নবী চাঁদকে দুইভাগ করেছিল

ভূমিকা

ইসলামের বিশ্বাস হচ্ছে, নবী মুহাম্মদের আমলে চাঁদকে মুহাম্মদ তার মোজেজা দ্বারা দুই খণ্ডে বিভক্ত করেছিলেন। চাঁদ নামক উপগ্রহটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সেই খণ্ড দুইটির একটি খণ্ড মক্কার একটি পাহাড়ের একপাশে, আরেকটি খণ্ড পাহাড়ের অপর পাশে পড়ে। বিষয়টি খুবই হাস্যকর এই কারণে যে, মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের চাঁদের আকৃতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। এর বহু পূর্বেই গ্রীসের জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ চাঁদ সম্পর্কে অনেক ভাল তথ্য জানতেন। এছাড়াও, চাঁদের দুই খণ্ড হওয়ার দাবীটিও খুবই হাস্যকর। দুই খণ্ডে বিভক্ত হলে চাঁদ আর কিছুতেই একসাথে লেগে থাকতো না।

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। সহজে বোঝার জন্য চাঁদ এবং পৃথিবীর তুলনামূলক একটি চিত্র দেয়া হলো। পাঠকগণ আশা করি বুঝতে পারছেন, চাঁদ কোন ছোট একটি গোলা নয় যে, এটি বলের মত পাহাড়ের এই পাশে আর ঐ পাশে পড়বে। চাঁদের অর্ধেক খণ্ড পড়লে গোটা সৌদী আরবই উধাও হয়ে যাওয়ার কথা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা তো বাদই দিচ্ছি!

বিজ্ঞান

আলেমদের বক্তব্য (ভিডিও)

এবারে আসুন শুরুতেই একজন হুজুরের ওয়াজ শুনি নিই,


কোরআন হাদিসের দলিল

আসুন এই সম্পর্কিত তথ্যসূত্রগুলো যাচাই করে নিই [1] [2] [3] [4] [5] [6] [7] [8] [9]

ক্বিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র খন্ডিত হয়েছে,
— Taisirul Quran
কিয়ামাত আসন্ন, চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে,
— Sheikh Mujibur Rahman
কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে।
— Rawai Al-bayan
কিয়ামত কাছাকাছি হয়েছে [১], আর চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে [২],
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ‏
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৫। আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা, আবূ কুরায়ব ইসহাক ইবনু ইবরাহীম, উমার ইবনু হাফস ইবনু গিয়াস, ও মিনজাব ইবনু হারিছ তামিমী (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মিনায় আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। এমতাবস্থায় (হঠাৎ করে) চন্দ্র বিদীর্ন হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এক খন্ড পাহাড়ের এ পাশে পড়ল এবং অপর খন্ড পড়ল পাহাড়ের ওপাশে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা সাক্ষী থাক।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

চন্দ্র দ্বিখণ্ডন

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ৪৪/ তাফসীরুল কুরআন
পাবলিশারঃ হুসাইন আল-মাদানী
পরিচ্ছদঃ ৫৫. সূরা আল-কামার
৩২৮৯। জুবাইর ইবনু মুতাইম (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে চাঁদ বিদীর্ণ হল এবং দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলে, এক অংশ এই পাহাড়ের উপর এবং অপর অংশ ঐ পাহাড়ের উপর পড়ে গেল। তারা (মাক্কাবাসী কাফিররা) বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যাদু করেছেন। কেউ কেউ বলল, তিনি আমাদের যাদু করে থাকলে সব মানুষকে যাদু করতে পারবেন না।
হাদীসটির সানাদ সহীহ।
আবূ ঈসা বলেন, কোন কোন বর্ণনাকারী এ হাদীস হুসাইন হতে, তিনি জুবাইর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু জুবাইর ইবনু মুতাইম হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা জুবাইর ইবনু মুতাইম (রাযিঃ) হতে, এই সূত্রে একই রকম বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

চাঁদ দ্বিখণ্ডিত

সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৫২। কিয়ামাত, জান্নাত ও জান্নামের বর্ণনা
পরিচ্ছদঃ ৮. চন্দ্র খণ্ডিত হওয়ার বর্ণনা
৬৯৬৬-(৪৫/…) উবাইদুল্লাহ ইবনু মুআয আল আম্বারী (রহঃ) ….. ‘আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় চন্দ্র ফেটে দু’টুকরো হয়ে যায়। এর এক টুকরোকে পাহাড় আড়াল করে ফেলেছে এবং অপর এক টুকরো পাহাড়ের উপর পরিলক্ষিত হয়েছে। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮১৬, ইসলামিক সেন্টার ৬৮৭০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ‏
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৯। মুহাম্মদ ইবনু মুসান্না ও ইবনু বাশশার (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হল। তবে আবূ দাঊদ (রহঃ) এর হাদীসে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় (চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ‏
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৮। যুহায়র ইবনু হারব ও আবদ ইবনু হুমায়দ (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কাবাসী লোকেরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তাদের একটি নিদর্শন (মু’জিযা) দেখানোর দাবী করল। তিনি তাদের (দু’বার) চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার নিদর্শন দেখালেন।
মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে শায়বানের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
পরিচ্ছদঃ ২০৭৭. মুশরিকরা মুজিযা দেখানোর জন্য নবী করীম (সাঃ) এর নিকট আহবান জানালে তিনি চাঁদ দু’টুকরা করে দেখালেন
৩৩৭৭। খালাফ ইবনু খালিদ আল-কুরায়শী (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)


শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থের ব্যাখ্যাসমূহ

এবারে আসুন সহিহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ নসরুল বারীতে এই বিষয়ে কী বর্ণনা করা আছে দেখে নেয়া যাক [10]

চাঁদ

ইসলামের প্রখ্যাত একটি গ্রন্থ আশ শিফা যার লেখক হলেন বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা ইমাম কাজী আয়াজ আন্দুলুসী, তার বই থেকে এই হাদিসগুলো দেখি [11],

চাঁদ 4
চাঁদ 6

যৌক্তিক বিশ্লেষণঃ চাঁদ যদি সত্যিই দুইভাগ হয়ে যেত!

ইসলামিক মিথলজিতে বর্ণিত “চাঁদ দ্বিখণ্ডন” ঘটনাটি যদি সত্যিই জ্যোতির্বিদ্যাগত বাস্তবতা হতো, তবে তার প্রাকৃতিক, ভৌত এবং ঐতিহাসিক প্রভাব আজও স্পষ্টভাবে দেখা যেত। নিচের এই নিয়ে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব ও ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করা হচ্ছে।


চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়

চাঁদের মহাকর্ষীয় টান পৃথিবীর জোয়ার–ভাটার প্রধান চালিকা শক্তি। পৃথিবী–চাঁদ–সূর্য সিস্টেমে যে টাইডাল ফোর্স তৈরি হয়, তার কারণে সমুদ্রের পানি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে উঠানামা করে। চাঁদ যদি হঠাৎ দুই ভাগ হয়ে যেত, তবে পৃথিবী–চাঁদ সিস্টেমের ভরবন্টন (mass distribution), কৌণিক ভরবেগ (angular momentum) এবং গ্র্যাভিটেশনাল পোটেনশিয়াল অল্প সময়ে নাটকীয়ভাবে বদলে যেত। এর ফলে সমুদ্রের উপর অস্বাভাবিক, অসমমিত টাইডাল ফোর্স তৈরি হয়ে গ্লোবাল স্কেলে মেগা-জোয়ার (mega-tides) এবং দীর্ঘস্থায়ী সুনামির মতো বিস্তৃত জলবিপর্যয় ঘটত। উপকূলীয় শহর, নদী মোহনা, ডেল্টা অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক প্লাবন, লবণাক্ততার তীব্র বৃদ্ধি, এবং নৌপরিবহন ও কৃষিব্যবস্থায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ত [12]

টাইডাল ফোর্স শুধু সমুদ্রেই কাজ করে না; এটি পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট এবং ম্যান্টলকেও সামান্য বিকৃত করে। চাঁদ যদি দুই ভাগ হয়ে পৃথক কক্ষপথে ঘুরতে শুরু করত, তবে পৃথিবীর উপর দ্বৈত-টাইডাল প্যাটার্ন তৈরি হতো, যা ক্রাস্টাল স্ট্রেস বাড়িয়ে ব্যাপক ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত ত্বরান্বিত করতে পারত। পৃথিবীর ঘূর্ণনকাল ও অক্ষের স্থিতিশীলতাও (axial stability) ব্যাহত হতে পারত, যার ফলে দিন–রাতের দৈর্ঘ্য, ঋতুর ধরণ ও জলবায়ুতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন দেখা দিত [13]। বাস্তব পৃথিবীতে আমরা এই ধরনের হঠাৎ, সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের কোন ভূতাত্ত্বিক বা জলবায়ু-সংক্রান্ত প্রমাণ দেখি না।


চাঁদ টুকরো হলে আবার “জোড়া লাগতে” পারে?

মহাকর্ষীয় শক্তি ভরকে একত্রে ধরে রাখে, কিন্তু কোনো বড় জ্যোতিষ্ক যদি একবার “দুই টুকরো” হয়ে যায়, তা সাধারণত আবার মসৃণ গোলকে ফিরে আসে না। দুইটি বৃহৎ অংশ যদি পরবর্তীতে পুনরায় সংঘর্ষে লিপ্তও হয়, তবে সেই সংঘর্ষে বিপুল গতিজ শক্তি তাপে রূপান্তরিত হয়ে গলিত পাথর, ধূলিকণা, মল্টেন লাভা ও ব্যাপক ক্রাস্টাল রি-সারফেসিং ঘটাবে। এর ফলে জ্যোতিষ্কের পৃষ্ঠজুড়ে বিশাল ফাটল, রিঙ্গড বেসিন, শক-মেটামরফিক গঠন এবং পুনঃস্ফটিকীকরণের (recrystallization) প্রমাণ পাওয়ার কথা।

NASA-এর Apollo মিশন থেকে আনা চাঁদের শিলা-নমুনা, লুনার রিকনেসান্স অরবিটার (LRO)–এর উচ্চ-রেজোলিউশনের টপোগ্রাফি এবং Apollo Passive Seismic Experiment-এর সিসমিক ডেটা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে চাঁদের গঠন ও ইতিহাস সম্পর্কে যে ছবি দেখা যায়, তা হল প্রাথমিক giant impact (Theia-সংঘর্ষ) ও পরবর্তী বিলিয়ন বছরের ম্যাগমা সমুদ্র, আগ্নেয় কার্যকলাপ ও অ্যাস্টেরয়েড/ধূমকেতুর আঘাতে তৈরি ক্রেটার; কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো “অতীতের কোন এক সময়ে ভেঙে আবার জোড়া লাগা”–র প্রমাণ নেই [14]। যদি ৭ম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে চাঁদ সত্যিই দুই ভাগ হয়ে পরে “জোড়া লাগত”, তবে ওই সময়ের রেডিওমেট্রিক বয়স, সিসমিক গঠনে সুস্পষ্ট অস্বাভাবিকতা থাকত—যা আমরা একেবারেই পাই না।


চাঁদের টুকরো পৃথিবীতে এলে কী হতো?

চাঁদের ভর পৃথিবীর ভরের প্রায় ১/৮১। চাঁদের একটি বড় অংশ যদি ভেঙে পৃথিবীতে এসে পড়ত, তবে তা হবে একটি planet-scale impact event—ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটানো Chicxulub অ্যাস্টেরয়েডের তুলনায় অসংখ্য গুণ বেশি শক্তিশালী। Chicxulub প্রভাব (~১০ কিলোমিটার ব্যাসের গ্রহাণু) প্রায় ১০ মেগাটন TNT সমতুল্য শক্তি ছড়িয়ে বৈশ্বিক অগ্নিকাণ্ড, সুনামি, অ্যাসিড বৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী “ইমপ্যাক্ট উইন্টার” তৈরি করেছিল [15]। চাঁদের টুকরো হলে এর স্কেল এত বিশাল হতো যে পৃথিবীর পৃষ্ঠের বড় অংশ গলিত হয়ে যেত, মহাসাগরের পানি আংশিকভাবে বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডল ঘন ধূলি ও বাষ্পে ঢাকা পড়ত, এবং জীবনের অধিকাংশই সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হতো।

পৃথিবীর Ice Age বা বরফযুগগুলো তৈরি হয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথের ধরণে পরিবর্তন (Milankovitch cycles), সৌর বিকিরণ, বায়ুমণ্ডলের CO2 এবং সমুদ্র সঞ্চালনের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের কারণে, কোনো সাম্প্রতিক “চাঁদের খণ্ড” পৃথিবীতে পড়ার কারণে নয় [16]। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির ক্ষেত্রেও জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় একটি নির্দিষ্ট গ্রহাণু-প্রভাব, বৈশ্বিক iridium স্তর এবং Chicxulub ক্রেটারের মাধ্যমে—চাঁদের টুকরো পড়ার কোনো ভূতাত্ত্বিক বা কসমোকেমিক্যাল প্রমাণ নেই। অতএব, “চাঁদ ফেটে টুকরো পৃথিবীতে এসেছে, তাই Ice Age বা ডাইনোসর বিলুপ্তি” – এ ধরনের ব্যাখ্যা আধুনিক ভূতত্ত্ব, প্যালেওন্টোলজি ও জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।


ঐতিহাসিক সূত্রের অনুপস্থিতি

চাঁদ দ্বিখণ্ডন যদি বাস্তব, দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যাগত ঘটনা হতো, তবে সেটি পৃথিবীর প্রায় সব অংশ থেকেই নির্ণায়কভাবে দেখা যেত – কারণ চাঁদ পৃথিবীজুড়েই রাতের আকাশে দৃশ্যমান। সপ্তম শতাব্দীতে চীন, ভারত, পারস্য, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, আরব ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ইতোমধ্যেই সুসংগঠিত জ্যোতির্বিদ্যা ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চর্চায় অভ্যস্ত ছিল।

চীনা জ্যোতির্বিদরা নোভা, সুপারনোভা, ধূমকেতু, গ্রহণ এবং সামান্য অস্বাভাবিক লুনার ঘটনাও বিস্তারিতভাবে রেকর্ড করেছেন; মেসোপটেমিয়া ও বেবিলনে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির ট্যাবলেট পাওয়া যায়; গ্রিক-রোমান এবং পরবর্তী বাইজান্টাইন ঐতিহাসিক দলিলগুলোতেও সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের মতো ঘটনাগুলো উল্লেখ আছে [17]। এত সব সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ভেতরে “চাঁদ দুই ভাগ হয়ে গেল, অংশ এপাশে–ওপাশে” – এই ধরনের একটি অভূতপূর্ব বৈশ্বিক মহাজাগতিক ঘটনা যদি ঘটত, তবে একাধিক সভ্যতার স্বাধীন সূত্রে তা লিপিবদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিদ কিংবা নাসা-সংকলিত ঐতিহাসিক গ্রহণ-তালিকা কোথাও এমন কোনো রেকর্ড খুঁজে পায় না [18]

অতএব, বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই “চাঁদ দ্বিখণ্ডন” বর্ণনাটি একটি ধর্মীয় মিথ বা লোককথা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই বেশি যৌক্তিক; এটি বাস্তব জ্যোতির্বিদ্যাগত ঘটনা হলে ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড, চাঁদের গঠন, পৃথিবীর জলবায়ু ইতিহাস এবং বহুসংখ্যক সভ্যতার পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক নথি—সব কিছুর সঙ্গেই তা স্থূলভাবে সংঘর্ষ সৃষ্টি করত, যা আমরা কোথাও দেখতে পাই না।


উপসংহার

চাঁদ দ্বিখণ্ডনের ধারণাটি ইসলামী সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হলেও, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব, সমুদ্রবিজ্ঞান, সিসমোলজি এবং ইতিহাসবিদ্যার কোনো ক্ষেত্রেই এর বাস্তবতার সামান্য ইঙ্গিতও পাওয়া যায় না। যদি চাঁদ সত্যিই কখনো দুই ভাগ হয়ে যেত, তবে পৃথিবী–চাঁদ সিস্টেমের স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ত, জোয়ার–ভাটার বিপর্যয়কর পরিবর্তন ঘটত, বিশ্বের প্রতিটি উপকূলীয় অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসত, এবং চাঁদের গঠন ও পৃষ্ঠতলে সেই বিভাজনের স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক চিহ্ন আজও বিদ্যমান থাকত। Apollo মিশনের সিসমিক ডেটা, লুনার রিকনেসান্স অরবিটারের ভূ-টপোগ্রাফি, এবং চন্দ্রশিলার আইসোটোপিক বিশ্লেষণে এমন কোনো প্রমাণ অনুপস্থিত।

এছাড়া সপ্তম শতাব্দীতে রোমান, বাইজান্টাইন, পারস্য, ভারতীয় ও চীনা সভ্যতাগুলো নিয়মিতভাবে জ্যোতির্বিদ্যাগত তথ্য সংরক্ষণ করত। সূক্ষ্মতম গ্রহন, ধূমকেতু, নোভা—সবই তারা নথিবদ্ধ করেছে; কিন্তু “চাঁদ দুই ভাগ” হওয়ার মতো চোখে পড়ার মতো, বৈশ্বিক ও অভূতপূর্ব কোনো ঘটনাই তাদের রেকর্ডে নেই। বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক নথিপত্রের এই নীরবতা নির্দেশ করে যে ঘটনাটি প্রকৃত ঘটনা নয়, বরং একটি ধর্মীয় অলৌকিকতা বা রূপকথার গল্প, যার সাথে বাস্তব জগতের ভৌত নিয়ম বা মহাজাগতিক ইতিহাসের কোনো সঙ্গতি নেই।

অতএব, উপসংহারে বলা যায়—“চাঁদের দ্বিখণ্ডন” বৈজ্ঞানিক, ভূতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দাঁড়াতে পারে না। এটি পৃথিবী–চাঁদ সিস্টেমের যেকোনো পর্যবেক্ষণযোগ্য তথ্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আধুনিক গবেষণা স্পষ্ট দেখায়: চাঁদের ইতিহাস শান্ত, দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল ভৌত প্রক্রিয়ার ফল; কোনো হঠাৎ ভাঙন বা অলৌকিক পুনঃসংযুক্তির নয়।



তথ্যসূত্রঃ
  1. কোরআন ৫৪ঃ১ ↩︎
  2. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৮১৫ ↩︎
  3. সহিহ মুসলিম, ইসলামিক সেন্টার, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬০ ↩︎
  4. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হুসাইন আল-মাদানী প্রকাশনী, হাদিস নম্বরঃ ৩২৮৯ ↩︎
  5. সহীহ আত তিরমিযী, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানীর তাহকীককৃত, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২ ↩︎
  6. সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী), হাদিস নম্বরঃ ৬৯৬৬ ↩︎
  7. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৮১৯ ↩︎
  8. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৮১৮ ↩︎
  9. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৩৭৭ ↩︎
  10. নসরুল বারী, শরহে সহিহ বুখারী, নবম খণ্ড, শিবলী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৬২০ ↩︎
  11. আশ-শিফা, প্রথম খণ্ড, সনজরী পাবলিকেশন্স, ইমাম কাযী আয়ায আন্দুলুসী, পৃষ্ঠা ৫৮৯, ৫৯০ ↩︎
  12. Bills, B. G., & Ray, R. D. (1999). Lunar Tidal Dissipation in the Earth–Moon System. ↩︎
  13. Matsuyama, I. et al. (2016). Tidal Dynamics and Rotational Instabilities. ↩︎
  14. Melosh, H. J. (1989). Impact Cratering: A Geologic Process. Oxford University Press. ↩︎
  15. Alvarez, L. W. et al. (1980). Extraterrestrial Cause for the Cretaceous–Tertiary Extinction. ↩︎
  16. Zachos, J. et al. (2001). Climate and Carbon Cycle Variations Over the Cenozoic. ↩︎
  17. Needham, J. (1959). Science and Civilisation in China. ↩︎
  18. NASA: Tides & Sea Level, Lunar Reconnaissance Orbiter (LRO), Eclipse & Lunar Anomaly Catalogs. ↩︎