Table of Contents
ভূমিকা
ধর্মগ্রন্থসমূহে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও পৃথিবীর যেই ইতিহাস বর্ণনা করা হয়, তা প্রায়শই বাস্তব জগত সম্পর্কে কিছু নলেজক্লেইম করে। কোরআনের ৩৯:৬ আয়াত এমন একটি উদাহরণ, যেখানে আল্লাহ মানুষের জন্য “আট জোড়া” গৃহপালিত পশু নাযিল করেছেন বলে উল্লেখ আছে। প্রচলিত তাফসীরসমূহে এই আট জোড়া বলতে বোঝানো হয়েছে— ভেড়া, ছাগল, উট এবং গরু; প্রতিটি প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী মিলিয়ে মোট আট জোড়া।
এ ধরনের বর্ণনা শুধু ধর্মতত্ত্ব নয়, বরং ঐতিহাসিক প্রাণিবিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ব, এবং ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকেও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ, “নাযিল” শব্দটি আকাশ থেকে অবতরণের ইঙ্গিত দেয়, অথচ গবাদি পশুর ইতিহাসে কোনো প্রমাণ নেই যে এগুলো মানুষের কাছে পূর্বপ্রস্তুত অর্থাৎ গবাদি পশু অবস্থায় নেমে এসেছে। বরং জীবাশ্মবিদ্যা ও জেনেটিক গবেষণা দেখায় যে, এসব প্রাণী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন অঞ্চলে গৃহপালিত হয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমরা আয়াতটির ভাষাগত প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক সত্যতা, বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি, এবং গবাদি পশুর গৃহপালনের বাস্তব ইতিহাস আলোচনা করব। পাশাপাশি প্রতিটি প্রজাতির গৃহপালিত হওয়ার সময়কাল ও ভৌগোলিক উৎস একটি টেবিলে তুলে ধরা হবে, যাতে স্পষ্ট হয়— কোরআনের বর্ণনা সেই সময়ের আরবীয় বাস্তবতার প্রতিফলন, সর্বজনীন প্রাকৃতিক ইতিহাসের নয়।
আয়াত ও তাফসীরের মূল বক্তব্য
কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ নাকি মানুষের জন্য পুরুষ নারী সহ মোট ৮টি অর্থাৎ চার জোড়া গবাদি পশু নাজিল করেছেন। আসুন কোরআনের আয়াতটি এবং তাফসীরে জাকারিয়া থেকে এর ব্যাখ্যাটিও জেনে নিই, [1]
তিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার থেকে তিনি তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য বানিয়েছেন আট গৃহপালিত পশু (চার) জোড়ায় জোড়ায়। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মায়েদের গর্ভে, এক এক পর্যায়ে এক এক আকৃতি দিয়ে, তিন তিনটি অন্ধকার আবরণের মধ্যে। এই হল তোমাদের প্রতিপালক, সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, কাজেই (ভুয়ো ক্ষমতার অধিকারী, দাম্ভিক ও স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক) তোমাদেরকে কোন্ দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?
— Taisirul Quran
তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি হতে। অতঃপর তিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের দিয়েছেন আট প্রকার গৃহপালিত পশু। তিনি তোমাদের মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আল্লাহ! তোমাদের রাব্ব। সার্বভৌমত্ব তাঁরই, তিনি ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। অতএব তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলেছ?
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নাফ্স থেকে, তারপর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তু থেকে তোমাদের জন্য দিয়েছেন আট জোড়া*; তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন তোমাদের মাতৃগর্ভে; এক সৃষ্টির পর আরেক সৃষ্টি, ত্রিবিধ অন্ধকারে**; তিনিই আল্লাহ; তোমাদের রব; রাজত্ব তাঁরই; তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তারপরও তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?*** * আট জোড়া চতুষ্পদ জন্তু: মেষের দু’টি ও ছাগলের দু’টি, উটের দু’টি ও গরুর দু’টি।
— Rawai Al-bayan
তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি হতে। তারপর তিনি তার থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন [১]। আর তিনি তোমাদের জন্য নাযিল করেছেন আট জোড়া আন’আম [২]। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভের ত্ৰিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আল্লাহ; তোমাদের রব; সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই; তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। অতঃপর তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এবারে আসুন তাফসীরে জাকারিয়া থেকে পড়ি, [2]

তাফসীরগুলোতে (যেমন তাফসীরে জাকারিয়া) “আট জোড়া” বলতে বোঝানো হয়েছে—
- ভেড়া (পুরুষ ও স্ত্রী)
- ছাগল (পুরুষ ও স্ত্রী)
- উট (পুরুষ ও স্ত্রী)
- গরু (পুরুষ ও স্ত্রী)
ইসলাম অনুসারে, এগুলো আল্লাহ মানুষের উপকারের জন্য দিয়েছেন এবং “নাযিল” শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে সেগুলো আল্লাহ আকাশ থেকে অবতীর্ণ করেছেন, যেমন কোরআন বা বৃষ্টি অবতীর্ণ হয়।
“নাযিল” শব্দ ও জীববৈজ্ঞানিক বাস্তবতা
আরবি “أنزل” (আনযালা) শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো কোনো কিছু উচ্চ স্থান থেকে নিম্নস্থানে নামিয়ে আনা বা অবতীর্ণ করা। কোরআনে এটি প্রায়শই আকাশ থেকে কিছু নেমে আসার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে— যেমন Quran 57:25-এ লৌহ নাযিল হওয়ার বর্ণনা, Quran 16:65-এ বৃষ্টিপাতের উল্লেখ। একইভাবে, Quran 39:6 আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষের জন্য “আট জোড়া গৃহপালিত পশু নাযিল করেছেন”। শব্দচয়নটি এমন ধারণা দেয় যে এই প্রাণীগুলো আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে বা কোনো অলৌকিক উপায়ে মানুষের কাছে এসেছে।
কিন্তু ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করে। প্রত্নতত্ত্ব ও আধুনিক জীববিজ্ঞান দেখায় যে উট, গরু, ছাগল এবং ভেড়া কোনো এক সময় হঠাৎ সৃষ্ট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি Domestication প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বুনো পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। Domestication বলতে বোঝানো হয় মানুষের নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection), যেখানে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে শান্ত স্বভাব, আকারের সুবিধা, দুধ, মাংস বা শ্রমে উপযোগী বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণী নির্বাচন করে প্রজনন করিয়েছে। এই প্রক্রিয়া কয়েক প্রজন্ম জুড়ে প্রাণীর শারীরিক গঠন ও আচরণে স্থায়ী পরিবর্তন আনে।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া শুরু হয় নব্যপ্রস্তর যুগের কৃষি বিপ্লবের সময় (প্রায় ১০,০০০–১১,০০০ বছর আগে), যখন মানুষ শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে কৃষি ও স্থায়ী বসতিতে প্রবেশ করে। তবে গৃহপালন কোনো একক বা একই সময়ে সংঘটিত ঘটনা নয়; বরং এটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্রভাবে ঘটেছে—
- ভেড়া ও ছাগল প্রথম গৃহপালিত হয় ফার্টাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলে (~৯,০০০–৮,৫০০ BCE)।
- গরু এসেছে বুনো বনগাই (Bos primigenius) থেকে, অন্তত তিনটি ভিন্ন কেন্দ্রে—মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফ্রিকা (~৮,৫০০ BCE)।
- উট গৃহপালিত হয় অনেক পরে, ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে (~৩,০০০–২,৫০০ BCE), প্রধানত আরব ও মধ্য এশিয়ায়।
এই টাইমলাইন স্পষ্ট করে দেয় যে সব প্রজাতি একই সময়ে বা একই প্রক্রিয়ায় মানুষের হাতে আসেনি। ফলে, কোরআনের বর্ণিত একযোগে “নাযিল” হওয়া ধারণা আক্ষরিক অর্থে নিলে জীববিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে, আর রূপক অর্থেও এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
কোরআনে উল্লেখিত গবাদি পশুর তালিকা ও বৈজ্ঞানিক ইতিহাস
ক্র. নং | প্রজাতি | বৈজ্ঞানিক নাম | বুনো পূর্বপুরুষ | গৃহপালিত হওয়ার স্থান | আনুমানিক সময়কাল (BCE) | রেফারেন্স |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ভেড়া (Sheep) | Ovis aries | বুনো মাফলন (Ovis orientalis) | ফার্টাইল ক্রিসেন্ট (আধুনিক তুরস্ক, ইরান, ইরাক) | ~১১,০০০ বছর আগে (৯,০০০ BCE) | Zeder & Hesse, 2000 |
2 | ছাগল (Goat) | Capra hircus | বুনো বেজার ছাগল (Capra aegagrus) | ইরান, আনাতোলিয়া | ~১০,০০০ বছর আগে (৮,৫০০ BCE) | Naderi et al., 2008 |
3 | উট (Camel) | Camelus dromedarius (এক কুঁজ) ও Camelus bactrianus (দুই কুঁজ) | বুনো উট (Camelus ferus) | আরব উপদ্বীপ (দ্রোমেডারি), মধ্য এশিয়া (ব্যাকট্রিয়ান) | ~৩,০০০–২,৫০০ BCE | Peters & von den Driesch, 1997 |
4 | গরু (Cattle) | Bos taurus | বুনো বনগাই (Aurochs, Bos primigenius) | ফার্টাইল ক্রিসেন্ট, ভারত, আফ্রিকা | ~১০,৫০০ বছর আগে (৮,৫০০ BCE) | Bollongino et al., 2012 |
মূল পর্যবেক্ষণ:
- ভেড়া, ছাগল ও গরু গৃহপালিত হয়েছে নব্যপ্রস্তর যুগের শুরুতে (Neolithic Revolution)।
- উট গৃহপালিত হয়েছে অনেক পরে, ব্রোঞ্জ যুগের শেষ দিকে।
- অর্থাৎ, কোরআনের বর্ণনার মতো সবগুলো একসাথে “নাযিল” হয়নি; বরং হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে মানুষ এগুলোকে আলাদা আলাদা সময়ে গৃহপালিত করেছে।
আঞ্চলিকতার সমস্যা
কোরআনের “আট জোড়া” তালিকা স্পষ্টতই আরব উপদ্বীপের প্রেক্ষাপটে সীমিত। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে (যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা) মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবাদি পশু বা গৃহপালিত প্রাণী (যেমন মুরগি, মহিষ, লামা, রেইনডিয়ার) এখানে অনুপস্থিত। একটি সর্বজনীন স্রষ্টা যদি মানবজাতির জন্য নির্দেশ দেন, তাহলে তাঁর বর্ণনা কেবল এক অঞ্চলের বাস্তবতার সাথে মিলবে — এটি যৌক্তিক নয়।

উপসংহার
ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ অনুযায়ী—
- কোরআনের বর্ণিত “আট জোড়া” পশু আকাশ থেকে নাযিল হয়নি; বরং এগুলো ধীরে ধীরে গৃহপালিত হয়েছে।
- প্রজাতিগুলো ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে গৃহপালিত হয়েছে, একসাথে নয়।
- আয়াতের আঞ্চলিকতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রমাণ করে এটি সেই সময়কার আরবদের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতিফলন, সর্বজ্ঞ ও সর্বজনীন স্রষ্টার বক্তব্য নয়।