ইসলামিক বিশ্বাস অনুসারে, ফেরেশতা জিব্রাইলকে বিশেষ একটি সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি নবী মুহাম্মদের কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছেন। সহিহ হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, জিব্রাইলের ৬০০টি ডানা রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। এই ধারণাটি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলে অনেক অসঙ্গতি এবং অযৌক্তিকতা উঠে আসে। বিশেষত ডানা বা পাখনার ব্যবহার এবং উড্ডয়নের প্রয়োজনীয় শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করলে, এই ধরনের বিশ্বাসগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে খুবই অপ্রাসঙ্গিক এবং কল্পনাপ্রসূত বলে মনে হয়।
হিন্দু ধর্মে যেমন দূর্গা দেবীর দশ হাত, ব্রহ্মা দেবতার তিন মাথার কথা বলা আছে, ইসলামেও একইভাবে জিব্রাইলের ৬০০ ডানার কথা বলা আছে। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বে ভ্রমণের জন্য পাখনা কেন লাগে, আর এতগুলো পাখনা থাকার উপকারিতা কী, বেশি পাখনা থাকলে কীভাবে উড়ার ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন [1]
সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৫৯/ সৃষ্টির সূচনা
পরিচ্ছদঃ ৫৯/৭. তোমাদের কেউ যখন আমীন বলে আর আকাশের ফেরেশতাগণও আমীন বলে। অতঃপর একের আমীন অন্যের আমীনের সঙ্গে মিলিতভাবে উচ্চারিত হয় তখন পূর্বের পাপরাশি মুছে দেয়া হয়।
৩২৩২. আবূ ইসহাক শায়বানী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যির ইবনু হুবাইশ (রাঃ)-কে মহান আল্লাহর এ বাণীঃ ‘‘অবশেষে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের দূরত্ব রইল অথবা আরও কম। তখন আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা ওয়াহী করার ছিল, তা ওয়াহী করলেন’’- (আন্-নাজম ৯-১০)। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখেছেন। তাঁর ছয়শ’টি ডানা ছিল। (৪৮৫৬, ৪৮৫৭) (মুসলিম ১/৭৬ হাঃ ১৭৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০০২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
ডানার মূল কার্যক্রম: বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট
প্রকৃতিতে ডানা হলো উড়ন্ত প্রাণীদের একটি বিশেষ শারীরিক অঙ্গ, যা বায়ুর প্রতিরোধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উড়তে সহায়তা করে। পাখি, বাদুড়, এবং বিভিন্ন পতঙ্গের ডানার মাধ্যমে উড়ার পদ্ধতি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপাদানের সাথে সম্পর্কিত। ডানার কাজকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করতে হবে:
- ১. ডানার গঠন এবং এর এ্যারোডাইনামিক বৈশিষ্ট্য:
- প্রকৃতির উড়ন্ত প্রাণীদের ডানাগুলি বিশেষভাবে তৈরি হয় যাতে তারা বায়ুর প্রতিরোধকে হ্রাস করে এবং উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তোলন শক্তি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, পাখির ডানার গঠন এমনভাবে তৈরি হয় যাতে বায়ুর সঞ্চালনা এবং তাদের পেশীগুলোর সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল উড়াল সম্ভব হয়।
- কিন্তু যদি জিব্রাইলের ৬০০টি ডানা থাকে, তবে সেই ডানাগুলি কীভাবে কাজ করবে তা চিন্তা করা অত্যন্ত জটিল। ডানাগুলোর সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই বায়ু প্রতিরোধের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, যা উড়াল প্রক্রিয়াকে আরো কঠিন করে তুলবে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, অনেক বেশি ডানা থাকার ফলে পাখা গুলির মধ্যে সংঘর্ষ এবং বাতাসের প্রতিক্রিয়া আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে, যা উড্ডয়নের স্থায়িত্ব নষ্ট করবে। সুতরাং, ৬০০টি ডানা থাকার ধারণা প্রকৃতির বায়বীয় উড্ডয়নের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার সাথে মেলানো যায় না।
- ২. পাখনা এবং উড্ডয়নের দক্ষতা:
- পাখি বা পতঙ্গের ক্ষেত্রে, ডানার সংখ্যা বাড়ালে উড়াল ক্ষমতা বাড়বে, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে, ডানার সংখ্যা কম রেখে তাদের দক্ষতা বাড়ানোই উড়ন্ত প্রাণীদের জন্য বেশি কার্যকর। প্রকৃতিতে দেখা যায়, বড় এবং শক্তিশালী ডানার মাধ্যমে পাখিরা দীর্ঘ দূরত্বে উড়তে সক্ষম হয়, যেমন ঈগল বা শকুনের ক্ষেত্রে। আবার ছোট ডানার মাধ্যমে দ্রুত ও ক্ষিপ্র উড্ডয়ন সম্ভব, যেমন মৌমাছি বা মশার ক্ষেত্রে।
- তবে ৬০০টি ডানার মতো সংখ্যাধিক্য কোনো প্রাণীর উড়ালকে জটিল করে তুলবে। এতে বায়ুপ্রবাহের ধরণ এবং ডানাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হবে। বিজ্ঞান বলে যে, ডানার আকার, সংখ্যা এবং শক্তি সুনির্দিষ্ট ভারসাম্যে থাকতে হবে, যাতে প্রাণীটি সহজে উড়তে পারে। ৬০০টি ডানা এ ধরনের ভারসাম্য ভেঙে দেবে, এবং উড়াল প্রক্রিয়া কার্যত অসম্ভব হবে।
- ৩. বেশি ডানা থাকার অযৌক্তিকতা:
- জীববিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর উড্ডয়ন ক্ষমতা নির্ভর করে তার ওজন, ডানার আকার, এবং ডানার প্রতিস্থাপন ক্ষমতার উপর। পাখির ডানা বা পতঙ্গের পাখার সংখ্যা সাধারণত দুটি বা চারটি হয়, কারণ এই পরিমাণ ডানার মাধ্যমে বায়ুর প্রতিরোধ এবং ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
- ৬০০টি ডানা থাকলে, উড্ডয়ন করার জন্য একসাথে এত ডানা ব্যবহার করার শারীরিক সমন্বয় সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক বা কল্পিত ধারণা। অতিরিক্ত ডানা থাকা মানে অতিরিক্ত পেশী ও শক্তি প্রয়োজন, যা বাস্তব পৃথিবীর শারীরবৃত্তীয় প্রেক্ষাপটে অবাস্তব।
প্রাচীন মানুষের কল্পনাপ্রসূত গল্প তৈরি করার প্রবণতা
ডানার সংখ্যা নিয়ে অতিরঞ্জিত ধারণাগুলো প্রাচীন কালের মানুষের মধ্যে সাধারণ ছিল, কারণ তারা বিজ্ঞান ও প্রকৃতির আইন সম্পর্কে অবগত ছিল না। তারা বিভিন্ন অলৌকিক সত্তা, দেবতা বা ফেরেশতাদের বিশাল ক্ষমতা এবং বাহ্যিক গঠন নিয়ে বিভিন্ন গল্প তৈরি করত। যেমন হিন্দু ধর্মে দেবী দূর্গার দশ হাতের কথা বলা হয়েছে, যা প্রতীকী এবং অলৌকিক ক্ষমতার নির্দেশ করে। একইভাবে, ইসলামিক মিথলজিতে জিব্রাইলের ৬০০ ডানা থাকার ধারণা এসেছে, যা অলৌকিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হয়।
এই ধরনের গল্পগুলো মূলত প্রাচীন যুগের মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতা, অন্ধবিশ্বাস এবং কল্পনার সাথে মিশ্রিত। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায় এগুলোর কোনো স্থান নেই। বাস্তবিক প্রাণী ও সত্তারা বায়োলজিকাল এবং শারীরিক নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে অতিরিক্ত ডানা বা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তাদের উড়াল ক্ষমতা বা গতিশীলতাকে জটিল করে তোলে।
উপসংহার:
জিব্রাইলের ৬০০ ডানা থাকার ধারণাটি ইসলামিক বিশ্বাসের একটি অংশ, যা প্রাচীন কালের অলৌকিক চিন্তাভাবনা এবং কল্পনার সাথে জড়িত। তবে, বৈজ্ঞানিকভাবে এই ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বাস্তবতাবিরোধী। প্রকৃতির বায়োলজিকাল নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর উড্ডয়ন ক্ষমতা ডানার সংখ্যা বাড়িয়ে উন্নত করা যায় না। বরং অতিরিক্ত ডানা থাকার কারণে উড়াল প্রক্রিয়া আরও জটিল এবং অবাস্তব হয়ে উঠবে। সুতরাং, এই ধরনের ধারণাগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে শিশুতোষ রূপকথার গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
তথ্যসূত্র
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ৩২৩২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"