ভূমিকা
১৯৭৪ সালে রাশাদ খালিফা নামক একজন মিশরীয়-মার্কিন জৈব-রসায়নবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক দাবী করেন যে, কোরআনে ১৯ সংখ্যাকে কেন্দ্র করে একটি জটিল গাণিতিক অলৌকিক মোজেজা বা মিরাকল রয়েছে। ১৯ সংখ্যাটির ১ এবং ৯ এর যোগফল হচ্ছে ১০, এবং ১ এবং ০ এর যোগফল হচ্ছে ১। অর্থাৎ এখানে আসলে এক আল্লাহকেই বোঝানো হচ্ছে। এবং উনি আরো দাবী করেন, কোরআনের অনেক কিছুই ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। যা ১৪০০ বছর আগের একজন মরুভূমির উট চড়ানো নিরক্ষর ও মূর্খ মানুষের পক্ষে রচনা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এর অর্থ হচ্ছে, কোরআন আল্লাহর বাণী। এই নিয়ে তিনি ‘The Computer Speaks: God’s Message to the World’ [1] নামে একটি বই বের করেন এবং মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্য মানুষই তাদের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে শক্তিশালী করার জন্য তাকে সমর্থন করা শুরু করেন। যার ফলাফল হিসেবে উনি মুসলিমদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে যান। এই লেখাটিতে রাশাদ খলিফার সেইসব দাবীসমূহ পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করে দেখা হবে, উনি তার বইতে কী কী মিথ্যাচার এবং চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ১৯ সংখ্যার এই মোজেজা বা মিরাকলের জন্ম দিয়েছিলেন।
রাশাদ খলিফা কে?
রাশাদ খালিফার জন্ম ১৯৩৫ সালে। উনি ছিলেন একজন মিশরীয়-মার্কিন জৈব-রসায়নবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক। রাশাদ খলিফা কায়রোর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ১৯৫৯ সালে আমেরিকাতে আসেন এবং ১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে কোরআনের গানিতিক কোড নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন, এই বিষয়ে এরপরে তিনি বেশকিছু বইও লিখে ফেলেন।
তিনি আধুনিক সংস্কারবাদী ইসলামী সংগঠন ইউনাইটেড সাবমিটার্স ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯ সংখ্যার মিরাকল নামক একটি মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা জন্ম দেয়ার পরে মুসলিম বিশ্বে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরপরেই উনি নিজেকে ইমাম মাহদী ও শেষ আল্লাহর মেসেঞ্জার বলে দাবী করে বসেন। তিনি কোরআনের আয়াত বিকৃত করে নিজের নাম কোরআনে অন্তর্ভূক্ত করে ফেলেন, এবং দাবী করেন যে, কোরআনে তার কথাও বলা রয়েছে। তিনি নতুন ধারার ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন, যাদের বলা হয় আহলে কোরআন বা অনলি কোরআন বা কুরানিস্ট বা প্রোগ্রেসিভ মুসলিম। এক পর্যায়ে তারা মুহাম্মদের হাদিস অস্বীকার করতে শুরু করে, মুহাম্মদের আদেশ-নিষেধ বা “সুন্নাহ” কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসে যা ইসলামের পরিভাষায় সর্বসম্মতভাবে কুফুরী। এছাড়াও প্রখ্যাত ক্লাসিকাল তাফসীর লেখক এবং মুহাম্মদের বিখ্যাত সাহাবীরা কোরআন বুঝতে পারে নি, এমনকি খোদ মুহাম্মদও কোরআন বোঝেন নি, এরকম কিছু দাবীও করতে শুরু করেন। কোরআনের বেশিরভাগ আয়াত নিয়ে নিজে নিজে মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করান। ইসলামী ইমান আকিদা মোতাবেক আল্লাহর ওহীর সাহায্যে মুহাম্মদ যেইভাবে কোরআন বুঝেছেন, বুঝিয়েছেন, ব্যাখ্যা করেছেন, এবং এর উপর আমল করেছেন, সাহাবা-তাবে তাবেইনরা যেইভাবে বুঝেছেন তারা সেসব অস্বীকার করে নিজেরাই কোরআনের নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করেন।
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, অফিশিয়াল প্যাডে তিনি নিজের নামের নিচে লিখতেন Messenger of God (ঈশ্বরের দূত)। আসুন দেখি, রাশাদ খলিফার নিজ হাতের সাক্ষরের নিচে উনি কী লিখতেনঃ
উল্লেখ্য, ইসলামের আকিদা অনুসারে নিজেকে ঈশ্বরের দূত দাবী করা সম্পুর্ণ কুফরী কাজ। ফলাফল হিসেবে, তিনি ১৯৯০ সালে ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারাই ছুরিকাঘাতে নিহত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই ১৯ সংখ্যার অলৌকিকত্ব নিয়ে মাতামাতি করেন, প্রচার করেন, তারা যে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ কুফরী কাজে লিপ্ত হয়েছেন, তা তারা নিজেরাও জানেন না। কারণ রাশাদ খলিফা ১৯ সংখ্যার সাথে মেলাবার জন্য কোরআনকেই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। এই কারণেই তাকে ইসলামী মৌলবাদীদের হাতেই জীবন দিতে হয়।
আল্লাহ/মুহাম্মদ কি ১৯ সংখ্যার মিরাকলের কথা বলেছেন?
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ, মুহাম্মদ, ইসলামের লক্ষ লক্ষ স্কলার, কেউই কোনোদিন কোরআনের এই ১৯ সংখ্যার মোজেজার কথা বলেননি। ইসলামের ইতিহাসে মুহাম্মদের প্রখ্যাত সব সাহাবীগণ, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম, তাদের ছাত্র, তাদের ছাত্র অর্থাৎ তাবে তাবেইনগণ কেউই এই রকম কোন মিরাকল বা মোজেজার কথা উল্লেখ করেননি। রাশাদ খলিফার দাবী যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে, কোরআনকে তিনি খোদ নবীর চাইতেও বেশি বুঝেছেন। এবং ইসলামের সবচাইতে প্রখ্যাত তাফসীর লেখকগণ আসলে কেউই কোরআনকে বোঝেন নি। অর্থাৎ, ইসলামের ওপর ১৪০০ বছরের যে গবেষণা, তার সবই ছিল ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
যেসকল মুসলিমগণ রাশাদ খলিফাকে সমর্থন করেন, তারা মনের অজান্তেই ইসলামের ইতিহাসের ১৪০০ বছরের লক্ষলক্ষ আলেম, ওলামা, শায়েখ, এদের সকলের পড়ালেখাকে বাতিল ঘোষণা করে ফেলেন। যা ইসলামের দৃষ্টিতে কুফরী কর্ম। এরকম মুসলিমদের জন্য ইসলামের শরীয়তই কঠিন শাস্তির বিধান রেখেছে।
চতুর্দশপদী কবিতা কাকে বলে?
চতুর্দশপদী হল এক ধরনের কবিতা যার প্রথম উদ্ভব হয় মধ্যযুগে ইতালিতে। এইধরনের কবিতার একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে এসকল কবিতা ১৪টি চরণে সংগঠিত এবং প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর থাকবে। যার প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকে। যেমন ধরুন, মাইকেল মধুসূধন দত্তের একটি চতুর্দশপদীঃ
“বউ কথা কও”
কি দুখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে
বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে ?—
মানিনী ভামিনী কি হে, ভামের গুমরে,
পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে ?
তেঁই সাধ তারে তুমি মিনতি-বচনে ?
তেঁই হে এ কথাগুলি কহিছ কাতরে ?
বড়ই কৌতুক, পাখি, জনমে এ মনে—
নর-নারী-রঙ্গ কি হে বিহঙ্গিনী করে ?
সত্য যদি, তবে শুন, দিতেছি যুকতি;
(শিখাইব শিখেছি যা ঠেকি এ কু-দায়ে)
পবনের বেগে যাও যথায় যুবতী;
“ক্ষম, প্রিয়ে” এই বলি পড় গিয়া পায়ে!—
কভু দাস, কভু প্রভু, শুন, ক্ষুন্ন-মতি,
প্রেম-রাজ্যে রাজাসন থাকে এ উপায়ে।
এইধরনের ছন্দবদ্ধ কবিতা যুগে যুগে অসংখ্য কবির মধ্যে পাওয়া যায়। এখন কোনো কবির কবিতার মধ্যে কিছু সংখ্যাতাত্ত্বিক মিল থাকলেই তো সে আল্লাহ প্রেরিত নবী হয়ে যায়না। তারপরেও তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, মুহাম্মদের মত অসভ্য বর্বর আরবদের মধ্যে জন্ম নেয়া এক রাখাল বালকের জন্য এরকম ১৯ সংখ্যার মাহাত্ম্যপূর্ণ কোরআন লেখা কঠিন। তাহলে এখন আমাদের পরীক্ষা করে দেখা দরকার, আসলেই কোরআনের মধ্যে এরকম কোন বিষয় আদৌ আছে কিনা।
বাইবেলের ৭ সংখ্যার মিরাকল
রুশ বংশোদ্ভুত গণিতবিদ এবং খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক ড. ইভান পেনিনও প্রায় একই রকমের কিছু দাবি তুলেছিলেন যে, বাইবেল ধর্মগ্রন্থটি ৭ সংখ্যাটি দ্বারা অলৌকিকভাবে বিভাজিত। যাদের আগ্রহ আছে, তারা এই [2] ওয়েবসাইটে গিয়ে ক্রিশ্চানদের এজাতীয় দাবীসমূহ পড়ে দেখতে পারেন। কেউ আবার ১২ সংখ্যাটির সাথে বাইবেলের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ইহুদিদের বিখ্যাত শেমহামেফোরাস (Shemhamphorasch)। এক্সোডাসের ১৪:১৯-২১, এই তিনটি আয়াতের মাধ্যমে তারা স্রষ্টার ৭২টি নাম উদ্ভাবন করেছে। ইহদীরা দাবী করে এই প্রতিটি আয়াতে ৭২টি করে বর্ণ আছে। এরকম দাবী বিভিন্ন ধর্মেই রয়েছে, তবে একটিও আজ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ মহলে কোন গুরুত্ব পায়নি।
সূরা মুদাচ্ছিরের ৩০ নং আয়াত
কোরআনে ১৯ সংখ্যার মিরাকল বা অলৌকিকত্ব প্রমাণের জন্য শুরুতেই রাশাদ খলিফা যেই কাজটি করেছেন, তা হচ্ছে, উনি দাবী করেছেন, সূরা মুদাচ্ছিরের ৩০ নং আয়াতে পরিষ্কারভাবেই ১৯ সংখ্যার গোপন রহস্যের কথা বলা হয়েছে। আয়াতটি আসুন আমরা পড়ে নিইঃ
ইহার উপরে আছে উনিশ
কোরআন ৭৪/৩০
মজার বিষয় হচ্ছে, এই আয়াতের পরের আয়াতেই কিন্তু এই উনিশ দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করা আছে। এমনকি, অধিকাংশ প্রখ্যাত অনুবাদকও ব্রাকেটের ভেতরে লিখে দেন, এই ১৯ দ্বারা আসলে জাহান্নামের প্রহরী ১৯ জন ফেরেশতার কথা বলেছেন।
আসুন এবারে এই সূরাটির ২৬ নম্বর আয়াত থেকে পড়ি, MUHIUDDIN KHAN এর অনুবাদ থেকে,
আমি তাকে দাখিল করব অগ্নিতে।
আপনি কি বুঝলেন অগ্নি কি?
এটা অক্ষত রাখবে না এবং ছাড়বেও না।
মানুষকে দগ্ধ করবে।
এর উপর নিয়োজিত আছে উনিশ (ফেরেশতা)।
আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যেই তার এই সংখ্যা করেছি-যাতে কিতাবীরা দৃঢ়বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীরা ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে এবং যাতে যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা এবং কাফেররা বলে যে, আল্লাহ এর দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছেন। এমনিভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে চালান। আপনার পালনকর্তার বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন এটা তো মানুষের জন্যে উপদেশ বৈ নয়।
লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ১৯ দ্বারা আসলে জাহান্নামের প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত ফেরেশতাদের কথাই বোঝানো হয়েছে। কোরআনের আরেক জায়গাতে বলা আছে, আল্লাহর আরশ বহন করবেন ৮ জন ফেরেশতা।
এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের উর্ধ্বে বহন করবে। সূরা আল-হাক্বক্বাহঃ আয়াত-১৭
তাহলে ৮ সংখ্যাটিও কী মোজেজাপুর্ণ? সমস্যা হচ্ছে, জাহান্নামের প্রহরীর সংখ্যার চাইতে আল্লাহর আরশ বহনকারী ফেরেশতার সংখ্যা ইসলামের দৃষ্টিতে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তাহলে রাশাদ খলিফা কোরআনে ৮ এর মোজেজা বাদ দিয়ে ১৯ এর মোজেজা নিয়ে এতো মাতামাতি কেন করলেন?
তাফসীর কী বলে?
রাশাদ খলিফা সহ আরো অনেকেই এইরকম দাবী করেছেন যে, ঐ ১৯ জন ফেরেশতার জায়গাতে আসলে ফেরেশতা বোঝানো হয় নি, ইংগিতে অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে। তাহলে আমাদের দেখা দরকার, প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল তাফসীর লেখকগণ এই আয়াতটির কী ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলে পড়ি তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে, যা সারা পৃথিবীতে সবচাইতে বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত।
প্রখ্যাত এবং সেই ক্ল্যাসিকাল যুগের সকল ইসলামি চিন্তাবিদ ও তাফসীরকারকই এই সূরার ‘উনিশ’ বলতে জাহান্নামের সাকার নামক দোজখে নিয়োজিত উনিশ জন ফেরেশতার কথাই বলেছেন। নবী নিজেই সেরকমই বলেছেন, যা তাফসীরেই পাওয়া যায়। এই সূরার এই আয়াতের এই সংখ্যাটিকে উনি কেন বেছে নিলেন নিজের দাবীকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ হচ্ছে, মূর্খ এবং অন্ধবিশ্বাসী মানুষদের বোকা বানানো।
কোরআনের আয়াত সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য?
রাশাদ খলিফা কোরআনের আয়াতের সংখ্যা নিয়ে রীতিমত জ্বালিয়াতি করে দাবী করেছেন, কোরআনের আয়াত সংখ্যা হচ্ছে ৬৩৪৬, যা ১৯ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য (১৯×৩৩৪=৬৩৪৬)। একইসাথে, ৬৩৪৬ সংখ্যাটিতে থাকা অংকসমূহের যোগফলও ১৯ (৬+৩+৪+৬=১৯)। অথচ, কোরআনের আয়াত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু মতপার্থক্য।
কোরআন সংকলন এবং পরিমার্জনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, কোরআনের আয়াতের সংখ্যা আসলে কত, তা নিয়ে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিভিন্ন জনের মতামত অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ৬০০০/ ৬২০৪/ ৬২১৪/ ৬২১৯/ ৬২২৫/ ৬২২৬/ ৬২৩৬/ ৬২১৬/ ৬২৫০/ ৬২১২/ ৬২১৮/ ৬৬৬৬/ ৬২২১/ ৬৩৪৮, অর্থাৎ আয়াত ঠিক কয়টি, তা সেই সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। আয়াতের পাশাপাশি অক্ষর ও শব্দের সংখ্যা নিয়েও প্রচুর মতানৈক্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই নিয়ে ঘটে গেছে বহু রক্তারক্তি কাণ্ড। [3]
উপরের লিস্টে দেখুন, কেউই দাবী করেননি, কোরআনের আয়াতের সংখ্যা ৬৩৪৬ টি। কোরআনের আয়াতের সংখ্যা যে ৬৩৪৬ টি, এটি রাশাদ খলিফা নিজেই বানিয়েছেন ১৯ দ্বারা বিভাজ্য করার জন্য। কত বড় জ্বালিয়াতি!
কোরআনের সর্বমোট সূরার সংখ্যা কত?
রাশাদ খলিফা দাবী করেছেন, কোরআনের সর্বমোট সূরার সংখ্যা ১১৪ টি, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। অথচ, তাফসীরে ইবনে কাসীর [4] থেকে জানা যায়, সূরা তওবা যে স্বতন্ত্র সূরা, এটি ছিল উসমানের ধারণা। মুহাম্মদ এবিষয়ে কিছু বলে যাননি। সূরা তওবার শুরুতে তাই বিসমিল্লাহও পড়া হয় না। এখন লাওহে মাহফুজের কোরআনে সূরা তওবা আলাদা সূরা নাকি তা সূরা আনফালের অংশ, তা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উসমানের ধারণার ওপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা কি আমরা শতভাগ শুদ্ধ হিসেবে গণ্য করতে পারি? তাহলে সূরা তওবা যদি স্বতন্ত্র সূরা না হয়েই থাকে, তাহলে কোরআনে সূরার সংখ্যা হয় ১১৩ টি। যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।
আরো বিবরণ পাওয়া যায় সুনানু আবু দাউদ শরীফের হাদিস থেকে। [5]
কোরআনে বর্ণের সংখ্যা কত?
রাশাদ খলিফা দাবী করেছেন, কোরআনের মোট বর্ণ সংখ্যা ৩২৯১৫৬, যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য (১৯×১৭৩২৪=৩২৯১৫৬)। কোরআনের মোট বর্ণ সংখ্যা কত, তা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের বিভিন্ন রকম মতামত বা ধারণা।
- হযরত মুহাম্মদের প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এর মতে কোরআনের বর্ণের সংখ্যা ৩,২২,৬৭১ টি ( ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয় )
- মোজাহেদ এর মতে, ৩,২১,১২১ টি ( ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয় )
এরকম আরো অনেক মত রয়েছে। আসুন সরাসরি বই থেকেই পড়ি, [6]
আগ্রহী পাঠকগণের জন্য বলছি, কোরআনে আরো দুইটি সূরা নাজিল হয়েছিল, যা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই বিষয়ে কোরআন সংকলনের ইতিহাস নামক লেখাটিতে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সন্নিবেশিত রয়েছে। রাশাদ খলিফার এই জ্বালিয়াতি আর মিথ্যাচার সম্ভবত সকল সীমাই এখানে অতিক্রম করে ফেলেছে!
আরো অসংখ্য মিথ্যাচার
এরকম ধরে ধরে রাশাদ খলিফার প্রায় প্রতিটি দাবীকেই মিথ্যা প্রমাণ করা যায়। সবচাইতে মজার বিষয় হচ্ছে, রাশাদ খলিফার কোরআনের সাথে ১৯ সংখ্যাটির মিল করতে গিয়ে সূরা তওবার ১২৮ এবং ১২৯ নং আয়াত দুটি বেমালুম উধাও করে দিয়েছেন। কারণ এই আয়াত দুইটি থাকলে তার ১৯ তত্ত্ব কিছুতেই মেলে না।
আরো মজার বিষয় হচ্ছে, রাশাদ খলিফা তার নিজের ইংরেজি অনুবাদকৃত কোরআনের ‘সুরা ফুরকান’, ‘সুরা ইয়াসিন’, ‘সুরা শুরা’ এবং ‘সুরা তাক্ভির’-এর আয়াতে নিজের নাম পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়েছেন, এবং দাবী করেছেন, তার সম্পর্কে কোরআনে ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছে। উনার অনুবাদ হচ্ছে, [7]
We have sent you (Rashad) as a deliverer of good news, as well as a warner. (Quran 25:56)
উপসংহার
এভাবে ধরে ধরে রাশাদ খলিফার দাবীসমূহ যে কত বড় জ্বালিয়াতি আর মিথ্যাচারে পূর্ণ, তা প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু রাশাদ খলিফার দাবীসমূহ সত্য হলেও, তা কিন্তু প্রমাণ করেনা যে, কোরআন কোন অলৌকিক সত্ত্বার লিখিত গ্রন্থ। কিন্তু, রাশাদ খলিফা সেটি প্রমাণ করতে গিয়ে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কোরআনকেও বদলে দিয়েছিলেন। উনি যে প্রতারক, তা একেবারেই স্পষ্ট। তবে সেটি প্রমাণ করে আসলে লাভ নেই, কারণ অন্ধবিশ্বাসী মানুষের কাছে যুক্তির চাইতে অন্ধবিশ্বাসই বেশী প্রাধান্য পাবে। তারপরেও, রাশাদ খলিফার এই দাবীর জবাব দেয়া সংশয় – চিন্তার মুক্তির আন্দোলনের পাঠকদের জন্য জরুরি ছিল। রাশাদ খলিফার এইসকল দাবীর উত্তর অংখ্যবার মুক্তমনা লেখকদের পক্ষ হতে দেয়া হয়েছে। এবং যতবার মুমিনরা সেই একই বস্তাপঁচা মিরাকল নিয়ে আসবে, ততবারই জবাব দেয়া হবে। আশাকরি, পাঠকগণ নিজ বুদ্ধি বিবেচনা এবং যুক্তিবোধ ব্যবহার করে তথ্যসমূহ যাচাই করে দেখবেন, রাশাদ খলিফার দাবীসমূহ কতটা যুক্তিযুক্ত এবং সত্য।
তথ্যসূত্র
- The Computer Speaks: God’s Message to the World [↑]
- God is A Mathematician [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ১৭৯ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। চতুর্থ খণ্ড। পৃষ্ঠা ৫১২, ৫১৩ [↑]
- সুনানু আবু দাউদ শরীফে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৪২৭, ৪২৮। হাদিস নম্বর ৭৮৬, ৭৮৭ [↑]
- কোরআন শরীফ, সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১২, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমেদ [↑]
- Sura – 25 The Statute Book Al-Furqan [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"