ডগমা(Dogma) হলো এমন একটি মতবাদ বা বিশ্বাস, যা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, বা সমাজ দ্বারা অপরিবর্তনীয় ও প্রশ্নাতীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি যুক্তি, প্রমাণ বা মানুষের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নয়, বরং বিশ্বাস ও কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। ডগমা মূলত এমন ধারণা বা নীতি যা অনুসারীদের জন্য অপরিহার্য এবং যে কোনো ধরনের সন্দেহ বা চ্যালেঞ্জকে অগ্রাহ্য করে।
ডগমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি অনুসারীদের স্বাধীন চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ দেয় না। এর ফলে ডগমা মানুষের মুক্তভাবে চিন্তা করার পথ বন্ধ করে দেয়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এটি এমনকি সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, বা রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এটি নতুন ধারণা বা পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে ডগমা খুব সাধারণ ব্যাপার। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ধর্মে নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা নিয়ম পালনকে অপরিহার্য মনে করা হয়, যেমন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থকে অপরিবর্তনীয় ও পবিত্র হিসেবে মেনে নেওয়া। খ্রিস্টধর্মে, “ট্রিনিটি” বা ত্রিত্ববাদের ধারণা একটি ডগমা, যা অনুসারীদের জন্য নিঃশর্ত ও প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক। ইসলাম ধর্মে, কুরআন ও হাদিসের নির্ধারিত নিয়মাবলী ঈমানের সাথে মনে কোন রকম দ্বাধা বা সন্দেহ না রেখে যাচাই না করে মেনে নেয়াও একটি ডগমা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ডগমার উদাহরণ পাওয়া যায়। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, যেমন সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মার্ক্সবাদ বা লেনিনবাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য।
বিজ্ঞানের জগতকেও অনেক সময় ডগমার এই বিষ দ্বারা দূষিত করার চেষ্টা হয়েছে। তবে, বিজ্ঞান মূলত যুক্তি ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, দীর্ঘ সময় ধরে পটোলেমিয়াসের ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে (যেখানে পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়) ডগমা হিসেবে মানা হয়েছিল। এই নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন, কোন যুক্তি উপস্থাপণ, বিতর্ক করাকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে এটি চ্যালেঞ্জ করা হয়।
ডগমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটি সাধারণত নতুন জ্ঞান, যুক্তি বা পরিবর্তনের প্রতি প্রতিরোধী। এটি মানুষকে একধরনের স্থবিরতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে পারে। তবে, ডগমা মাঝে মাঝে সামাজিক ঐক্য ও পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে। এটি মানুষের মধ্যে এক ধরণের ঐক্য তৈরি করতে সাহায্য করে, এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সেটিও অনেক সময় খারাপ দিকে চলে যায়। বিশেষভাবে, ডগমা সর্বদাই স্বাধীন চিন্তার বিকাশকে দমিয়ে রাখতে চায়। তাই ডগমা বোঝার ক্ষেত্রে এর এর মারাত্মক প্রভাব ও সীমাবদ্ধতাগুলো বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের ক্ষেত্রেই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা যায়।