একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে কেঁদে ওঠে। এই কান্না প্রকৃতপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া, যা শিশুর জন্য অপরিহার্য। জন্মের পরপরই নবজাতকের কান্না তার শ্বাসপ্রশ্বাসের পথ পরিষ্কার করতে এবং ফুসফুসের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। যদি একটি শিশু জন্মের সময় কাঁদে না, এটি প্রায়শই শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যা চিকিৎসকের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু ইসলামী বিশ্বাসে নবজাতকের কান্নাকে শয়তানের খোঁচার ফল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা এক ধরনের অকল্যাণকর কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নবজাতকের কান্নার গুরুত্ব এবং কেন এটি ইসলামী বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা বিশ্লেষণ করা হবে।
নবজাতকের কান্নার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
প্রত্যেক নবজাতক জন্মের মুহূর্তে যখন প্রথম শ্বাস নেয়, তখন তাদের ফুসফুসে বাতাস ঢোকে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। মায়ের গর্ভের ভেতরে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মায়ের সঙ্গে সংযুক্ত আম্বিলিক্যাল কর্ড (নাভিরজ্জু) প্রয়োজন হয়। কিন্তু যখন নবজাতক গর্ভের বাইরে আসে, তখন এই কর্ডটি কেটে ফেলা হয়, ফলে শিশুকে নিজে থেকে শ্বাস নিতে হয়। শিশুর কান্না শ্বাসনালীর ফ্লুইড বের করে দিয়ে ফুসফুস প্রসারিত করে এবং নবজাতকের শ্বাসপ্রশ্বাস শুরু করতে সাহায্য করে।
কেন কান্না জরুরি?
নবজাতকের জন্মের সময় কেঁদে ওঠা একটি প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া। এর মূল উদ্দেশ্য হলো:
- শ্বাসনালীর পরিষ্কার করা: নবজাতকের শ্বাসনালী জন্মের সময় ফ্লুইড দিয়ে ভরা থাকে। কান্না করলে এই ফ্লুইডগুলি বেরিয়ে আসে, যার ফলে ফুসফুস স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে শুরু করে।
- ফুসফুসের প্রসারণ: প্রথম শ্বাসের সঙ্গে নবজাতকের ফুসফুস প্রসারিত হয় এবং অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ে। এই প্রসারণ নবজাতকের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু করতে সহায়ক হয়।
- অক্সিজেন সরবরাহ: কান্না শুরুর মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিকভাবে চালু হয়। এটি শিশুর মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে, যা তার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কান্নার অনুপস্থিতি এবং চিকিৎসা উদ্যোগ
যদি একটি নবজাতক জন্মের সময় না কাঁদে, এটি একটি গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এটি প্রায়শই শ্বাসনালীর বাধা, জন্মগত ত্রুটি, বা শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। চিকিৎসকেরা সাধারণত এ ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেন:
- পিঠ বা পা ঘষে কান্না উত্সাহিত করা: নবজাতককে কাঁদতে এবং শ্বাস নিতে উত্সাহিত করার জন্য চিকিৎসকেরা নবজাতকের পিঠ বা পা ঘষেন।
- শ্বাসনালীর শ্লেষ্মা পরিষ্কার করা: যদি শিশুর শ্বাসনালী ফ্লুইড বা শ্লেষ্মা দ্বারা ব্লক থাকে, তবে চিকিৎসকেরা শ্বাসনালী পরিষ্কার করার জন্য শোষণ যন্ত্র ব্যবহার করেন।
- অক্সিজেন সরবরাহ: যদি শিশুটি শ্বাস নিতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় এবং প্রয়োজন হলে আরও জটিল চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ইসলামী বিশ্বাস ও নবজাতকের কান্না
শিশুর কান্না একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা তার বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। ইসলামিক বিশ্বাসে একে শয়তানের খোঁচার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করাটা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভুল, বিভ্রান্তিকর এবং মানুষের মধ্যে এই কান্না সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়ক। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, জন্মের সময় নবজাতক শিশুর কান্না একটি শয়তানি কাজ, অর্থাৎ শয়তানের খোঁচার কারণে এটি ঘটে থাকে। যার থেকে বোঝা যায়, ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে এই কাজটি অকল্যাণকর এবং খারাপ ব্যাপার। অথচ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে এটি স্পষ্ট যে, জন্মের পর পর নবজাতকের কান্না তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বরঞ্চ না কান্নাই একটি অস্বাভাবিকত্বের লক্ষণ, যার সুচিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে[1]। ইসলাম বাচ্চাদের জন্মের সময় কান্নাকে শয়তানের খোঁচা হিসেবে চিহ্নিত করে একে একটি খারাপ বা অশুভ বিষয় বলে প্রচার করে, যা খুবই ভয়ঙ্কর বিষয়। এর ফলে জন্মের সময় বাচ্চারা না কাঁদলে পিতামাতা বা আত্মীয়রা সেই বাচ্চাকে ওলী আউলিয়া ভেবে নিতে পারে, কারণ তাকে শয়তানে খোঁচা দিতে পারে নি। এটি সুস্থ বাচ্চার লক্ষণ নয়, বরঞ্চ অসুস্থ বাচ্চার লক্ষণ। [2]
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৬০/ আম্বিয়া কিরাম (‘আঃ)
পরিচ্ছেদঃ ৬০/৪৪. মহান আল্লাহর বাণী
আর স্মরণ কর, কিতাবে মারিয়ামের ঘটনা। যখন তিনি স্বীয় পরিবার-পরিজন হতে পৃথক হলেন…..। (মারইয়াম ১৬) মহান আল্লাহর বাণীঃ স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বললঃ হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর তরফ থেকে তোমাকে একটি কালিমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। (আলে ইমরান ৪৫) মহান আল্লাহর বাণীঃ আল্লাহ্ আদম (আঃ), নূহ (আঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছেন…..বে-হিসাব দিয়ে থাকেন। (আলে ইমরান ৩৩-৩৭)
ঈব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, আলু-ইমরান অর্থাৎ মু’মিনগণ। যেমন, আলু-ইব্রাহীম, আলূ ইয়াসীন এবং আলু মুহাম্মাদ। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ সমস্ত মানুষের মধ্যে ইব্রাহীমের সব থেকে ঘনিষ্ঠ হলো তারা, যারা তাঁর অনুসরণ করে। আর তারা হলেন মু’মিনগণ। آلُ এর মূল হলো أَهْلُ আর أَهْلُ কে ছোট অর্থে করা হলে তা أُهَيْلٌ হয়।
৩৪৩১. আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, এমন কোন আদম সন্তান নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান স্পর্শ করে না। জন্মের সময় শয়তানের স্পর্শের কারণেই সে চিৎকার করে কাঁদে। তবে মারইয়াম এবং তাঁর ছেলে (ঈসা) (আঃ)-এর ব্যতিক্রম। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ্ বলেন, ‘‘হে আল্লাহ্! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট তাঁর এবং তাঁর বংশধরদের জন্য বিতাড়িত শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (৩২৮৬, মুসলিম ৪৩/৪০ হাঃ ২৩৬৬, আহমাদ ৭১৮৫) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩১৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩১৮৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৫৯/ সৃষ্টির সূচনা
পরিচ্ছদঃ ৫৯/১১. ইবলীস ও তার বাহিনীর বর্ণনা।
৩২৮৬. আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক আদাম সন্তানের জন্মের সময় তার পার্শ্বদেশে শয়তান তার দুই আঙ্গুল দ্বারা খোঁচা মারে। ‘ঈসা ইবনু মরয়াম (আঃ)-এর ব্যতিক্রম। সে তাঁকে খোঁচা মারতে গিয়েছিল। তখন সে পর্দার ওপর খোঁচা মারে। (৩৪৩১, ৪৫৪৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩০৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০৫৩)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
ধর্মীয় বিশ্বাস বনাম বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা
ইসলামি বিশ্বাসে নবজাতকের কান্নাকে অশুভ বা শয়তানের খোঁচা হিসেবে দেখা হলেও, বৈজ্ঞানিকভাবে এটি শিশুর স্বাভাবিক এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া। যদি শিশুটি জন্মের সময় না কাঁদে, তবে সেটি একটি বড় ধরনের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। শিশুর শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসনালীর ব্লকেজের মতো সমস্যা এর কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে যদি এমন ধারণা প্রচার করা হয় যে, নবজাতকের কান্না খারাপ বা অশুভ, তাহলে এটি পিতামাতা বা অভিভাবকদের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে।
যদি একটি নবজাতক কাঁদে না, তাহলে তারা ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করতে পারে যে, বাচ্চাটি বিশেষ বা অলৌকিক কোনো ক্ষমতার অধিকারী। এর ফলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উদ্যোগে দেরি হতে পারে, যা শিশুটির জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা
এই প্রবন্ধ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট:
- নবজাতকের কান্নার গুরুত্ব: বৈজ্ঞানিকভাবে এটি প্রমাণিত যে, নবজাতকের কান্না তার ফুসফুসের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে, শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে এবং অক্সিজেন প্রবাহ ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিজ্ঞান: ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু সেগুলি সবসময় বাস্তব জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নবজাতকের কান্নার ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট যে, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা একে একটি স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে।
উপসংহার
নবজাতকের কান্না একটি গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ইসলামি বিশ্বাসে এটি শয়তানের খোঁচা হিসেবে বিবেচিত হলেও, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে এটি একটি প্রাকৃতিক এবং জরুরি প্রক্রিয়া। জন্মের সময় নবজাতক না কাঁদলে, এটি শারীরিক জটিলতার ইঙ্গিত হতে পারে এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে। অতএব, ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নয়, বরং বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবতাভিত্তিক তথ্য থেকে অভিভাবকদের নবজাতকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৪৩১ [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩২৮৬ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"