21.আপেক্ষবাদের কুযুক্তি | Appeal to worse problems/ Not as bad as

আপেক্ষবাদের কুযুক্তি হলো একটি সাধারণ লজিক্যাল ফ্যালাসি যেখানে একটি সমস্যার সমালোচনা এড়াতে সেটির তুলনায় আরেকটি বেশি খারাপ সমস্যার উদাহরণ তুলে ধরা হয়। এটি “Not as bad as” বা “ফ্যালাসি অফ রিলেটিভ প্রাইভেশন” নামেও পরিচিত। এর মাধ্যমে একজন বক্তা যুক্তি দেন যে, যেহেতু অন্য একটি সমস্যা আরো খারাপ, তাই মূল সমস্যা প্রকৃতপক্ষে তেমন গুরুতর নয় এবং এটিকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। ধরুন, যখন কেউ এক্স নামক একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করে, এবং এটি কেন একটি সমস্যা তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে, তখন এক্স এর পক্ষের বক্তা যদি ওয়াই নামক আরেকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করে, এবং এক্স ও ওয়াইকে তুলনা করার মাধ্যমে এক্সকে অপেক্ষাকৃত কম সমস্যাযুক্ত বলে প্রমাণের চেষ্টা করে- যার মাধ্যমে বস্তুতপক্ষে ওয়াইকে অবজেকটিভলি ভাল বা উত্তম বা আদর্শিক কাজ বলে চালিয়ে দেয়া যায়, তখন “নট এস ব্যাড এস” বা “ফ্যালাসি অফ রিলেটিভ প্রাইভেশন” নামক লজিক্যাল ফ্যালাসিটির উদ্ভব ঘটে। এর অর্থ হচ্ছে, যখনই কেউ আপনার কোন কাজের সমালোচনা করতে আসবে, আপনি স্রেফ তাকে আরেকজনার আরেকটি অধিক বাজে কাজের উদাহরণ উল্লেখ করে আপনার বাজে কাজটিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করবেন, তখনই এই ফ্যালাসিটি ঘটে।

কুযুক্তির প্রকৃতি:

এই কুযুক্তির ভিত্তিতে বলা হয় যে, কোনো সমস্যা তখনই সমাধানের উপযোগী বা সমালোচনার যোগ্য, যদি সেটি বৃহত্তর বা আরও গুরুতর সমস্যাগুলোর চেয়ে খারাপ হয়। অন্যথায় সেটি সমালোচনার যোগ্য নয়। এ ধরনের কুযুক্তি সমস্যার প্রকৃত গুরুত্বকে এড়িয়ে চলে এবং সঠিক সমাধান থেকে বিচ্যুত করে।

আপেক্ষবাদের কুযুক্তির উদাহরণ ও বিশ্লেষণ:

১. চুরির প্রসঙ্গ:

  • উদাহরণ: কলিমুদ্দীন স্বর্ণের দোকানে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তার যুক্তি হলো, “দেশে এত বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে, যেমন তারেক জিয়া দুর্নীতি করেছে, সালমান এফ রহমান শেয়ার মার্কেটের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে। তার তুলনায় আমি তো অনেক ভালো।”
  • বিশ্লেষণ: কলিমুদ্দীনের যুক্তি মূল সমস্যাটি আড়াল করছে। বড় বড় দুর্নীতি হোক বা ছোট চুরি, উভয়ই অপরাধ। একটি বড় অপরাধের উদাহরণ তুলে ধরে ছোট অপরাধকে বৈধতা দেওয়া যায় না। এটি স্পষ্টতই একটি আপেক্ষবাদের কুযুক্তি, যেখানে কলিমুদ্দীন তার চুরিকে বৈধ করার চেষ্টা করছে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর হিসেবে।

২. দুর্নীতির প্রসঙ্গ:

  • উদাহরণ: “বাংলাদেশে দুর্নীতি হয়, কিন্তু পাকিস্তান বা উগান্ডায় আরো বেশি দুর্নীতি হয়। তাই আমাদের দেশের দুর্নীতি নিয়ে এত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
  • বিশ্লেষণ: এখানে অন্য দেশে দুর্নীতি বেশি হওয়ার যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতিকে হালকা করে দেখা হচ্ছে। দুর্নীতি অন্যত্র বেশি হওয়া মানেই এ দেশে দুর্নীতি বৈধ বা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি আপেক্ষবাদের কুযুক্তি, যেখানে একটি কম গুরুতর সমস্যাকে তুলনামূলকভাবে বৈধ করে তোলা হচ্ছে।

৩. নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ:

  • উদাহরণ: “বাংলাদেশে নারীরা পথে ঘাটে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, কিন্তু ভারতে গ্যাং রেইপ হয়। তাই বলা যায়, আমাদের দেশে যৌন নির্যাতনের সমস্যা তেমন গুরুতর নয়।”
  • বিশ্লেষণ: ভারতে গ্যাং রেইপ হয় বলে বাংলাদেশে যৌন নির্যাতন কম গুরুতর হয়ে যায় না। যৌন নির্যাতন যে কোনো রূপেই নিন্দনীয় এবং তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এটিও আপেক্ষবাদের কুযুক্তি, যেখানে তুলনামূলকভাবে খারাপ উদাহরণ তুলে কম গুরুতর সমস্যা উপেক্ষিত হচ্ছে।

৪. ধর্ম ও নারীর অধিকার:

  • উদাহরণ: “খ্রিস্ট ধর্মে নারীদের জন্য কিছু অসম্মানজনক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু হিন্দু ধর্মে নারীদের আরো খারাপভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই খ্রিস্ট ধর্ম নারীদের জন্য খুব খারাপ কিছু বলে না।”
  • বিশ্লেষণ: অন্য ধর্মে নারীদের প্রতি আরো খারাপ আচরণের উদাহরণ দিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের সমস্যাগুলোকে বৈধ করা যায় না। এক্ষেত্রে মূল সমস্যাটি আলোচনা না করে তুলনামূলকভাবে অন্য সমস্যাকে তুলে ধরা হচ্ছে, যা এই কুযুক্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৫. দাসপ্রথার প্রসঙ্গ:

  • উদাহরণ: “সেই সময়ের প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত আপনার বুঝতে হবে। ইসলাম ধর্ম দাসপ্রথা চালু করে নি। এটি সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইসলাম শুধু তাকে বৈধতা দিয়েছে। তৎকালীন বর্বর আইয়্যামে জাহিলিয়াতের সময়ে সমাজে দাসদের খুব অত্যাচার করা হতো। মারপিট করা হতো, অনেক সময় হাত পা কেটে নেয়া হতো। দাসদের কোন অধিকারই ছিল না। কিন্তু আমার ধর্ম দাসদেরকে নান্নার কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়াতে বলেছে। বিনিময়ে ইসলামে মালিকেরা দাসীদের সাথে যৌনকর্ম করতে পারে, এই বিধান করা হয়েছে। দেখুন, আমার ধর্ম দাসদাসীদের কতটা সম্মান দিয়েছে। এরপরেও নাস্তিকরা বাজে কথা বলবে, জানি। কারণ তারা তো ইহুদিদের থেকে টাকা পায়। তাই বলা যায়, দাসপ্রথা খারাপ কিছু নয়। ইসলামই দাসদের দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। সুতরাং ইসলামী দাসপ্রথা খুবই ভাল ব্যবস্থা এবং আবারো সারা পৃথিবীতে ইসলামি দাসপ্রথা চালু করা উচিত।”
  • বিশ্লেষণ: এই যুক্তি দিয়ে দাসপ্রথার নৈতিকতা বা বৈধতা প্রমাণ করা যায় না। দাসপ্রথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, এবং তার আগে বা পরে কোনো সামাজিক প্রথা থাকা সত্ত্বেও এটি অন্যায়। অন্য কোথাও দাসপ্রথা ছিল বলে একে বৈধ করা যায় না। এটিও আপেক্ষবাদের কুযুক্তির একটি উদাহরণ। কারণ অন্য ধর্মে আরো খারাপ কিছু রয়েছে, বা আগের আমলে আরো খারাপ কিছু ছিল, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, যেই বিষয়ের সমালোচনা হচ্ছে, সেটি ভুল! দাসপ্রথা মানব ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ঙ্কর অপরাধ। মানবতার সাথে অন্যায়। মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মৌলিক অধিকার হচ্ছে, স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার। দাসপ্রথা দাসের একদম মৌলিক একটি অধিকার, স্বাধীনতাকে হরণ করে। তাকে একটি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে। মালিক চাইলে তাকে বিক্রি করতে পারে, মালিক চাইলে তাকে যেকোন কাজ করাতে পারে! শুধু তাই নয়, তাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহারও করতে পারে। এরকম ভয়াবহ ব্যাপারকে বৈধতা দেয়া অবজেকটিভলি খুব বড় অনৈতিক কাজ।

আপেক্ষবাদের কুযুক্তির সমস্যা:

এই কুযুক্তির মূল সমস্যা হলো এটি সত্যিকারের সমস্যাগুলোর সমাধানকে বিলম্বিত করে। যেকোনো সমস্যা অন্য সমস্যার চেয়ে কম গুরুতর হলেও, সেটি সমাধানের যোগ্য। তুলনামূলক সমস্যা তুলে ধরে অপরাধ বা সমস্যা বৈধ করা সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে।

আরও কিছু উদাহরণ:

৬. পরিবেশ দূষণ:

  • উদাহরণ: “আমাদের দেশে প্লাস্টিক দূষণ হচ্ছে, কিন্তু চীনে পরিবেশ দূষণ আরো খারাপ। তাই আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার তেমন সমস্যার নয়।”
  • বিশ্লেষণ: চীনে পরিবেশ দূষণ বেশি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়। এটি একটি বড় কুযুক্তি, যা সমস্যার গুরুত্ব কমিয়ে দেখাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৭. স্বাস্থ্য সেবা:

  • উদাহরণ: “আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা খারাপ, কিন্তু আফ্রিকায় তো মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তাই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তেমন খারাপ নয়।”
  • বিশ্লেষণ: অন্যত্র আরও খারাপ স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে বলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো গুরুত্বহীন নয়। এটি রোগীদের সমস্যাকে হালকা করে দেখার একটি কুযুক্তি।

উপসংহার:

আপেক্ষবাদের কুযুক্তি হচ্ছে এমন একটি কৌশল যেখানে তুলনামূলক বড় সমস্যা বা অপরাধ তুলে ধরে মূল সমস্যাকে অবহেলা বা হালকা করার চেষ্টা করা হয়। এতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান বিলম্বিত হয় এবং অপরাধ বা অন্যায়কে অগ্রাহ্য করা হয়। প্রতিটি সমস্যারই নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে, এবং সেগুলিকে সমাধানের জন্য নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করা উচিত, তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।