06.সমকামিতা মানসিক বিকৃতি বা রোগ?

একটি কথা আমাদের দেশের সাধারণ আমজনতার মধ্যে প্রচলিত রয়েছে যে, সমকামিতা একটি মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ বা মানসিক বিকৃতি। কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞান একে মানসিক সমস্যা বা রোগ বা বিকৃতি হিসেবে চিহ্নিত করে, নাকি একে মানুষের যৌন আচরণের একটি স্বাস্থ্যকর প্রকরণ হিসেবে মনে করেন, তা জেনে নেয়া জরুরি। উল্লেখ্য, অতীতে একটি দীর্ঘ সময় ধরে একে মানসিক রোগ বা বিকৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো বতে, তবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রায় সর্বক্ষেত্রেই একে মানসিক রোগ বা বিকৃতির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে একে একটি স্বাভাবিক যৌন আচরণ হিসেবেই চিহ্নিত করে।

মনোবিজ্ঞানে মানুষের যৌন আচরণ হিসাবে সমকামিতা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা হয়েছে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ১৯৫২ সালে DSM-I তে সমকামিতাকে একটি “সোসিওপ্যাথিক পার্সোনালিটি ডিস্টার্বেন্স” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল [1], যার ফোলে দীর্ঘদিন ধরে একে একটি মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথের অর্থায়নে পরবর্তীতে অনেকগুলো গবেষণায় এই শ্রেণীবিভাগটি পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হয়। সেই গবেষণা এবং পরবর্তী অধ্যয়নগুলি ধারাবাহিকভাবে সমকামিতাকে একটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক যৌন আচরণ ব্যতীত অন্য কিছু হিসাবে বিবেচনা করার জন্য কোন অভিজ্ঞতামূলক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলাফল হিসেবে সমকামিতাকে মানুষের যৌনতার একটি স্বাস্থ্যকর এবং ইতিবাচক প্রকাশ হিসেবেই চিহ্নিত করতে তারা বাধ্য হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলস্বরূপ, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন 1973 সালে DSM-II থেকে সমকামিতাকে সরিয়ে দেয়। বৈজ্ঞানিক তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার পর, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ১৯৭৫ সালে সমস্ত মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, পেশাদার এবং চিকিৎসকদের আহ্বান জানায় যেন তারা একে আর মানসিক রোগ বা বিকৃতি হিসেবে চিহ্নিত না করে [2]। সমকামিতার সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ধ্যান ধারণা দূর করার ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৭ সালে আইসিডি-9-তে সমকামিতাকে তালিকাভুক্ত করে, আইসিডি-10 থেকে সমকামিতাকে সরিয়ে দেয় [3] [4]

আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং মনোবিজ্ঞানীদের ঐকমত্য প্রমাণ করে যে, সমলিঙ্গের আকর্ষণ, অনুভূতি এবং আচরণ মানব যৌনতার স্বাভাবিক একটি প্রকরণ এবং বৈশিষ্ট্য। এর পরবর্তী সময়েও প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং প্রচুর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যা ইঙ্গিত করে যে সমকামী বা উভকামী হওয়া স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সামঞ্জস্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।তাই বর্তমান বিশেষজ্ঞদের মতে, সমকামিতা কোন মানসিক ব্যাধি নয়। কয়েক দশক ধরে গবেষণা ও ক্লিনিকের অভিজ্ঞতার ফলে প্রধান প্রধান স্বাস্থ্য ও মনোস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এসব প্রবৃত্তি মানুষদের স্বাভাবিক যৌনতার একটি ভিন্ন প্রকরণ মাত্র। নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের মতোই সমলিঙ্গ সম্পর্কও স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর [5]

তথ্যসূত্র

  1. Cabaj, Robert Paul. “Working with LGBTQ Patients”. American Psychiatric Association. Retrieved 4 July 2024. []
  2. In re Marriage Cases
    183 P.3d 384 (Cal 2008). []
  3. “Stop discrimination against homosexual men and women”World Health Organization. 17 May 2011. Archived from the original on 9 July 2012. Retrieved 8 March 2012. []
  4. “The decision of the World Health Organisation 15 years ago constitutes a historic date and powerful symbol for members of the LGBT community”International Lesbian, Gay, Bisexual, Trans and Intersex Association. Archived from the original on 30 October 2009. Retrieved 24 August 2010. []
  5. American Psychological Association: Appropriate Therapeutic Responses to Sexual Orientation []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"