। স্পিনোজা বলেন, “মানুষের জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো মানুষ নিজেই; তাই, সকলের মঙ্গল সাধনে একসাথে কাজ করা উচিত।” এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ব্যক্তিগত সুখ ও সামাজিক মঙ্গল পরস্পর সম্পর্কিত, এবং একে অপরের পরিপূরক [37] স্পিনোজার প্রস্তাবিত এই চিন্তাগুলো আমাদেরকে স্বাভাবিক জগতের সাথে আমাদের সম্পর্ক, আবেগের ভূমিকা, এবং নৈতিক জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
ঈশ্বর ও জগত অভিন্নঃ স্পিনোজার ব্যাখ্যা
স্পিনোজার মতে ঈশ্বর এবং জগতের মধ্যেকার অভিন্নতার অর্থ হলো জগৎ ঈশ্বরের বাইরে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়, বরং ঈশ্বরেরই বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ [38]। তিনি মনে করেন ঈশ্বর মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত; ঈশ্বর মহাবিশ্বের বাইরে নন; এবং মহাবিশ্ব তার ইচ্ছানুসারে নয়, বরং প্রয়োজনীয়তার খাতিরে যেমন আছে তেমনই আছে [39]। “নীতিশাস্ত্র”-এর প্রথম অংশে স্পিনোজা এই ধারণাটিকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। প্রস্তাবনা ১৫-তে তিনি লিখেছেন,
যা কিছু আছে, তা ঈশ্বরে আছে, এবং ঈশ্বর ছাড়া কিছুই থাকতে পারে না, বা ধারণা করাও যায় না [40]।
এর ভাষ্যে তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে ঈশ্বর হলেন সমস্ত কিছুর অন্তর্নিহিত কারণ (causa immanens), অর্থাৎ তিনি জগৎের বাইরে থেকে জগৎকে সৃষ্টি করেননি, বরং জগৎের মধ্যেই তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। “নীতিশাস্ত্র” থেকে আরও প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি এই ধারণাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। প্রস্তাব ১৬-তে বলা হয়েছে,
ঈশ্বরের স্বভাবের অনিবার্যতা থেকে অসীম সংখ্যক জিনিস অসীম উপায়ে অবশ্যই অনুসরণ করবে—অর্থাৎ, অসীম বুদ্ধির পরিধির মধ্যে যা কিছু পড়তে পারে [41]।
এছাড়াও, স্পিনোজা মনে করেন মহাবিশ্বে কিছুই আকস্মিক নয়, বরং সমস্ত জিনিস ঐশ্বরিক প্রকৃতির প্রয়োজনের দ্বারা একটি নির্দিষ্ট উপায়ে বিদ্যমান এবং কাজ করার জন্য শর্তযুক্ত [42] । এই উক্তি এবং ব্যাখ্যাগুলি ঈশ্বরের সাথে জগতের অভিন্নতাকে স্পিনোজার দর্শনের একটি মৌলিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
স্পিনোজাঃ ধর্মবাদীদের চোখে ছিলেন “নিকৃষ্ট শয়তান”
স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা তার সমসাময়িক সমাজে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল [43]। তার ধারণা তৎকালীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং প্রচলিত বিশ্বাসকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল। সেই সময়ে “নাস্তিক” বলতে বোঝানো হতো যারা ঈশ্বর এবং প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক সম্পর্কিত ঐতিহ্যবাহী বাইবেলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে [44]। স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদী ধারণা, যেখানে ঈশ্বর এবং প্রকৃতিকে অভিন্ন বলা হয়েছে, তৎকালীন ধর্মীয় নেতারা ঈশ্বরের মহিমা ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন [45]।
স্পিনোজাকে “নিকৃষ্ট শয়তান” আখ্যা দেওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তার বেশ কিছু ধারণা প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছিল। তিনি ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা, আত্মার অমরতা এবং স্বাধীন ইচ্ছার ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যা ধর্মীয় মহলে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল [46]। ঈশ্বরের এই সংজ্ঞা—যাকে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কারের পর “কেবল দার্শনিক অর্থে বিদ্যমান ঈশ্বর” হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল—ঐশ্বরিক সত্তার কোনো প্রকার মানবীকরণকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল [47]। স্পিনোজার “নীতিশাস্ত্র”-এ উপস্থাপিত ঈশ্বরের ধারণা আব্রাহামিক ধর্মের ঐতিহ্যবাহী ঈশ্বরের ধারণা থেকে অনেক দূরে [48] । এই কারণে তার ধারণাটিকে অবিলম্বে নীতিহীন, নাস্তিক্যবাদী মতবাদ হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল [49]। স্পিনোজার বহিষ্কারের কারণ স্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও, ধর্মীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা, ইহুদি বিশ্বাস নিয়ে সংশয় এবং সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি রক্ষার উদ্বেগ সম্ভবত মূল কারণ ছিল [50]। স্পিনোজার ধারণা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা বিপ্লবী এবং বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ও ঈশ্বরের সমালোচনা
স্পিনোজা মনে করতেন মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজেদের মানবীয় প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা অনুসারে ঈশ্বরকে তৈরি করে, যা এক ধরনের “মানবরূপায়ণ” (anthropomorphism) [51]। খেয়াল করলে দেখা যায়, এক এক অঞ্চলের ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্র এক এক রকম। এক ঈশ্বরের সাথে আরেক ঈশ্বরের পার্থক্যও স্পষ্ট। প্রতিটি সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জলবায়ু এবং মানুষের সভ্যতার ওপর সেই অঞ্চলে জন্ম নেয়া ব্যক্তিগত ঈশ্বরদের চরিত্রগুলো তৈরি হয়। তিনি এই ধরণের ঐশ্বরিক দাবিদাওয়া এবং প্রবণতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন [52]। স্পিনোজা বলেন, মানুষ মনে করে প্রকৃতির সবকিছু একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয় এবং ঈশ্বর নিজেই সবকিছু একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করেন [53]। তিনি উপহাস করে বলেছিলেন,
“আমি মনে করি, যদি একটি ত্রিভুজ কথা বলতে পারত, তবে সে বলত যে ঈশ্বর অত্যন্ত ত্রিকোণাকার, আর একটি বৃত্ত বলত যে ঐশ্বরিক প্রকৃতি অত্যন্ত বৃত্তাকার। এভাবে প্রত্যেকে ঈশ্বরকে তার নিজের গুণাবলী দেবে, নিজেকে ঈশ্বরের মতো মনে করবে এবং অন্য সবকিছুকে কদাকার মনে করবে” [54]।
একবার ভেবে দেখুন, একই ধর্মের অনুসারী হলেও, আল্লাহর চরিত্র দুইজন মুসলমানের কাছে কতটা ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। একজন ইসলামিক জঙ্গির দৃষ্টিতে, আল্লাহ এমন এক রক্তপিপাসু সত্তা, যিনি কাফেরদের রক্ত দেখে আনন্দিত হন—এবং সে বিশ্বাস করে, কাফেরের গলা কেটে সে যেন আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে এবং পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব কায়েম করছে, যা তার কাছে এক গৌরবময় ধর্মীয় কর্তব্য। অথচ একই ধর্মের আরেকজন মানবিক মুসলমান, যার কাছে মানুষ হওয়া মুসলমান হওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার চোখে আল্লাহ এক করুণাময় ও সংবেদনশীল সত্তা, যিনি একটি ক্ষুদ্র পোকামাকড়েরও যন্ত্রণা অনুভব করেন। সে যখন কোনো পোকা মারতে যায়, তখনও ভয়ে কাঁপে—আল্লাহ যদি এতে কষ্ট পান কিংবা রাগ করেন! একই ঈশ্বর, একই ধর্ম, অথচ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় কত বিপরীত রূপে প্রতিফলিত হতে পারে—এটাই সবচেয়ে গভীর ভাবনার বিষয়।
তিনি আরও বলেন, মানুষ নিজেদের কামনা-বাসনা পূরণের জন্য ঈশ্বরকে ব্যবহার করতে চায় [55]। স্পিনোজা মনে করেন, ভালো এবং মন্দ সম্পর্কিত আমাদের সাধারণ ধারণাগুলি মূলত এই ভুল বিশ্বাসের ফলস্বরূপ যে, মহাবিশ্ব আমাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে [56]! তার মতে, ধর্ম হলো স্থিতিশীল কুসংস্কার, যা মানুষের ভয় ও অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় [57]।
স্পিনোজার এই সমালোচনা ধর্ম এবং ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে গভীরভাবে প্রশ্ন করে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ তাদের সীমিত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ঈশ্বরকে নিজেদের মতো করে কল্পনা করে এবং এর ফলে সত্যকারের ঈশ্বর বা স্পিনোজার প্রস্তাবিত ঈশ্বর ধারণার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। এই সমালোচনা ঈশ্বরের ধারণার দার্শনিক তাৎপর্য উন্মোচন করে এবং মানুষকে তাদের নিজস্ব ধারণা সম্পর্কে সমালোচনামূলক হতে উৎসাহিত করে [58]। “নীতিশাস্ত্র”-এর প্রথম অংশের পরিশিষ্ট (“Appendix to Part I”)-তে স্পিনোজা এই বিষয়গুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা থেকে স্পিনোজার ঈশ্বরের পার্থক্য
স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা (প্রকৃতি, জগৎ এবং সবকিছু) প্রচলিত ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা থেকে বহুলাংশে ভিন্ন। স্পিনোজার ঈশ্বর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নন যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন বা এর বাইরে অবস্থান করেন; তিনি জগৎ এবং প্রকৃতির সাথেই অভিন্ন [59]। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, ঈশ্বর একজন ব্যক্তিগত সৃষ্টিকর্তা যার ইচ্ছা, বুদ্ধি এবং আবেগ রয়েছে, যিনি মানুষের প্রার্থনা শোনেন এবং তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু স্পিনোজা ঈশ্বরকে মানবীয় বৈশিষ্ট্যমুক্ত করেছেন [60]। তার ঈশ্বরের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, পছন্দ বা অপছন্দ নেই, তিনি ভালোবাসেন না বা ঘৃণা করেন না, এবং তিনি মানুষের বিচার করেন না [61]।
স্পিনোজার ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি প্রার্থনা শোনেন না, সাড়া দেন না, রাগান্বিত বা খুশি হন না [62]। তিনি আবেগ, ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত। তিনি অপরিবর্তনীয় এবং প্রকৃতির আইনের মতোই অনিবার্য [63]। অন্যদিকে, প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণায় মানবিক আবেগ-অনুভূতির উপস্থিতি দেখা যায়। এই পার্থক্যটি স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণাকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে, কারণ এটি ঈশ্বরকে এক ভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয় [64]। “নীতিশাস্ত্র”-এর প্রথম অংশের প্রস্তাবনা ১৭-তে স্পিনোজা ঈশ্বরের অপরিবর্তনীয়তার ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন।
নৈতিকতা ও ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পিনোজার ধারণা
স্পিনোজা মনে করতেন নৈতিকতা এবং ধর্মের উৎপত্তি মানুষের আত্ম-সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষা (conatus) এবং যুক্তির উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় [65]। তার মতে, ভালো এবং মন্দ কোনো কিছুই ঈশ্বরের বা প্রাকৃতিক জগতের দৃষ্টিকোণ থেকে সহজাতভাবে ভালো বা মন্দ নয় [66]। বরং, ভালো বা মন্দ হলো সেই জিনিস যা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সুবিধাজনক বা বাধা সৃষ্টি করে [67]। স্পিনোজা ছিলেন একজন নৈতিক অ্যান্টি-রিয়ালিস্ট, কারণ তিনি অস্বীকার করেছিলেন যে মানুষের ইচ্ছা ও বিশ্বাস থেকে স্বাধীনভাবে কোনো কিছুই ভালো বা মন্দ [68]। তিনি মনে করতেন সবকিছু ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে বলে মন্দের কোনো অস্তিত্ব নেই [69]। আমরা কোনো কিছুকে ভালো মনে করে কামনা করি না; বরং আমরা কোনো কিছু কামনা করি বলেই তাকে ভালো মনে করি [70]।
ধর্ম সম্পর্কে স্পিনোজার ধারণা হলো এটি মূলত ভয় ও অজ্ঞতা থেকে উৎপন্ন কুসংস্কারকে স্থিতিশীল করার একটি উপায় [71]। তিনি মনে করতেন ঐতিহ্যবাহী ধর্ম কুসংস্কারে পরিপূর্ণ হলেও, প্রকৃত ধার্মিকতা হলো ঐশ্বরিক আইনের প্রতি আনুগত্য, যা হলো ন্যায়বিচার ও দাতব্যতার মাধ্যমে ঈশ্বর ও প্রতিবেশীকে ভালোবাসা [72]। স্পিনোজা মঙ্গলময় ও শুভ বিষয়গুলোকে ঈশ্বরের আদেশ এবং অপছন্দনীয় বিষয়গুলোকে শয়তানের মূর্তরূপ হিসেবে দেখার সমালোচনা করেছেন [73]। তিনি এই ধরনের দ্বৈতবাদী ধারণাকে মানুষের কল্পনাপ্রসূত এবং প্রকৃতির প্রকৃত স্বরূপের বিরোধী বলে মনে করতেন [74]। স্পিনোজার নৈতিক দর্শন এবং ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ক ধারণা তার ঈশ্বরের ধারণার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, যেখানে ঈশ্বর হলেন প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নিয়ম এবং নৈতিকতা হলো সেই নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন। “নীতিশাস্ত্র”-এর চতুর্থ অংশে (“Of Human Servitude”) তিনি এই বিষয়গুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
আইনস্টাইনের স্পিনোজার ঈশ্বরে আস্থা
বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং তার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন [75]। আইনস্টাইন স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কারণ এটি মহাবিশ্বের নিয়মতান্ত্রিকতা, কার্যকারণ এবং ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণার অনুপস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল [76]। তিনি বলেছিলেন,
I believe in Spinoza’s God who reveals himself in the orderly harmony of what exists, not in a God who concerns himself with the fates and actions of human beings.
আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি বিদ্যমান জিনিসের সুশৃঙ্খল সামঞ্জস্যের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন, এমন ঈশ্বরে নয় যিনি মানুষের ভাগ্য ও কর্মের সাথে নিজেকে জড়িত করেন [77] [78]।
আইনস্টাইন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহে প্রচলিত ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না [79]। আইনস্টাইন তার বিভিন্ন লেখায় এবং সাক্ষাৎকারে স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণার প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম খোঁড়া এবং ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ, তবে এখানে ধর্ম বলতে উনি ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোকে বোঝাননি [80]। তিনি স্পিনোজার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং তাকে “আমাদের গুরু স্পিনোজা” বলে উল্লেখ করতেন [81]। আইনস্টাইন ছিলেন একজন দৃঢ় নিয়তিবাদী এবং স্পিনোজার সাথে তার এই বিষয়ে সম্পূর্ণ মিল ছিল [82]। তিনি মহাবিশ্বের সুশৃঙ্খলতা পর্যবেক্ষণ করে একটি রহস্যময় শক্তির অনুমান করেছিলেন এবং স্পিনোজার ঈশ্বরকে সেই শক্তির সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে করেছিলেন [83]। আইনস্টাইনের বিশ্বাস স্পিনোজার দর্শনের নিয়তিবাদ, প্রকৃতির নিয়ম এবং ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যানের মতো দিকগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল [84]।
প্রচলিত ঈশ্বর বনাম স্পিনোজার ঈশ্বর
বৈশিষ্ট্য | প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা | স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা |
প্রকৃতি | ব্যক্তিগত, সৃষ্টিকর্তা, জগৎ থেকে স্বতন্ত্র | অ-ব্যক্তিগত, জগৎ এবং প্রকৃতির সাথে অভিন্ন, অন্তর্নিহিত |
সৃষ্টি | জগৎকে নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি করেছেন | জগৎ ঈশ্বরের স্বভাবের অনিবার্যতা থেকে উৎপন্ন, অর্থাৎ ঈশ্বরই জগতের ওপর নির্ভরশীল |
গুণাবলী | ইচ্ছা, বুদ্ধি, আবেগ (যেমন রাগ, ভালোবাসা) | আবেগ, ইচ্ছা, উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত, কেবল অসীম গুণাবলী সম্পন্ন |
সম্পর্ক | মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করেন (প্রার্থনা শোনেন, উত্তর দেন) | মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করেন না |
নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার | ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার দেন এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি দেন | ভালো এবং মন্দ আপেক্ষিক ধারণা, ঈশ্বরের কোনো নৈতিক বিচার নেই |
উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা | জগতের জন্য একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা আছে | কোনো উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা নেই, সবকিছু যুক্তি ও প্রাকৃতিক নিয়মে চলে |
অতিপ্রাকৃত হস্তক্ষেপ | অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন | প্রকৃতির নিয়ম অপরিবর্তনীয়, কোনো অলৌকিক হস্তক্ষেপ নেই |
উপসংহার
স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণা তার দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় এবং বিতর্কিত দিক। তার সর্বেশ্বরবাদ এবং অদ্বৈতবাদ জগৎ এবং ঈশ্বরকে অভিন্ন হিসেবে স্থাপন করে, প্রচলিত ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। স্পিনোজা ঈশ্বরকে আবেগ, ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত এক অসীম সত্তা হিসেবে দেখেন, যা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার সমালোচনা করেন এবং দেখান কীভাবে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে ঈশ্বরকে কল্পনা করে। তার নৈতিক দর্শন এবং ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ক ধারণা তার ঈশ্বরের ধারণার সাথে গভীরভাবে যুক্ত। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীরাও স্পিনোজার ঈশ্বরের ধারণায় মহাবিশ্বের নিয়মতান্ত্রিকতা এবং কার্যকারণের একটি দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। স্পিনোজার ধারণা সপ্তদশ শতাব্দীর ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারায় একটি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছিল এবং পরবর্তী দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের উপর এর গভীর প্রভাব আজও বিদ্যমান [85]।
তথ্যসূত্রঃ
- Pantheism vs Pandeism ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎
- Nadler, Steven. Spinoza: A Life. Cambridge University Press, 1999. ↩︎
- Why Spinoza Was Excommunicated ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎
- God or Nature: Spinoza’s Ethics (In-Person) ↩︎
- Spinoza’s Concept of God: Modern Interpretations ↩︎
- Spinoza, Ethics, Part I, Definition 6 ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Spinoza’s Concept of God: Modern Interpretations ↩︎
- God or Nature: Spinoza’s Ethics (In-Person) ↩︎
- Spinoza’s Ethics – Wikipedia ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Spinoza on God, Affects, and the Nature of Sorrow ↩︎
- Spinoza: Monistic Pantheism and the Problem of an Impersonal Deity ↩︎
- Spinoza: Monistic Pantheism and the Problem of an Impersonal Deity ↩︎
- God or Nature: Spinoza’s Ethics (In-Person) ↩︎
- Spinoza’s Ethics – Wikipedia ↩︎
- Spinoza on God, Affects, and the Nature of Sorrow ↩︎
- Stanford Encyclopedia of Philosophy ↩︎
- Spinoza’s Ethics – Wikipedia ↩︎
- Spinoza’s Ethics – Wikipedia ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Ethics (Spinoza book) – Wikiquote ↩︎
- Baruch Spinoza Quotes – BrainyQuote ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎
- Spinoza, Benedict de: Metaphysics ↩︎
- Why Spinoza Was Excommunicated ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Why Spinoza Was Excommunicated ↩︎
- God or Nature: Spinoza’s Ethics (In-Person) ↩︎
- Why Spinoza Was Excommunicated ↩︎
- What exactly is radical about Spinoza’s conception of God? ↩︎
- Spinoza’s Commonwealth and the Anthropomorphic Illusion ↩︎
- What exactly is radical about Spinoza’s conception of God? ↩︎
- The Nature of Spinoza’s God – EvPhil Blog – Evolutionary Philosophy ↩︎
- Ethics (Spinoza book) – Wikiquote ↩︎
- Baruch Spinoza on Evil Eugene Marshall ↩︎
- Spinoza’s Theory of Religion – Stabilized Superstition ↩︎
- Spinoza’s Commonwealth and the Anthropomorphic Illusion ↩︎
- Why Spinoza Was Excommunicated ↩︎
- Musings on Spinoza and God, Part 2: Spinoza’s God, Anthropomorphism, and Process Theology ↩︎
- Musings on Spinoza and God, Part 2: Spinoza’s God, Anthropomorphism, and Process Theology ↩︎
- Spinoza on God, Affects, and the Nature of Sorrow ↩︎
- Spinoza on God, Affects, and the Nature of Sorrow ↩︎
- Baruch Spinoza (Stanford Encyclopedia of Philosophy) ↩︎
- Help me understand Spinoza’s Ethics ↩︎
- Baruch Spinoza on Evil Eugene Marshall ↩︎
- Spinoza on ‘good’. “Knowledge of good and evil is nothing ↩︎
- Benedict De Spinoza: Moral Philosophy ↩︎
- An Examination of Spinoza’s Moral Philosophy – PhilPapers ↩︎
- How did Spinoza explain the existence of evil? ↩︎
- Spinoza’s Theory of Religion – Stabilized Superstition ↩︎
- Benedict de Spinoza: Religion ↩︎
- Spinoza on God, Affects, and the Nature of Sorrow ↩︎
- An Examination of Spinoza’s Moral Philosophy – PhilPapers ↩︎
- The Nature of Spinoza’s God – EvPhil Blog – Evolutionary Philosophy ↩︎
- Religion — DIPC – Donostia International Physics Center ↩︎
- Einstein’s letter to Rabbi Herbert Goldstein (1929). Source: Einstein Archives Online ↩︎
- Religion — DIPC – Donostia International Physics Center ↩︎
- Religious and philosophical views of Albert Einstein – Wikipedia ↩︎
- Religion — DIPC – Donostia International Physics Center ↩︎
- How Well Did Einstein Understand Spinoza? ↩︎
- How Well Did Einstein Understand Spinoza? ↩︎
- Can Einstein’s reasons for believing in Spinoza’s God be structured as a deductive or syllogistic argument? ↩︎
- Religion — DIPC – Donostia International Physics Center ↩︎
- Ethics, Spinoza, Summary and Study Guide ↩︎