কোরআনে দুইটি আয়াতে বলা হয়েছে, প্রতিটি বস্তু এবং প্রাণীকে আল্লাহ জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতের ব্যাখ্যাতে ক্লাসিক্যাল তাফসীরগুলোতে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে, প্রতিটি প্রাণীকে নাকি আল্লাহ নারী ও পুরুষ এরকম জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। [1] [2] [3]
পূত পবিত্র সেই সত্তা যিনি জোড়া সৃষ্টি করেছেন প্রত্যেকটির যা উৎপন্ন করে যমীন, আর তাদের নিজেদের ভিতরেও আর সে সবেও যা তারা জানে না।
— Taisirul Quran
পবিত্র মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানেনা তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।
— Sheikh Mujibur Rahman
পবিত্র ও মহান সে সত্তা যিনি সকল জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যমীন যা উৎপন্ন করেছে তা থেকে, মানুষের নিজদের মধ্য থেকে এবং সে সব কিছু থেকেও যা তারা জানে না ।
— Rawai Al-bayan
পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন সকল প্রকার সৃষ্টি, যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ এবং তাদের (মানুষদের) মধ্য থেকেও (পুরুষ ও নারী)। আর তারা যা জানে না তা থেকেও [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আমি প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।
— Taisirul Quran
আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর প্রত্যেক বস্তু থেকে আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আশা করা যায়, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।
— Rawai Al-bayan
আর প্রত্যেক বস্তু আমরা সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় [১], যাতে তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ কর।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তিনি সব কিছুকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, আর তোমাদের জন্য নৌযান ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরোহণ কর,
— Taisirul Quran
এবং যিনি যুগলসমূহের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেন এমন নৌযান ও চতুস্পদ জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর –
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যিনি সব কিছুই জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্য নৌযান ও গৃহপালিত জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আরোহণ কর,
— Rawai Al-bayan
আর যিনি সকল প্রকারের জোড়া যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এমন নৌযান ও গৃহপালিত জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
অনেক ইসলামিক এপোলজিস্ট আবার নিজের মনকে বুঝ দেন এভাবে যে, এসকল আয়াতে ‘জোড়ায় জোড়ায়’ বলতে নারী ও পুরুষ জোড়া বুঝানো হয়নি, বরং কেবল ‘দুটো’ বুঝানো হয়েছে। এমন ধারনা যে একেবারেই ভুল এবং কোরআনে ‘জোড়ায় জোড়ায়’ বলতে যে নারী পুরুষ জোড়া বা বিপরীত বস্তুদ্বয় বুঝানো হয়েছে যা একে অপরের পূরক তার প্রমাণ আমরা কোরআন থেকেই পাই [4] [5]
আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন জোড়া- পুরুষ আর নারী,
— Taisirul Quran
আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী –
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তিনিই যুগল সৃষ্টি করেন- পুরুষ ও নারী।
— Rawai Al-bayan
আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল—পুরুষ ও নারী
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
অতঃপর তা থেকে তিনি সৃষ্টি করলেন জুড়ি- পুরুষ ও নারী।
— Taisirul Quran
অতঃপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর ও নারী।
— Sheikh Mujibur Rahman
অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী।
— Rawai Al-bayan
অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন যুগল— নর ও নারী।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আসুন এই বিষয়ে তাফসীরগুলো পড়ে দেখা যাক। প্রথমেই তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ি [6] –
এবারে আসুন তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে পড়ি [7] –
জীববিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান যাদের রয়েছে, তারা নিশ্চয়ই পারথেনোজেনেসিস শব্দটি শুনেছেন। অপুংজনি বা পারথেনোজেনেসিস হলো অযৌন প্রজননের একটি প্রাকৃতিক রূপ যাতে গর্ভাধান ছাড়াই ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং বিকাশ ঘটে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে পার্থেনোজেনেসিস অর্থ হলো একটি অনিষিক্ত ভ্রুণকোষ থেকে ভ্রূণের বিকাশ হওয়া। নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন, নিচের ছবির প্রাণীটি অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তার করে, যারা সকলেই নারী। মাঝখানের ছবির প্রাণীটি একটি অল ফিমেল প্রাণী, অর্থাৎ এই প্রাণীটির শুধুমাত্র নারীই হয়, পুরুষ হয় না [8]।
এরকম আরও প্রাণী রয়েছে। অযৌন জন্মদায়ক জীবের অন্যান্য উদাহরণ হলো হাইড্রা, অনেক নিম্নতর উদ্ভিদ (যেমন, ফার্ন) (বিঃদ্রঃ হাইড্রা এবং জেলিফিশ এবং আরও অনেক অযৌন জীব যৌন জননের সামর্থ্য রাখে। তবে অনেক সাধারণ জীব যেমন : ব্যাকটেরিয়া, ইষ্ট এবং ছত্রাক একেবারেই অযৌন)। কিছু জীব পুনরুৎপাদন করতে সামর্থ্য রাখে যা একটি বিশেষ ধরণের অযৌন জনন, যেমন : তারা মাছ, পলিপ, জেব্রাফিশ, গোধা এবং স্যালামান্ডার। অনেক উদ্ভিদ পুরো পুনরুৎপাদন করতে সামর্থ্য রাখে। প্রাণীদের মধ্যে প্রাণীর গঠন যতো নিম্নতর হবে পুরো পুনরুৎপাদন করতে ততো সমর্থ হবে। কোনো মেরুদন্ডী প্রাণীর এ সামর্থ্য নেই।
একইসাথে, যারা উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়েছেন, তারা স্ব-পরাগায়ন কাকে বলে নিশ্চয়ই জানেন। কোন ফুলের পরাগরেণু সেই একই ফুলের অথবা সেই একই উদ্ভিদের অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তরিত হলে তাকে স্ব-পরাগায়ন বলে। উদাহরণ- সরিষা, ধুতুরা, সন্ধ্যামালতী, শিম, টমেটো ইত্যাদি। স্ব-পরাগায়নে জন্মলাভ করা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য মাতৃ-উদ্ভিদের হুবহু অনুরূপ হয়। স্ব-পরাগায়ন এসব উদ্ভিদের একই শরীরে নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। তাই আলাদা করে নারী পুরুষ বিভাজন থাকে না। সিজোফিলাম কমিউন পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছত্রাক, যা এন্টার্কটিকা বাদে সকল মহাদেশে দেখা যায়। এটির ২৮ হাজারেরও বেশি স্বতন্ত্র লিঙ্গ রয়েছে [9]
চীনা ইন ইয়াং দ্বৈত ধারনা
ইসলামিক এপোলোজিস্টগণ এটি দাবী করেন যে, কোরআনের ‘জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি’ বিষয়ক আয়াতসমূহ আসলে ম্যাটার এন্টিম্যাটারকে নির্দেশ করে। তারা বলেন, এন্টিম্যাটারের অস্তিত্ব কোরআনের ‘জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি’ বিষয়ক আয়াত সমূহ অলৌকিক প্রমাণ করে। কেননা সপ্তম শতাব্দীর একজন সাধারণ মানুষ ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটারের ব্যাপারে কিভাবে জানবে? অথচ প্রাচীন চীনাগণ মুহাম্মদের বহু আগে থেকেই সৃষ্টির দ্বৈত ধারনায় বিশ্বাস করতেন। এই দ্বৈত নীতি ‘ইন এবং ইয়াং’ নামে পরিচিত, যা তাওবাদী বিশ্বাস ব্যবস্থার অংশ। যাইহোক, সকল যুক্তিসঙ্গত নির্ণয় নির্দেশ করে যে এসব ইসলামের ২৫০০ বছর আগেই প্রচলিত ছিল। উল্লেখ্য, ইন ইয়াং চিহ্ন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালের আগে প্রচলিত ছিলো এবং সাং রাজবংশ ব্রোঞ্জে অস্তিত্বশীল ছিলো, তবে ইন ইয়াং নীতি আরও অনেক আগে প্রচলিত ছিলো। [10]
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯৮ সাল থেকে ২৫৯৮ সাল পর্যন্ত শাসন করা এবং হান চীনাদের পূর্বপুরুষ লিজেন্ডারি চীনা সম্রাট বলেছেন, ‘ইং এবং ইয়াং এর নীতি পুরো মহাবিশ্বের মূল। এটি প্রত্যেক সৃষ্টির অধীন। এটি অভিভাবকত্বের অগ্রগতি নিয়ে আসে। এটি জীবন এবং মৃত্যুর মূল ও উৎস।
তাই এই বিষয়ে যদি সত্যিই কাউকে ক্রেডিট দিতে হয়, সেই ক্রেডিট চীনাগণ নিয়ে যাবেন। আল্লাহ পাবেন না। কারণ আল্লাহ বা মুহাম্মদ বলার বহু আগেই এসব কথা মানুষ জানতো।
তথ্যসূত্র
- সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৩৬ [↑]
- সূরা যারিয়াত, আয়াত ৪৯ [↑]
- সূরা যুখরুফ, আয়াত ১২ [↑]
- সূরা নজম, আয়াত ৪৫ [↑]
- সূরা আল কিয়ামাহ, আয়াত ৩৯ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৬-৩৩৯ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৫ [↑]
- New Mexico whiptail [↑]
- Prof. Tom Volk, “Schizophyllum commune, the split gill fungus“, University of Wisconsin, February 2000. [↑]
- Ray Wood, “Yin and Yang“, Taichido, accessed February 14, 2011 [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"