18.জমজম- যমযমের পানি রোগমুক্ত করে?

ভূমিকা

ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস হচ্ছে, মক্কায় অবস্থিত জমজম কুপের পানি নাকি সকল রোগের নিরাময় করতে পারে, একইসাথে এই পানি নাকি তৃপ্তিদায়ক খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ, শুধুমাত্র যা পান করেই নাকি বহুকাল বেঁচে থাকা সম্ভব। এই প্রবন্ধে আমরা সেই বিষয়গুলো জানবো এবং এটি যাচাই করে দেখবো।


ইসলাম কী বলে?

জমজমের পানি সম্পর্কে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে নানা ধরণের উদ্ভট আজগুবি কথা প্রচলিত আছে। এগুলো প্রায় সবই এসেছে ইসলামিক নানা ধরণের গ্রন্থ এবং পুরনো দিনের কুসংস্কার থেকে। আসুন শুরুতেই ওয়াজের কিছু কথা শুনে নিই,

এবারে আসুন প্রাসঙ্গিক হাদিস পড়ি নিই,

হাদীস সম্ভার
১০/ হজ্জ
পরিচ্ছেদঃ যমযমের পানির মাহাত্ম্য
(১২০১) আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় তা (যমযমের পানি) বরকতপূণ। তা তৃপ্তিকর খাদ্য এবং রোগনিরাময়ের ঔষধ।
(ত্বাবারানীর স্বাগীর ২৯৫, বাযযার ৩৯২৯, সহীহুল জামে’ ২৪৩৫)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ যার আল-গিফারী (রাঃ)


বিজ্ঞান কী বলে?

পানির প্রধান কাজ হলো মানবদেহে সঠিক পরিমাণে আর্দ্রতা বজায় রাখা, পুষ্টি উপাদান বহন করা এবং বর্জ্য পদার্থ দূর করা। সাধারণত বিশুদ্ধ পানি কোনো খাদ্যগুণ বহন করে না, বরং এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। তবে, যদি কোনো পানি খাদ্যগুণসম্পন্ন হয় বা তা খেয়ে ক্ষুধা মিটে যায়, তবে সেটি মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ এই ধরনের পানিতে অতিরিক্ত দ্রব্য দ্রবীভূত থাকতে পারে, যা মানবদেহের জন্য উপকারী নয়, বরঞ্চ অপকারী।

প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সকল প্যাগান ধর্মে সূর্য, চাঁদ, গাছপালা এবং প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর উপাসনা করা হতো। সেই সময়ের মানুষদের কাছে এসব শক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল না, তাই তারা ধারণা করত যে, এসব শক্তি একেকটি স্বতন্ত্র সত্তা। এই সত্তাগুলোকে তারা মানুষের মতো সচেতন সত্তা হিসেবে কল্পনা করতো, যারা খায়, ঘুমায়, রাগ করে, খুশি হয়, দুঃখ পায় এবং অন্যান্য মানবীয় অনুভূতি প্রকাশ করে। এই বিশ্বাস থেকেই বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টি হয়েছিল। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখনো বিশেষভাবে শিশুরা এই কাজগুলো করে। কোন পাথরে ব্যাথা পেলে তারা পাথরটিকে মারে। কিন্তু পাথর যে সেই মারে ব্যাথা পাচ্ছে না, সেটি শিশুরা বোঝে না।

তবে সময়ের সাথে মানুষ বুঝতে শুরু করে যে, প্রকৃতির এই শক্তিগুলো আসলে মানুষের মতো নয়। মানুষ জীব হিসেবে ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব করে, প্রেম-ভালোবাসার দ্বারা বংশবিস্তারের প্রয়োজনে আবেগ প্রকাশ করে। কিন্তু জড় বস্তু যেমন চেয়ারের ভালোবাসার অনুভূতি নেই, তেমনি কোনো অলৌকিক সত্তারও মানবীয় আবেগ থাকা সম্ভব নয়। ঈশ্বর বা দেবতারা যদি রক্ত-মাংসের মানুষ না হন, তাহলে তাদের রাগ, দুঃখ, হিংসা কিংবা ভালোবাসার প্রয়োজনও থাকার কথা নয়। একইভাবে, তাদের উপাসনা বা প্রশংসার প্রয়োজনীয়তাও অমূলক।

একসময় বিশ্বাস করা হতো, মৃত মানুষের আত্মারা আমাদের চারপাশে আছে। কিন্তু চিন্তা করা, দেখা বা স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি জৈবিক মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড এবং রক্তপ্রবাহ প্রয়োজন। আত্মার এসব উপাদান না থাকলে, তার চিন্তা বা দেখার ক্ষমতা থাকার প্রশ্নই আসে না। প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে পানি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে মানুষ পানিকে এক ধরনের সত্তা হিসেবে কল্পনা করেছিল, কারণ নদীর তীরে সভ্যতা গড়ে ওঠে, কূপের আশেপাশে নগরী বিকশিত হয়। এর ফলে পানির পবিত্রতা নিয়ে নানা উপকথা সৃষ্টি হয়। যেমন প্রাচীন মিশরে নীল নদকে প্রথমে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এই নদীর পানিকে আইসিস দেবীর অশ্রু বলে প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে, খ্রিস্টানরাও এই পবিত্র পানির ধারণা গ্রহণ করে নিজেদের গল্প তৈরি করে। ভারতে গঙ্গা নদীকে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু মিথলজিতে দেবী গঙ্গাকে গুরুত্বপূর্ণ দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে, এই বিশ্বাস সভ্যতা গড়ে ওঠার পরেই তৈরি হয়েছে। গঙ্গার তীরে বসতি স্থাপনের পর, নদীটিকে বিশেষ মর্যাদা দিতে নানা কাহিনী সৃষ্টি হয়। তবে এসব গল্পের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

মক্কার কোরাইশরা জমজম কূপের পাশে তাদের বসতি গড়ে তুলেছিল। এই কূপকে গুরুত্বপূর্ণ করার জন্য নানা কাহিনী প্রচার করা হয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলো তখন সম্মানিত হওয়ায়, মক্কার অধিবাসীরা ইব্রাহিমকে মক্কার সঙ্গে যুক্ত করে গল্প তৈরি করে। মুহাম্মদের জন্ম মক্কায় হওয়ার কারণে ইসলাম ধর্মে জমজমের পানি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। যদি তিনি ভারতে জন্মাতেন, তাহলে হয়তো গঙ্গার পানি হতো মুসলমানদের জন্য পবিত্র। অথবা ইউরোপে জন্ম নিলে টেমস কিংবা রাইন নদীকেই পবিত্র পানি বলা হতো। যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বসতি বা সভ্যতা আগে গড়ে ওঠে, এরপর তার মাহাত্ম্য বাড়াতে নানান কাহিনী রচিত হয়। আজ যদি ঢাকায় কোনো নবী জন্মাতেন, তাহলে হয়তো বলা হতো, বুড়িগঙ্গার পানিই পবিত্র, এবং তার নাম রাখা হতো “বুড়িহাজেরা।” এবং তখনো অনেকে দাবী করতো, বুড়িগঙ্গার পানি পান করেই তারা অসুখমুক্ত হয়েছে!


খাদ্যগুণসম্পন্ন পানির সম্ভাব্য বিপদ

  • ১. দূষিত পানির উপস্থিতি: খাদ্যগুণসম্পন্ন পানিতে সাধারণত উচ্চমাত্রার খনিজ, রাসায়নিক, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় নাইট্রেট, আর্সেনিক, ফ্লুরাইড বা লেড থাকলে এটি মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
  • ২. অতিরিক্ত দ্রবীভূত খনিজের ক্ষতি: অধিকমাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত পানি (হার্ড ওয়াটার) কিডনিতে পাথর তৈরির সম্ভাবনা বাড়ায়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (BMJ) অনুসারে, দীর্ঘমেয়াদে হার্ড ওয়াটার পান করলে কিডনি ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • ৩. পানির পরিবর্তিত pH লেভেল: পানি যদি অত্যধিক অম্লীয় বা ক্ষারীয় হয়, তবে এটি পরিপাকতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) অনুসারে, পানির pH ৬.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে থাকাই স্বাস্থ্যসম্মত। এর বেশি বা কম হলে তা হজমজনিত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
  • ৪. ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর সংক্রমণ: খাদ্যগুণসম্পন্ন পানিতে জীবাণুর সংক্রমণ বেশি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাঁচা দুধ বা ফলের রস মেশানো পানিতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ডায়রিয়া, টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস-এ-এর মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) অনুসারে, প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদাহরণ

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা লবণাক্ত পানি পান করে তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে এই সমস্যা দেখা যায়, যেখানে লবণাক্ত পানির কারণে উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনির রোগ বেড়ে চলেছে। এছাড়া, মেক্সিকোতে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মিনারেলযুক্ত পানি পান করার ফলে ক্যালসিফিকেশন বা দেহের বিভিন্ন অঙ্গে কঠিন পদার্থ জমা হতে পারে। তাই পানিতে কী কী দ্রব্য থাকবে, সেগুলোর সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে, যেই মাত্রা অতিক্রম করলেই সেটি আর পান করার উপযোগী থাকে না।


নিরাপদ পানির জন্য করণীয়

  • ১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত, যার মধ্যে কোনো অতিরিক্ত দ্রব্য মিশ্রিত থাকবে না।
  • ২. পানির গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য পানিতে দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের (TDS) মাত্রা ৩০০-৫০০ mg/L এর মধ্যে রাখা উচিত।
  • ৩. বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার জন্য পরিশোধিত ফিল্টার ব্যবহার করা উচিত এবং নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা করা উচিত।

উপসংহার

খাদ্যগুণসম্পন্ন পানির ধারণা প্রাথমিকভাবে ভালো মনে হলেও বাস্তবে এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশুদ্ধ পানি হলো জীবনের অপরিহার্য উপাদান, এবং এটি কোনো ধরনের খাদ্য বা অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রণ ছাড়াই নিরাপদ থাকা উচিত। তাই আমাদের উচিত বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা বুঝে সচেতন থাকা এবং পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।