Table of Contents
ভূমিকা
ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও প্রকৃতির বর্ণনা প্রায়শই বহুবিধ জ্ঞানের দাবী (Knowledge Claim) উপস্থাপিত হয়েছে। তবে এই বর্ণনাগুলোকে যদি প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগের মানুষের ধারনা হিসেবে গ্রহণ না করে সরাসরি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখনই জটিলতা সৃষ্টি হয়। কোরআনের একাধিক আয়াতে পৃথিবীকে “স্থির” এবং “অচল” রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ধারণা প্রাচীন মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা নির্দেশ করে। পৃথিবীর গতি সম্পর্কে সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে এই ধরনের ধর্মীয় বর্ণনা তুলনা করলে স্পষ্ট হয় যে, মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাকৃতিক জগতকে বোঝার সীমাবদ্ধতা ছিল, যা আজকের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে ভিন্নতর রূপে উদঘাটিত।
কোরআন অনুসারে পৃথিবী স্থির
কোরআনে খুব পরিষ্কারভাবেই পৃথিবীকে স্থির এবং নড়াচড়া করে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান এবং নিজ অক্ষের ওপরও সে ঘুরছে, অনেকটা নিচের ছবির মত।
এবারে আসুন দেখা যাক, পৃথিবী ঘুর্ণায়মান নাকি স্থির, এই বিষয়ে ইসলাম কী বলে [1] –
আল্লাহই আসমান ও যমীনকে স্থির রাখেন যাতে ও দু’টো টলে না যায়। ও দু’টো যদি টলে যায় তাহলে তিনি ছাড়া কে ও দু’টোকে স্থির রাখবে? তিনি পরম সহিষ্ণু, পরম ক্ষমাশীল।
— Taisirul Quran
আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন যাতে ওরা স্থানচ্যূত না হয়, ওরা স্থানচ্যূত হলে তিনি ব্যতীত কে ওদেরকে সংরক্ষণ করবে? তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনকে ধরে রাখেন যাতে এগুলো স্থানচ্যুত না হয়। আর যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়, তাহলে তিনি ছাড়া আর কে আছে, যে এগুলোকে ধরে রাখবে? নিশ্চয় তিনি পরম সহনশীল, অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনকে ধারণ করেন, যাতে তারা স্থানচ্যুত না হয়, আর যদি তারা স্থানচ্যুত হয়, তবে তিনি ছাড়া কেউ নেই যে, তাদেরকে ধরে রাখতে পারে [১]। নিশ্চয় তিনি অতি সহনশীল, অসীম ক্ষমাপরায়ণ।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
কোরআনে এটিও বলা আছে যে, পৃথিবীর পর্বতমালার কারণে পৃথিবী ঢলে পড়ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, পাহাড় পর্বত না থাকলে পৃথিবীর ঢলে পড়ার সম্ভাবনা ছিল! [2] –
তিনি আকাশমন্ডলী নির্মাণ করেছেন স্তম্ভ ছাড়া যা তোমরা দেখছ। তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন দৃঢ়ভাবে দন্ডায়মান পর্বতমালা যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে নড়াচড়া না করে আর তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার জীবজন্তু, আর আমিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, অতঃপর তাতে উদ্গত করি যাবতীয় কল্যাণকর উদ্ভিদ।
— Taisirul Quran
তিনি আকাশমন্ডলী নির্মাণ করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা এটা দেখছ। তিনিই পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পবর্তমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্ব প্রকার জীব-জন্তু এবং আমিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করে এতে উদ্ভব করি সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদ।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন, যা তোমরা দেখছ, আর যমীনে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পাহাড়, যাতে তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলে না পড়ে, আর তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যেক প্রকারের প্রাণী; আর আসমান থেকে আমি পানি পাঠাই। অতঃপর তাতে আমি জোড়ায় জোড়ায় কল্যাণকর উদ্ভিদ জন্মাই।
— Rawai Al-bayan
তিনি আসমানসমূহ নির্মাণ করেছেন খুঁটি ছাড়া—তোমরা এটা দেখতে পাচ্ছ; তিনিই যমীনে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব ধরণের জীব-জন্তু। আর আমরা আকাশ হতে বারি বর্ষণ করি তারপর এতে উদ্গত করি সব ধরণের কল্যাণকর উদ্ভিদ।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তাফসীর গ্রন্থগুলোতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ
আসুন তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে পড়ি [3] –

জাকারিয়া আল-কাজউইনি হচ্ছেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলামি স্বর্ণযুগের একজন ফারসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি ইরানের কাজউইন শহরে ৬০০ হিজরি/ ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবী মুহাম্মাদের একজন বিশিষ্ট সাহাবী আনাস ইবনে মালিকের বংশধর। উনার গ্রন্থ The Wonders of Creation, Translated into Turkish from Arabic. Istanbul: ca. 1553 থেকে আমরা পৃথিবী ও মহাবিশ্বের ইসলামিক ধারণা পাই নিচের ছবিটির মত।

সূর্য ঘরে না পৃথিবী ঘোরেঃ প্রখ্যাত ফতোয়া
এবারে আসুন শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেদ আল উসাইমীন রচিত ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম থেকে একটি বিখ্যাত ফতোয়া দেখে নিই [4] [5] –
প্রশ্ন: (১৬) সূর্য কি পৃথিবীর চার দিকে ঘুরে?
উত্তর: মান্যবর শাইখ উত্তরে বলেন যে, শরী‘আতের প্রকাশ্য দলীলগুলো প্রমাণ করে যে, সূর্যই পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরে। এ ঘুরার কারণেই পৃথিবীতে দিবা-রাত্রির আগমণ ঘটে। আমাদের হাতে এ দলীলগুলোর চেয়ে বেশি শক্তিশালী এমন কোনো দলীল নেই, যার মাধ্যমে আমরা সূর্য ঘূরার দলীলগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি। সূর্য ঘুরার দলীলগুলো হলো আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِنَّ ٱللَّهَ يَأۡتِي بِٱلشَّمۡسِ مِنَ ٱلۡمَشۡرِقِ فَأۡتِ بِهَا مِنَ ٱلۡمَغۡرِبِ﴾ [البقرة: ٢٥٨]
“আল্লাহ তা‘আলা সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন। তুমি পারলে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৮] সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠার মাধ্যমে প্রকাশ্য দলীল পাওয়া যায় যে, সূর্য পৃথিবীর উপর পরিভ্রমণ করে।
২) আল্লাহ বলেন,
﴿فَلَمَّا رَءَا ٱلشَّمۡسَ بَازِغَةٗ قَالَ هَٰذَا رَبِّي هَٰذَآ أَكۡبَرُۖ فَلَمَّآ أَفَلَتۡ قَالَ يَٰقَوۡمِ إِنِّي بَرِيٓءٞ مِّمَّا تُشۡرِكُونَ ٧٨﴾ [الانعام: ٧٨]
“অতঃপর যখন সূর্যকে চকচকে অবস্থায় উঠতে দেখলেন তখন বললেন, এটি আমার রব, এটি বৃহত্তর। অতপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়ে শরীক কর আমি ওসব থেকে মুক্ত।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৭৮]
এখানে নির্ধারণ হয়ে গেল যে, সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়। একথা বলা হয় নি যে, সূর্য থেকে পৃথিবী ডুবে গেল। পৃথিবী যদি ঘূরত তাহলে অবশ্যই তা বলা হত।
৩) আল্লাহ বলেন,
﴿وَتَرَى ٱلشَّمۡسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَٰوَرُ عَن كَهۡفِهِمۡ ذَاتَ ٱلۡيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقۡرِضُهُمۡ ذَاتَ ٱلشِّمَالِ﴾ [الكهف: ١٧]
“তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বাম দিকে চলে যায়।” [সূরা কাহাফ, আয়াত: ১৭] পাশ কেটে ডান দিকে বা বাম দিকে চলে যাওয়া প্রমাণ করে যে, নড়াচড়া সূর্য থেকেই হয়ে থাকে। পৃথিবী যদিনড়াচড়া করত তাহলে অবশ্যই বলতেন সূর্য থেকে গুহা পাশ কেটে যায়। উদয় হওয়া এবং অস্ত যাওয়াকে সূর্যের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটা থেকে বুঝা যায় যে, সূর্যই ঘুরে। পৃথিবী নয়।
৪) আল্লাহ বলেন,
﴿وَهُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَۖ كُلّٞ فِي فَلَكٖ يَسۡبَحُونَ ٣٣﴾ [الانبياء: ٣٣]
“এবং তিনিই দিবা-নিশি এবং চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। সবাই আপন আপন কক্ষ পথে বিচরণ করে।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৩]
ইবন আব্বাস বলেন, লাটিম যেমন তার কেন্দ্র বিন্দুর চার দিকে ঘুরতে থাকে, সূর্যও তেমনিভাবে ঘুরে।
৫) আল্লাহ বলেন,
﴿يُغۡشِي ٱلَّيۡلَ ٱلنَّهَارَ يَطۡلُبُهُۥ حَثِيثٗا﴾ [الاعراف: ٥٤]
“তিনি রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিনের মাধ্যমে, দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পিছনে আসে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]
আয়াতে রাতকে দিনের অনুসন্ধানকারী বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনুসন্ধানকারী পিছনে পিছনে দ্রুত অনুসন্ধান করে থাকে। এটা জানা কথা যে, দিবা-রাত্রি সূর্যের অনুসারী।
৬) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ بِٱلۡحَقِّۖ يُكَوِّرُ ٱلَّيۡلَ عَلَى ٱلنَّهَارِ وَيُكَوِّرُ ٱلنَّهَارَ عَلَى ٱلَّيۡلِۖ وَسَخَّرَ ٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَۖ كُلّٞ يَجۡرِي لِأَجَلٖ مُّسَمًّىۗ أَلَا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفَّٰرُ ٥﴾ [الزمر: ٥]
“তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত করেছেন। প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫]
আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, পৃথিবীর উপরে দিবা-রাত্রি চলমান রয়েছে। পৃথিবী যদি ঘুরতো তাহলে তিনি বলতেন, দিবা-রাত্রির উপর পৃথিবীকে ঘূরান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সূর্য এবং চন্দ্রের প্রত্যেকেই চলমান”। এ সমস্ত দলীলের মাধ্যমে জানা গেল যে, সুস্পষ্টভাবেই সূর্য ও চন্দ্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করছে। এ কথা সুস্পষ্ট যে, চলমান বস্তুকে বশীভুত করা এবং কাজে লাগানো একস্থানে অবস্থানকারী বস্তুকে কাজে লাগানোর চেয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত।
৭) আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلشَّمۡسِ وَضُحَىٰهَا ١ وَٱلۡقَمَرِ إِذَا تَلَىٰهَا ٢﴾ [الشمس: ١، ٢]
“শপথ সূর্যের ও তার কিরণের, শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে।” [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ১-২]
এখানে বলা হয়েছে যে, চন্দ্র সূর্যের পরে আসে। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সূর্য এবং চন্দ্র চলাচল করে এবং পৃথিবীর উপর ঘুরে। পৃথিবী যদি চন্দ্র বা সূর্যের চার দিকে ঘুরত, তাহলে চন্দ্র সূর্যকে অনুসরণ করতনা। বরং চন্দ্র একবার সূর্যকে, আর একবার সূর্য চন্দ্রকে অনুসরণ করত। কেননা সূর্য চন্দ্রের অনেক উপরে। এ আয়াত দিয়ে পৃথিবী স্থীর থাকার ব্যাপারে দলীল গ্রহণ করার ভিতরে চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়েছে।
৮) মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلشَّمۡسُ تَجۡرِي لِمُسۡتَقَرّٖ لَّهَاۚ ذَٰلِكَ تَقۡدِيرُ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡعَلِيمِ ٣٨ وَٱلۡقَمَرَ قَدَّرۡنَٰهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَٱلۡعُرۡجُونِ ٱلۡقَدِيمِ ٣٩ لَا ٱلشَّمۡسُ يَنۢبَغِي لَهَآ أَن تُدۡرِكَ ٱلۡقَمَرَ وَلَا ٱلَّيۡلُ سَابِقُ ٱلنَّهَارِۚ وَكُلّٞ فِي فَلَكٖ يَسۡبَحُونَ ٤٠﴾ [يس: ٣٨، ٤٠]
“সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্ধারণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মঞ্জিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্যের পক্ষে চন্দ্রকে নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। রাতের পক্ষেও দিনের অগ্রবতী হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৩৮-৪০]
সূর্যের চলা এবং এ চলাকে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর নির্ধারণ বলে ব্যাখ্যা করা এটাই প্রমাণ করে যে, সূর্য প্রকৃতভাবেই চলমান। আর এ চলাচলের কারণেই দিবা-রাত্রি এবং ঋতুর পরিবর্তন হয়। চন্দ্রের জন্য মঞ্জিল নির্ধারণ করার অর্থ এ যে, সে তার মঞ্জিলসমূহে স্থানান্তরিত হয়। যদি পৃথিবী ঘুরত, তাহলে পৃথিবীর জন্য মঞ্জিল নির্ধারণ করা হত। চন্দ্রের জন্য নয়। সূর্য কর্তৃক চন্দ্রকে ধরতে না পারা এবং দিনের অগ্রে রাত থাকা সূর্য, চন্দ্র, দিন এবং রাতের চলাচলের প্রমাণ বহন করে।
৯) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আবু যরকে বলেছেন,
«أَتَدْرِي أَيْنَ تَذْهَبُ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ فَتَسْتَأْذِنَ فَيُؤْذَنُ لَهَا وَيُوشِكُ أَنْ تَسْجُدَ فَلَا يُقْبَلَ مِنْهَا وَتَسْتَأْذِنَ فَلَا يُؤْذَنَ لَهَا يُقَالُ لَهَا ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ فَتَطْلُعُ مِنْ مَغْرِبِهَا»
“হে আবু যর! তুমি কি জান সূর্য যখন অস্ত যায় তখন কোথায় যায়? আবু যার বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় ‘আরশের নিচে গিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং পুনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি চায়। অতঃপর তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। সে দিন বেশি দূরে নয়, যে দিন অনুমতি চাবে কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। তাকে বলা হবে যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফেরত যাও। অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিক থেকেই উদিত হবে।”[1]
এটি হবে কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে। আল্লাহ সূর্যকে বলবেন, যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফেরত যাও, অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সূর্য পৃথিবীর উপরে ঘুরছে এবং তার এ ঘুরার মাধ্যমেই উদয়-অস্ত সংঘটিত হচ্ছে।
১০) অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে জানা যায় যে, উদয় হওয়া, অস্ত যাওয়া এবং ঢলে যাওয়া এ কাজগুলো সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত। এগুলো সূর্য থেকে প্রকাশিত হওয়া খুবই সুস্পষ্ট। পৃথিবী হতে নয়। হয়তো এ ব্যাপারে আরো দলীল-প্রমাণ রয়েছে। সেগুলো আমার এ মুহূর্তে মনে আসছেনা। তবে আমি যা উল্লেখ করলাম, এ বিষয়টির দ্বার উম্মুক্ত করবে এবং আমি যা উদ্দেশ্য করেছি, তা পূরণে যথেষ্ট হবে। আল্লাহর তাওফীক চাচ্ছি!
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: বাদউল খালক; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান



আলেম-ওলামাদের বক্তব্য
এবারে আসুন শায়খ মতিউর রহমান মাদানী এই বিষয়ে কী বলে জেনে নেয়া যাক,
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষিত তথ্য অনুযায়ী পৃথিবী স্থির নয় বরং বহুমাত্রিক গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। প্রথমত, পৃথিবী নিজের অক্ষের চারপাশে প্রায় ১,৬৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে ঘূর্ণায়মান, যার ফলশ্রুতিতে দিন ও রাতের পালাবদল ঘটে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বেগে কক্ষপথে পরিক্রমণ করছে, যার কারণে ঋতুর পরিবর্তন এবং বছরের চক্র নির্ধারিত হয়। তৃতীয়ত, সৌরজগত নিজেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে প্রায় ৮,২৮,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে ঘুরছে। অতএব, পৃথিবীকে স্থির বলা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার পরিপন্থী। এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের উক্তি সমকালীন মানুষের সীমিত অভিজ্ঞতা ও ভাষাগত প্রেক্ষাপটে বোধগম্য হলেও তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উপসংহার
ধর্মীয় শাস্ত্রের ভাষা ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য এক নয়—প্রথমটি মূলত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনার উপর কেন্দ্রীভূত, আর দ্বিতীয়টি প্রাকৃতিক বাস্তবতার পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণে নিবেদিত। কোরআনের “পৃথিবী স্থির” সংক্রান্ত বক্তব্যকে যদি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয়, তবে তা বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে। তবে এটিকে যদি প্রাচীন মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সীমিত জ্ঞানের প্রেক্ষিতে দেখা হয়, তাহলে এই ভাষা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আধুনিক একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকে পৃথিবীর প্রকৃতি ও গতি ব্যাখ্যা করতে হলে ধর্মীয় পাঠের আক্ষরিক অর্থের বাইরে এসে সেটিকে ঐতিহাসিক ও মানবিক প্রেক্ষাপটে পুনঃপাঠ করা অপরিহার্য।
তথ্যসূত্রঃ
- কোরআন ৩৫ঃ৪১ ↩︎
- কোরআন ৩১ঃ১০ ↩︎
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৯ ↩︎
- ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ঈমান, শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ↩︎
- ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেদ আল উসাইমীন, পৃষ্ঠা ৩৭, ৩৮, ৩৯ ↩︎