প্রতিটি প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি?

ভূমিকা

কোরআনের “জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি” প্রসঙ্গকে ইসলামী সাহিত্য ও সমকালীন এপোলজেটিক্সে প্রায়ই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। একদিকে ক্লাসিক্যাল তাফসীরকারেরা এই আয়াতগুলোকে সাধারণত নারী–পুরুষ, উদ্ভিদ–প্রাণী ও অন্যান্য সৃষ্টির দ্বৈত কাঠামোর ভাষ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন; অন্যদিকে আধুনিক অনেক দাঈ ও লেখক এই দ্বৈততাকে ম্যাটার–এন্টিম্যাটার বা সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে “অলৌকিক” পূর্বজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। ফলত, একটি ধর্মীয় ভাষ্য কীভাবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত দাবিতে রূপান্তরিত হয়—এই প্রশ্নটি সমালোচনামূলক আলোচনার দাবি রাখে।

এই প্রবন্ধে মূলত দুইটি বিষয় পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রথমত, ক্লাসিক্যাল তাফসীরগ্রন্থ—যেমন তাফসীরে জালালাইন ও ইবনে কাসীর—এই আয়াতগুলোর অর্থ নির্ধারণের সময় ঠিক কী ধরনের “জোড়া” ধারণা সামনে এনেছে, তা পাঠ-ভিত্তিকভাবে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক জীববিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের আলোকে “প্রত্যেক বস্তু” বা “প্রত্যেক প্রাণী”কে কেবল পুরুষ–নারী বা দ্বৈত-যুগলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেখা আদৌ বাস্তবসম্মত কি না, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, চীনা ইন–ইয়াং ন্যায় প্রাচীন দ্বৈত দর্শনের ইতিহাস টেনে দেখানো হয়েছে যে “সকল কিছু জোড়ায় গঠিত”—এই ধারণা ইসলামের বহু আগে থেকেই নানা সংস্কৃতিতে বিদ্যমান ছিল। ফলে কোরআনিক এই ভাষ্যকে কতটা “অদ্বিতীয়” বা “বৈজ্ঞানিক মুজিজা” হিসেবে দেখা যায়, তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।


কোরআনের আয়াত

কোরআনের একাধিক আয়াতে দাবি করা হয়েছে যে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীকে স্রষ্টা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন; অর্থাৎ সৃষ্টিজগত নাকি মূলত দ্বৈত বিন্যাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। ক্লাসিক্যাল তাফসীরগুলোতে এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে বলা হয়, প্রতিটি প্রাণীকে আল্লাহ নারী ও পুরুষ—এই দুই লিঙ্গের যুগল আকারে সৃষ্টি করেছেন। ফলে ‘জোড়া’ ধারণাটি সেখানে শুধু সংখ্যাগত দুই নয়, বরং পুরুষ–নারী বা পরস্পর পরিপূরক বিপরীত সঙ্গী বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে। [1] [2] [3]

পূত পবিত্র সেই সত্তা যিনি জোড়া সৃষ্টি করেছেন প্রত্যেকটির যা উৎপন্ন করে যমীন, আর তাদের নিজেদের ভিতরেও আর সে সবেও যা তারা জানে না।
— Taisirul Quran
পবিত্র মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানেনা তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।
— Sheikh Mujibur Rahman
পবিত্র ও মহান সে সত্তা যিনি সকল জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যমীন যা উৎপন্ন করেছে তা থেকে, মানুষের নিজদের মধ্য থেকে এবং সে সব কিছু থেকেও যা তারা জানে না ।
— Rawai Al-bayan
পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন সকল প্রকার সৃষ্টি, যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ এবং তাদের (মানুষদের) মধ্য থেকেও (পুরুষ ও নারী)। আর তারা যা জানে না তা থেকেও [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

আমি প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।
— Taisirul Quran
আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর প্রত্যেক বস্তু থেকে আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আশা করা যায়, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।
— Rawai Al-bayan
আর প্রত্যেক বস্তু আমরা সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় [১], যাতে তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ কর।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তিনি সব কিছুকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, আর তোমাদের জন্য নৌযান ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরোহণ কর,
— Taisirul Quran
এবং যিনি যুগলসমূহের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেন এমন নৌযান ও চতুস্পদ জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর –
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যিনি সব কিছুই জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্য নৌযান ও গৃহপালিত জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আরোহণ কর,
— Rawai Al-bayan
আর যিনি সকল প্রকারের জোড়া যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এমন নৌযান ও গৃহপালিত জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

অনেক ইসলামিক এপোলজিস্ট বা সমকালীন দাঈ এই আয়াতগুলোর সমালোচনা এড়াতে যুক্তি দেন যে এখানে ‘জোড়ায় জোড়ায়’ বলাতে আসলে নারী-পুরুষ বোঝানো হয়নি, বরং শুধু ‘দুটি’ বা ‘যুগল’—এমন একটি বিমূর্ত গাণিতিক ধারণা বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও সেগুলোর তাফসীরের আলোকে দেখা যায়, এই ব্যাখ্যা টিকিয়ে রাখা কঠিন। ‘জোড়া’ ধারণাটি সেখানে স্পষ্টভাবেই নারী-পুরুষ যুগল কিংবা দুটো পরস্পর বিপরীত অথচ পরিপূরক সত্তাকে ইঙ্গিত করে। এর সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় অন্য আয়াতগুলোতে, যেখানে জোড়া সৃষ্টি প্রসঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় ‘পুরুষ ও নারী’র উল্লেখ রয়েছে। [4] [5]

আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন জোড়া- পুরুষ আর নারী,
— Taisirul Quran
আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী –
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তিনিই যুগল সৃষ্টি করেন- পুরুষ ও নারী।
— Rawai Al-bayan
আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল—পুরুষ ও নারী
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

অতঃপর তা থেকে তিনি সৃষ্টি করলেন জুড়ি- পুরুষ ও নারী।
— Taisirul Quran
অতঃপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর ও নারী।
— Sheikh Mujibur Rahman
অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী।
— Rawai Al-bayan
অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন যুগল— নর ও নারী।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

অতএব ক্লাসিক্যাল ইসলামি ব্যাখ্যার আলোকে ‘প্রত্যেক বস্তু’কে জোড়ায় সৃষ্টি করার দাবি মূলত নারী-পুরুষ কিংবা অনুরূপ দ্বৈত–সঙ্গী ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে।


তাফসীরে জালালাইন

এখন দেখা দরকার, ক্লাসিক্যাল তাফসীরগ্রন্থগুলোতে এ বক্তব্য কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথমে দেখা যাক তাফসীরে জালালাইন কী বলছে [6]

জোড়া
জোড়া 1

তাফসীরে ইবনে কাসীর

এরপর একই বিষয়ে ইবনে কাসীর কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা দেখা যেতে পারে। তিনিও মূলত উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দ্বৈততার প্রসঙ্গ টেনে আয়াতটির অর্থ নির্ধারণ করেছেন [7]

জোড়া 3

আধুনিক জীববিজ্ঞান

এবার জীববিজ্ঞানের প্রাথমিক তথ্যের সাথে এই ধর্মীয় দাবির তুলনা করলে গভীর অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে। জীববিজ্ঞানে সুপরিচিত একটি ধারণা হলো পারথেনোজেনেসিস (parthenogenesis)। অপুংজনি বা পারথেনোজেনেসিস হলো অযৌন প্রজননের একটি প্রাকৃতিক রূপ, যেখানে গর্ভাধান ছাড়াই কোনো অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে সরাসরি ভ্রূণের বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ এখানে কোনো পুরুষ গ্যামেটের অংশগ্রহণ নেই। নিচের ছবিতে যে প্রাণীটিকে দেখা যাচ্ছে, সেটি অযৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে এবং এ প্রজাতির সদস্য সবাই স্ত্রীলিঙ্গ; অর্থাৎ এই প্রজাতিতে কোনো পুরুষ জন্মায় না [8]

জোড়া 5
The asexual, all-female whiptail species Aspidoscelis neomexicanus (center), which reproduces via parthenogenesis

এ ধরনের একক-লিঙ্গ বা অযৌন প্রজননের উদাহরণ আরও বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। অপুংজনি বা অযৌন জন্মদায়ক জীবের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় হাইড্রা, বিভিন্ন নিম্নতর উদ্ভিদ (যেমন ফার্ন), এবং নানা ধরনের অণুজীবকে। হাইড্রা, জেলিফিশসহ অনেক জীব আবার অনুকূল অবস্থায় যৌন প্রজননেও সক্ষম; তবে অনেক সাধারণ জীব যেমন—ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট ও অধিকাংশ ছত্রাকের ক্ষেত্রে জীবনের পুরো চক্রই কার্যত অযৌন প্রজননের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদ খণ্ডন, কুঁড়ি গঠন ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের পুরো দেহ থেকেই নতুন জীব গঠন করতে পারে—যা পুনরুৎপাদনের বিশেষ ধরণ; উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় তারা মাছ, পলিপ, জেব্রাফিশ, কিছু গোধা ও স্যালামান্ডারকে। প্রাণীজগতে সাধারণ নিয়ম হলো: গঠন যত সরল, অযৌন পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা তত বেশি; জটিল, বিশেষ করে মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রে এ সামর্থ্য খুব সীমিত বা অনুপস্থিত।

উদ্ভিদবিজ্ঞানে একই ধরনের বাস্তবতা দেখা যায়। যারা উদ্ভিদবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন, তারা স্ব-পরাগায়ন ধারণার সাথে পরিচিত। কোনো ফুলের পরাগরেণু যখন একই ফুলের কিংবা একই উদ্ভিদের অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তরিত হয়, তখন তাকে স্ব-পরাগায়ন বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়—সরিষা, ধুতুরা, সন্ধ্যামালতী, শিম, টমেটো ইত্যাদি উদ্ভিদকে। স্ব-পরাগায়নের ফলে উৎপন্ন বীজ থেকে যে নতুন উদ্ভিদ গড়ে ওঠে, তার বৈশিষ্ট্য সাধারণত মাতৃউদ্ভিদের প্রায় হুবহু অনুরূপ হয়। এ ধরনের বহু উদ্ভিদে একই শরীরে পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ উপস্থিত থাকে; ফলে এখানে পৃথক পুরুষ-নারী গাছের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

ছত্রাক জগতে বিষয়টি আরও বহুমাত্রিক। সিজোফিলাম কমিউন পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছত্রাকগুলোর একটি, যা এন্টার্কটিকা বাদে সব মহাদেশেই দেখা যায়। এ প্রজাতির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ২৮ হাজারেরও বেশি পৃথক ‘লিঙ্গ-টাইপ’ শনাক্ত করা হয়েছে; অর্থাৎ এখানে মাত্র দু’টি লিঙ্গের বদলে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গীতা-ধরন কাজ করে [9]


চীনা ইন ইয়াং দ্বৈত ধারনা

জোড়া 7

সমসাময়িক ইসলামিক এপোলজিস্টদের একটি বহুল প্রচলিত দাবী হলো, কোরআনের ‘জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি’ সংক্রান্ত আয়াতগুলো আসলে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ম্যাটার–এন্টিম্যাটার ধারণাকে ইঙ্গিত করে। তাদের যুক্তি, সপ্তম শতাব্দীর আরব সমাজে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক ধারণা কারও জানার কথা নয়; অতএব এ আয়াতগুলো নাকি অলৌকিক পূর্বজ্ঞানের প্রমাণ। কিন্তু দ্বৈততা বা জোড়ার ধারণা মানবচিন্তায় অত্যন্ত প্রাচীন, এবং শুধুই পুরুষ–নারী নয়, বরং বিশ্ববিন্যাসের মৌলিক নীতি হিসেবে ‘বিপরীত কিন্তু পরস্পর নির্ভরশীল জোড়া’—এই ধারণা বহু সংস্কৃতিতে বহু আগে থেকেই বিদ্যমান।

প্রাচীন চীনা দর্শনে ‘ইন’ ও ‘ইয়াং’ (Yin–Yang) নামেই সৃষ্টির এই দ্বৈত নীতি সুপরিচিত; এটি তাওবাদী বিশ্বদর্শনের কেন্দ্রীয় উপাদান। আলো–অন্ধকার, উষ্ণ–শীতল, পুরুষ–নারী, সক্রিয়–নিষ্ক্রিয়—এভাবে প্রায় সব কিছুকেই সেখানে যুগল বিপরীতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা হয়, ইন-ইয়াং চিহ্ন ও ধারণা খ্রিষ্টপূর্ব কমপক্ষে পঞ্চম শতাব্দী থেকে প্রচলিত ছিল এবং সাং রাজবংশের যুগে ব্রোঞ্জ নির্মিত বস্তুতেও এর উপস্থিতি দেখা যায়; তবে ধারণাটির শিকড় এরও আগে প্রসারিত [10]

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯৮ সাল থেকে ২৫৯৮ সাল পর্যন্ত শাসন করা এবং হান চীনাদের পূর্বপুরুষ লিজেন্ডারি চীনা সম্রাট বলেছেন, ‘ইং এবং ইয়াং এর নীতি পুরো মহাবিশ্বের মূল। এটি প্রত্যেক সৃষ্টির অধীন। এটি অভিভাবকত্বের অগ্রগতি নিয়ে আসে। এটি জীবন এবং মৃত্যুর মূল ও উৎস।

ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ‘দ্বৈত নীতি’ বা ‘সকল কিছু জোড়ায় গঠিত’—এই ধরনের চিন্তা ইসলামি গ্রন্থের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও দর্শনে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং এই ধারণার ক্ষেত্রে নতুন বা একমাত্রিক কৃতিত্ব দাবী করলে তা ইতিহাসসম্মত হয় না। যদি ‘জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি’ ধারণাটির জন্য কারও কাছে ক্রেডিট দিতে হয়, তাহলে যুক্তিসঙ্গতভাবে তা প্রাচীন চীনা ও অন্যান্য পূর্ববর্তী ধারনার দিকেই যাবে; আল্লাহ বা মুহাম্মদকে এ ধারণার মৌলিক উৎস বলা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।


উপসংহার

উপরের আলোচনায় প্রথমে দেখা গেল, ক্লাসিক্যাল তাফসীরকারেরা “জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি” ধারণাকে মূলত উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের নারী–পুরুষ দ্বৈততার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ এখানে ‘জোড়া’ বলতে শুধুই বিমূর্ত “দুটি” বোঝানো হয়নি; বরং স্পষ্টভাবে লিঙ্গ-ভিত্তিক যুগল বা একে অপরের পরিপূরক বিপরীত সত্তা বোঝানো হয়েছে। পরবর্তীকালে আধুনিক এপোলজেটিক্স এই ভাষ্যকে কখনো জীববিজ্ঞানের সাধারণ দ্বৈততা, কখনো আবার ম্যাটার–এন্টিম্যাটারের মত জটিল পদার্থবিজ্ঞানীয় ধারণার সঙ্গে জুড়ে “বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান” দাবিতে পরিণত করেছে—যা ঐতিহাসিক পাঠের সঙ্গে খুব সহজে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

অন্যদিকে, জীববিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের তথ্য দেখায় যে “প্রত্যেক সৃষ্টি”কে সরলভাবে পুরুষ–নারী বা দ্বৈত-যুগলের কাঠামোর মধ্যে বন্দি করা বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। পারথেনোজেনেসিস, স্ব-পরাগায়ন, বহুলিঙ্গীয় ছত্রাক-প্রজাতি বা অযৌন প্রজননের বিভিন্ন ধরন—সবই প্রমাণ করে যে প্রকৃতিতে লিঙ্গ ও প্রজননব্যবস্থা অত্যন্ত বহুবিধ এবং বহু ক্ষেত্রে “পুরুষ–নারী জোড়া” ধারণা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। অতএব “সবকিছুকে জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে”—এই ধরনের সর্বজনীন দাবিকে প্রকৃতিবিদ্যার মানদণ্ডে তথ্যগতভাবে সঠিক বলা কঠিন।

শেষত, দ্বৈত নীতির ধারণা কেবল কোরআনিক আয়াতে সীমাবদ্ধ নয়; চীনা ইন–ইয়াং মতবাদসহ প্রাচীন বিশ্বের নানা দর্শনেই “বিপরীত কিন্তু পরস্পর নির্ভরশীল জোড়া” ধারণাটি গভীরভাবে বিকশিত হয়েছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে “জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি” ধারণাটিকে অনন্য, অদ্বিতীয় বা অলৌকিক বলে দাবি করলে তা ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান—এই তিন ক্ষেত্রেরই প্রমাণের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। বরং এসব তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে যে সিদ্ধান্তে আসা যায়, তা হলো—এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয়-দার্শনিক ভাষ্য, যার সীমাবদ্ধতা ও প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে হলে সেটিকে সমকালীন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তুলনায় সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করাই বেশি বোধগম্য পদ্ধতি।



তথ্যসূত্রঃ
  1. সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৩৬ ↩︎
  2. সূরা যারিয়াত, আয়াত ৪৯ ↩︎
  3. সূরা যুখরুফ, আয়াত ১২ ↩︎
  4. সূরা নজম, আয়াত ৪৫ ↩︎
  5. সূরা আল কিয়ামাহ, আয়াত ৩৯ ↩︎
  6. তাফসীরে জালালাইন, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৬-৩৩৯ ↩︎
  7. তাফসীরে ইবনে কাসীর, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৫ ↩︎
  8. New Mexico whiptail ↩︎
  9. Prof. Tom Volk, “Schizophyllum commune, the split gill fungus“, University of Wisconsin, February 2000. ↩︎
  10. Ray Wood, “Yin and Yang“, Taichido, accessed February 14, 2011 ↩︎