ভূমিকা
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, প্রথম মানব আদমের উচ্চতা ছিল ৬০ হাত বা প্রায় ৯০ ফুট। এটি একটি ধর্মীয় কাহিনী, যা বহু মুসলিম বিশ্বাসের অংশ। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দাবি সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং অসত্য। মানুষের শারীরিক গঠন, ফসিল রেকর্ড এবং শারীরিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় এনে প্রমাণিত হয়েছে যে, ৯০ ফুট উচ্চতার কোনো মানব অস্তিত্বে থাকা সম্ভব নয়। এই প্রবন্ধে ফসিল রেকর্ড, শারীরিক বিজ্ঞান, এবং স্কেলিং ল সম্পর্কে আলোচনা করা হবে যা এই বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক অসত্যতা নির্দেশ করে।
হাদিস সমূহ
আসুন এবারে হাদিসগুলো দেখে নিই [1] [2] –
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৭৯/ অনুমতি প্রার্থনা
পরিচ্ছেদঃ ৭৯/১. সালামের সূচনা
৬২২৭. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আদম (আ.)-কে তাঁর যথাযোগ্য গঠনে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর উচ্চতা ছিল ষাট হাত। তিনি তাঁকে সৃষ্টি করে বললেনঃ তুমি যাও। উপবিষ্ট ফেরেশতাদের এই দলকে সালাম করো এবং তুমি মনোযোগ সহকারে শোনবে তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয়? কারণ এটাই হবে তোমার ও তোমার বংশধরের সম্ভাষণ (তাহিয়্যা)। তাই তিনি গিয়ে বললেনঃ ’আসসালামু ’আলাইকুম’। তাঁরা জবাবে বললেনঃ ’আসসালামু ’আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’। তাঁরা বাড়িয়ে বললেনঃ ’ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বাক্যটি। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বললেনঃ যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা আদম (আঃ)-এর আকৃতি বিশিষ্ট হবে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত মানুষের আকৃতি ক্রমশঃ কমে আসছে। [৩৩২৬] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৭৮৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৬৮১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৪/ জান্নাত, জান্নাতের নিয়ামত ও জান্নাতবাসীগনের বিবর
পরিচ্ছেদঃ ১১. জান্নাতে এমন অনেক দল জান্নাতে যাবে যাদের হৃদয় পাখির হৃদয়ের ন্যায়
৬৯০০। মুহাম্মদ ইলূন রাফি’ (রহঃ) … হাম্মাম ইবন মুনাব্বি (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এ হচ্ছে (সে সব হাদীস) যা আবূ হুরায়রা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের শুনিয়েছেন। (এভাবে) তিনি কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেন। এর মধ্যে একটি হল এ ই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা আদম (আলাইহিস সালাম) কে তার নিজ আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তার দৈর্ঘ্য হল ষাট হাত। তাকে সৃষ্টি করার পর তিনি তাকে বললেন, যাও, এ দলটিকে সালাম কর। তারা হচ্ছে ফিরিশতাদের উপবিষ্ট একটি দল। সালামের জবাবে তারা কি বলে তা খুব মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর। কেননা তোমার এবং তোমার বংশধরদের অভিবাদন এ-ই। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি গেলেন ও বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। উত্তরে তারা বললেন, ‘আসসালামু আলাইকা ওয়ারহমাতুল্লাহ’। তাঁরা ওয়া রামাতুল্লাহ বাড়িয়ে বলেছেন। এরপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে সে আদম (আলাইহিস সালাম) এর আকৃতিতে যাবে। তার দৈর্ঘ্য হবে ষাট হাত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ এরপর হতে সৃষ্টি (-র দেহের) দেহের পরিমাণ দিন দিন কমতে থাকে আজ পর্যন্ত।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ হাম্মাম ইবনু মুনাব্বিহ (রহঃ)
এবারে আসুন বোখারী শরীফ থেকে একটি পৃষ্ঠার বক্তব্য পড়ে নিই, [3]
আসুন বাঙলাদেশের প্রখ্যাত আলেম মঞ্জুর ইলাহীর বক্তব্য শুনে নিই,
মানুষের উচ্চতার ক্রমবর্ধমান ইতিহাস
মানবজাতির বিবর্তনের প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, মানুষের গড় উচ্চতা বিভিন্ন যুগে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাচীনকালের মানুষের গড় উচ্চতা ছিল অনেক কম। প্যালিওলিথিক যুগের মানুষের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় ৫ ফুট (১৫২ সেমি)। নব্যপ্রস্তর যুগে (Neolithic Age) কৃষিকাজের শুরু এবং পুষ্টির উন্নতির সাথে মানুষের উচ্চতা সামান্য বাড়ে, কিন্তু তা কখনোই ৯০ ফুটের মতো অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছায়নি।
এখনকার দিনে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের গড় উচ্চতা বৈচিত্র্যময় হলেও গড় উচ্চতা সাধারণত ৫-৬ ফুটের মধ্যে থাকে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত কারণ উচ্চতা নির্ধারণে ভূমিকা রাখলেও, মানবদেহের গঠনের জন্য ৯০ ফুট উচ্চতা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।
স্কেলিং ল এবং স্কয়ার কিউব আইন (Square-Cube Law)
স্কয়ার-কিউব ল’ (Square-Cube Law) অনুযায়ী, একটি শরীরের আকার বৃদ্ধি পেলে তার ভলিউম এবং পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। অর্থাৎ, কোনো বস্তু বা জীবের উচ্চতা বাড়ালে তার ভলিউম ও ভর অনেক গুণ বেড়ে যায়।
যদি আদমের উচ্চতা ৯০ ফুট হতো, তবে তার শরীরের ভর প্রায় চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেত। সাধারণ উচ্চতার মানুষের হাড়ের গঠন সেই উচ্চতা ও ভর ধরে রাখতে সক্ষম, কিন্তু ৯০ ফুট উচ্চতার একটি মানুষের শরীরের হাড়, পেশী এবং সংযোজক টিস্যুগুলোর জন্য সেই পরিমাণ ভর ধরে রাখা অসম্ভব।
স্কয়ার-কিউব ল’ অনুযায়ী, কোনো বস্তুর উচ্চতা যদি ১০ গুণ বেড়ে যায়, তাহলে তার ভলিউম প্রায় ১০০০ গুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ, একজন মানুষের উচ্চতা ৯০ ফুট হলে তার ভর এবং ভলিউম এতটাই বেশি হবে যে, তার হাড় সেই ভর ধারণ করতে পারবে না, এবং হাঁটাচলা কিংবা দুই পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হবে।
ভারসাম্য এবং শারীরিক সীমাবদ্ধতা
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ৯০ ফুট উচ্চতার কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। যেহেতু মানবদেহ একটি দ্বিপদ প্রাণী, তার ভারসাম্য নির্ভর করে তার পা এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের ওপর। একটি স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষ মাধ্যাকর্ষণের কারণে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, কিন্তু ৯০ ফুট উচ্চতার একটি মানুষ এত বিশাল ভর নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, কারণ তার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র এত উঁচুতে থাকবে যে, তার পক্ষে নিজেকে সোজা রাখা কঠিন হবে। তার পা এবং হাড় এত বিশাল ভরকে ধারণ করতে পারবে না।
ফসিল রেকর্ড এবং মানুষের গড় উচ্চতা
মানব জাতির বিবর্তনের ফসিল রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, মানুষের গড় উচ্চতা কখনোই ৯০ ফুটের কাছাকাছি পৌঁছায়নি। মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল থেকে শুরু করে আধুনিক মানুষের ফসিল পর্যন্ত, উচ্চতা সর্বদা ৫ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাচীন মানুষের হাড়ের গঠন থেকে প্রমাণিত হয় যে, আধুনিক মানুষের উচ্চতা বৈচিত্র্যের সীমা ৭-৮ ফুটের মধ্যে থাকে।
ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী, প্রাচীন হোমিনিডদের মধ্যে উচ্চতা কখনোই এমন অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছায়নি। প্রাচীন মানুষের কাছাকাছি জাতি যেমন হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো নিয়ান্ডারথ্যালেনসিস এর উচ্চতা আধুনিক মানুষের সাথে তুলনীয় ছিল এবং তাদের ফিজিওলজিক্যাল সীমাবদ্ধতা ৯০ ফুট উচ্চতাকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দেয়।
জীববৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্যতা
মানুষের শরীরের কঙ্কাল কাঠামো এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সক্ষমতার মধ্যে এমন কোনো প্রমাণ নেই যা নির্দেশ করে যে, একটি মানবদেহ ৯০ ফুট উচ্চতা নিয়ে কার্যকর থাকতে পারে। প্রাচীন কালের মানুষদের শারীরিক গঠন ও আধুনিক মানুষের গঠনে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যা ৯০ ফুট উচ্চতা সমর্থন করে।
মানুষের হাড় এবং পেশী এত বিশাল ভর ধারণ করতে সক্ষম নয়। হাড়ের মধ্যে যে ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য উপাদান থাকে, তার সীমাবদ্ধতার কারণে এত বিশাল আকারের কোনো কঙ্কাল গঠন করা সম্ভব নয়। সেই সাথে, রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেন সরবরাহের জন্য এত বড় শরীরের জন্য প্রচুর শক্তি ও দক্ষতা প্রয়োজন হবে, যা বর্তমান মানবদেহের শারীরিক ক্ষমতার বাইরে।
উপসংহার
বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, আদমের ৯০ ফুট উচ্চতা ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি অংশ হলেও, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মানুষের গড় উচ্চতা কখনোই এত অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছায়নি এবং শারীরিক ও জীববৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী, ৯০ ফুট উচ্চতার কোনো মানবদেহ তৈরি হওয়া বা কার্যকরভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। স্কয়ার-কিউব ল’ এবং মানবদেহের ফসিল রেকর্ডের আলোকে, এই দাবি অসম্ভব এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে।
তথ্যসূত্র
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬২২৭ [↑]
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৯০০ [↑]
- বোখারী শরীফ, হামিদিয়া লাইব্রেরি, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"