নবী মুহাম্মদ মক্কা অভিযানের সময় ১৪০০ থেকে ১৫০০ সৈন্য নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু মক্কাবাসীরা তাদের প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। আলোচনার উদ্দেশ্যে নবী উসমানকে মক্কার নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠান। এ সময় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, উসমানকে হত্যা করা হয়েছে। নবী মুহাম্মদ এই খবরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং সকল সাহাবির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করেন যে, উসমানের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে তারা ফিরবেন না। নবী নিজেও এই প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ করেন এবং উপস্থিত সবাইকে এতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সাহাবিরা নবীর হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেন, যার নাম ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’। এ সময়ে আল্লাহ একটি আয়াত নাজিল করেন যেখানে বলা হয়, “যারা তোমার সাথে শপথ করছে, তারা মূলত আল্লাহর সাথে শপথ করছে; আল্লাহর হাত তাদের সকলের হাতের ওপরে।” আসুন আয়াতটি পড়ে দেখি, [1]
যারা তোমার কাছে বাই‘আত (অর্থাৎ আনুগত্য করার শপথ) করে আসলে তারা আল্লাহর কাছে বাই‘আত করে। তাদের হাতের উপর আছে আল্লাহর হাত। এক্ষণে যে এ ও‘য়াদা ভঙ্গ করে, এ ও‘য়াদা ভঙ্গের কুফল তার নিজেরই উপর পড়বে। আর যে ও‘য়াদা পূর্ণ করবে- যা সে আল্লাহর সঙ্গে করেছে- তিনি অচিরেই তাকে মহা পুরস্কার দান করবেন।
— Taisirul Quran
যারা তোমার বাইআত গ্রহণ করে তারাতো আল্লাহরই বাইআত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। সুতরাং যে ওটা ভঙ্গ করে, ওটা ভঙ্গ করার পরিনাম তারই এবং যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি তাকে মহা পুরস্কার দেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যারা তোমার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর; অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই উপর। আর যে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় যারা আপনার কাছে বাই’আত করে [১] তারা তো আল্লাহরই হাতে বাই’আত করে। আল্লাহর হাত [২] তাদের হাতের উপর [৩]। তারপর যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম বর্তাবে তারই উপর এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে তিনি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
কিন্তু এরপর মক্কা থেকে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় উসমান ফিরে এলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায় এবং মুসলিমরা শান্ত হয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে, আল্লাহ কি জানতেন না যে, উসমান বেঁচে আছেন এবং তার কিছুই হয়নি? আল্লাহ সবকিছু জানেন বলে বিশ্বাস করা হয়, তাহলে কেন তিনি গুজবের ভিত্তিতে উসমান হত্যার প্রতিশোধের শপথ নিলেন? সেই বায়াতে নাকি আল্লাহও হাত রেখে শপথ নিয়েছিলেন! যদি আল্লাহ সবজান্তা হন, তাহলে তিনি কেন নবীকে জানিয়ে দিলেন না যে উসমান জীবিত আছেন? বরং আল্লাহ নিজেও সাহাবিদের শপথে যোগদান করেন, যা তার সর্বজ্ঞ চরিত্রের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই ঘটনাটি স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় যে, আল্লাহ সেই মুহূর্তে এতটুকুই জানতেন, যতটুকু নবী মুহাম্মদ জানতেন। আল্লাহর ভূমিকা শুধুমাত্র নবীর বোধবুদ্ধি, জ্ঞান ও অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে, যা আল্লাহকে ঐশ্বরিক ও সার্বিক সর্বজ্ঞতার দাবী থেকে খারিজ করে দেয়। এ ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, ঐ সময়ের সিদ্ধান্তগুলো নবী এবং আল্লাহর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই গৃহীত হয়েছিল। আসুন একটি ওয়াজ শুনি,
এবারে আসুন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম আবু বকর যাকারিয়া, যার তাফসীর সৌদি সরকার দ্বারা স্বীকৃত, তার তাফসীর গ্রন্থ থেকে এই বিষয়ের ব্যাখ্যাটি দেখে নিই, [2]
আসুন এবারে তাফসীরে মাযহারী থেকেও উপরের আয়াতের তাফসীর পড়ে দেখি, [3]
এবারে আসুন তাফসীরে জালালাইনে সূরা ফাতহ এর ১৮ নম্বর আয়াতটির ব্যাখ্যা পড়ে নিই, [4]
আসুন এবারে একটি সহীহ হাদিস পড়ি, যেখান থেকে বোঝা যাবে, এই বায়াতটি ছিল উসমান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার বায়াত [5]
সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৪৬/ রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তার সাহাবীগণের মর্যাদা
পরিচ্ছেদঃ ১৯. ‘উসমান ইবনু আফফান (রাযিঃ)-এর মর্যাদা।
৩৭০৬। উসমান ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু মাওহিব (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এক মিসরবাসী বাইতুল্লাহর হাজ্জ আদায় করে। সে একদল লোককে বসা দেখে বলে, এরা কারা? লোকেরা বলল, এরা কুরাইশ বংশীয়। সে পুনরায় বলে, এই বয়স্ক (শায়খ) লোকটি কে? লোকেরা বলল, ইবনু উমর (রাযিঃ)। সে সময় সে তার নিকটে এসে বলল, আপনাকে আমি কয়েকটি বিষয় প্রশ্ন করব। অতএব আপনি আমাকে (তা) বলুন।
আমি এ বাইতুল্লাহর মর্যাদার শপথ দিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি কি অবহিত আছেন যে, উসমান (রাযিঃ) উহুদ যুদ্ধের দিন (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) পলায়ন করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সে আবার বলল, আপনি কি জানেন, তিনি (হুদাইবিয়ায় অনুষ্ঠিত) বাই’আতুর রিযওয়ানে অনুপস্থিত ছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সে পুনরায়ও বলল, আপনি কি অবহিত আছেন যে, তিনি বদরের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন এবং তাতে উপস্থিত হননি? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
সে বলল, আল্লাহু আকবার। তারপর ইবনু উমার (রাযিঃ) তাকে বললেন, এবার এসো। যেসব বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছ তা তোমাকে আমি সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেই।
উহুদের দিন তার পলায়নের ঘটনা প্রসঙ্গে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তার ঐ ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন, সম্পূর্ণভাবে মাফ করেছেন। তারপর বদরের যুদ্ধে তার অনুপস্থিতির কারণ এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেয়ে (রুকাইয়াহ্) তার সহধর্মিণী ছিলেন (এবং সে সময় তিনি মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ যে লোক বদরের যুদ্ধে যোগদান করেছে তার সমপরিমাণ সাওয়াব ও গানীমাত তুমি পাবে। আর তিনি রুকাইয়ার দেখাশুনা করার জন্য তাকে মদীনাতে থাকারই নির্দেশ দিলেন। আর বাই’আতে রিদওয়ানে তার অনুপস্থিতির কারণ এই যে, মক্কাবাসীদের কাছে উসমান (রাযিঃ)-এর চাইতে বেশি মর্যাদাবান কোন মুসলিম লোক (হুদাইবিয়ায়) উপস্থিত থাকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তার পরিবর্তে) তাকেই প্রেরণ করতেন। তা না থাকাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান (রাযিঃ)-কেই (মক্কায়) প্রেরণ করলেন। আর উসমান (রাযিঃ)-এর মক্কার অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর বাই’আতুর রিযওয়ান অনুষ্ঠিত হয়।
বর্ণনাকারী বলেন, (বাই’আত অনুষ্ঠানকালে)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ডান হাতের দিকে ইশারা করে বললেনঃ এটা উসমানের হাত। তারপর তিনি ঐ হাতটি তার অন্য হাতের উপর স্থাপন করে বললেনঃ এটি উসমানের (বাই’আত) তারপর ইবনু উমার (রাযিঃ) লোকটিকে বললেন, এবার তুমি এ ব্যাখ্যা সঙ্গে নিয়ে যাও।
সহীহঃ বুখারী (৯৬৯৮)।
আবূ ঈসা বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উসমান ইবনু মাওহাব (রহঃ)
পাঠকের কাছে নিবেদন, উপরের পুরো বর্ণনাগুলো খুব ভালভাবে পড়ুন এবং ঘটনাক্রমটি নিজের মনে কল্পনা করুন। আল্লাহ কেন সেইদিন গুজবের ভিত্তিতে ভুল শপথ গ্রহণ করলেন? কেন নবীকে সত্য জানিয়ে ওহী পাঠালেন না। কেন উসমান ফেরত আসার পরেই নবী, সাহাবী এবং খোদ আল্লাহ পাক শান্ত এরকম একটি মারাত্মক ভুল ইসলামী বিশ্বাসের সমস্ত ভিত্তিকে একদমই নষ্ট করে দেয়, ধার্মিক মুসলমানগণ কী এই সহজ বিষয়টি বুঝতে পারেন?
তথ্যসূত্র
- কোরআন ৪৮ঃ১০ [↑]
- কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) বা তাফসীরে যাকারিয়া, বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৪৩৬-২৪৩৭ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৬৫২, ৬৬২, ৬৬৪ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১১৩ [↑]
- সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ৩৭০৬ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"