নবী মুহাম্মদ কোথাও বলেছেন তার ঘরের ছাদ বিদীর্ণ করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কোথাও আবার বলেছেন কাবার হাতিম থেকে। মুহাম্মদের ঘরের ছাদ বিদীর্ণ করে এরপরে তাকে মিরাজে নেয়া হয়েছিল বলে যেখানে বর্ণিত আছে, সেটি শুরুতে দেখে নেয়া যাক, [1]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৮/ সালাত
পরিচ্ছেদঃ ২৪২। মি’রাজে কিভাবে সালাত ফরজ হল?
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৪২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৪৯
ইবন ’আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আমার কাছে আবূ সুফিয়ান ইবন হারব (রাঃ) হিরাকল-এর হাদীসে বর্ণনা করেছেন। তাতে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমদেরকে সালাত, সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছেন।
৩৪২। ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আবূ যার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল। তখন আমি মক্কায় ছিলাম। তারপর জিবরীল (আঃ) এসে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। আর তা যমযমের পানি দিয়ে ধুইলেন। এরপর হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি সোনার পাত্র নিয়ে আসলেন এবং তা আমার বক্ষে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। তারপর হাত ধরে আমাকে দুনিয়ার আসমানের দিকে নিয়ে চললেন। যখন দুনিয়ার আসমানে পৌঁছালাম, তখন জিবরীল (আঃ) আসমানের রক্ষককে বললেনঃ দরযা খোল। তিনি বললেনঃ কে? উত্তর দিলেনঃ আমি জিবরীল, আবার জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনার সঙ্গে আর কেউ আছে কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমার সঙ্গে মুহাম্মদ। তিনি আবার বললেনঃ তাঁকে কি আহবান করা হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেনঃ হাঁ।
তারপর আসমান খোলা হলে আমরা প্রথম আসমানে উঠলাম। সেখানে দেখলাম, এক লোক বসে আছেন এবং অনেকগুলো মানুষের আকৃতি তাঁর ডান পাশে রয়েছে এবং অনেকগুলো মানুষের আকৃতি বাম পাশেও রয়েছে। যখন তিনি ডান দিকে তাকাচ্ছেন, হাসছেন আর যখন তিনি বাম দিকে তাকাচ্ছেন, কাঁদছেন। তিনি বললেনঃ খোশ আমদেদ, হে পুণ্যবান নবী! হে নেক সন্তান! আমি জিবরীল (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলামঃ ইনি কে? তিনি বললেনঃ ইনি আদম (আঃ)। আর তাঁর ডানে ও বায়ে তাঁর সন্তানদের রুহ। ডান দিকের লোকেরা জান্নাতী আর বা দিকের লোকেরা জাহান্নামী। এজন্য তিনি ডান দিকে তাকালে হাসেন আর বাঁ দিকে তাকালে কাঁদেন। তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশে উঠলেন। সেখানে উঠে রক্ষক কে বললেনঃ দরযা খোল। তখন রক্ষক প্রথম আসমানের রক্ষকের অনুরুপ প্রশ্ন করলেন। তারপর দরযা খুলে দিলেন।
আনাস (রাঃ) বলেনঃ এরপর আবূ যার বলেনঃ তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসমানসমূহে আদম (আঃ), ঈদরীস (আঃ), মূসা (আঃ), ’ঈসা (আঃ), ও ইবরাহীম (আঃ)-কে পেলেন। আবূ যার (রাঃ) তাঁদের অবস্থান নির্দিষ্ট ভাবে বলেন নি। কেবল এতটুকু বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদম (আঃ)-কে প্রথম আসমানে এবং ইবরাহীম (আঃ)-কে ষষ্ট আসমানে পেয়েছেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ যখন জিবরীল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইদরীস (আঃ) এর পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ঈদরীস (আঃ) বললেনঃ খোশ আমদেদ! পুণ্যবান নবী ও নেক ভাই! আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইনি কে? জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ইনি ঈদরীস (আঃ)। তারপর আমি মূসা (আঃ) এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ খোশ আমদেদ! পূণ্যবান রাসূল ও নেক ভাই। আমি বললাম ইনি কে? জিবরীল (আঃ) বললেনঃ মূসা (আঃ)। তারপর আমি ঈসা (আঃ) এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ খোশ আমদেদ! পুণ্যবান রাসূল ও নেক ভাই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইনি কে? জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ইনি ঈসা (আঃ)।
তারপর ইবরাহীম (আঃ) এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ খোশ আমদেদ! পুণ্যবান নবী ও নেক সন্তান। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইনি কে? জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ইনি ইবরাহীম (আঃ)। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন যে, ইবনু হাযম আমাকে খবর দিয়েছেন ইবনু আব্বাস ও আবূ হাব্বা আনসারী (রাঃ) উভয়ে বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তারপর আমাকে আরো উপরে উঠানো হল, আমি এমন এক সমতল স্থানে উপনীত হলাম, যেখান থেকে কলমের লেখার শব্দ শুনতে পেলাম। ইবনু হাযম (রহঃ) ও আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তারপর আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামায/নামাজ) ফরয করে দিলেন। আমি এ নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালে যখন মূসা (আঃ) এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মূসা (আঃ) বললেনঃ আপনার উম্মতের উপর আল্লাহ কি ফরয করেছেন? আমি বললামঃ পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। তিনি বললেনঃ আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান। কারণ আপনার উম্মত তা আদায় করতে সক্ষম হবে না।
আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ পাক কিছু অংশ কমিয়ে দিলেন। আমি মূসা (আঃ) এর কাছে আবার গেলাম আর বললামঃ কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আপনি আবার আপনার রবের কাছে যান। কারণ আপনার উম্মত এও আদায় করতে সক্ষম হবে না। আমি ফিরে গেলাম। তখন আরো কিছু অংশ কমিয়ে দেওয়া হল। আবার মূসা (আঃ) এর কাছে গেলাম, এবারো তিনি বললেনঃ আপনি আবার আপনার রবের কাছে যান। কারণ আপনার উম্মত এও আদায় করতে সক্ষম হবে না। তখন আমি আবার গেলাম, তখন আল্লাহ বললেনঃ এই পাঁচই (সওয়াবের দিক দিয়ে) পঞ্চাশ (গণ্য হবে)। আমার কথার কোন পরিবর্তন নেই। আমি আবার মূসা (আঃ) এর কাছে আসলে তিনি আমাকে আবারো বলললেনঃ আপনার রবের কাছে আবার যান। আমি বললামঃ আবার আমার রবের কাছে যেতে আমি লজ্জাবোধ করছি। তারপর জিবরীল(আঃ) আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আর তখন তা বিভিন্ন রঙে ঢাকা ছিল, যার তাৎপর্য আমার জানা ছিল না। তারপর আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হল। আমি দেখলাম তাতে মুক্তার হার রয়েছে আর তাঁর মাটি কস্তুরি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
আরেকটি বিবরণে কাবার হাতিম বা হিজর থেকে নবীকে মিরাজে নেয়া হয়েছিল, যা পূর্বের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, কাবার হাতিমে কোন ছাদ নেই। নিচে কাবার হাতিমের একটি ছবি দেয়া হল, বোধগম্যতার উদ্দেশ্যে [2]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছেদঃ ২১৫১. মি’রাজের ঘটনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৬০৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৮৮৭
৩৬০৮। হুদবা ইবনু খালিদ (রহঃ) … মালিক ইবনু সা’সা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যে রাতে তাঁকে ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একদা আমি কা’বা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। কখনো কখনো রাবী (কাতাদা) বলেছেন, হিজরে শুয়েছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন এবং আমার এ স্থান থেকে সে স্থানের মধ্যবর্তী অংশটি চিরে ফেললেন। রাবী কাতাদা বলেন, আনাস (রাঃ) কখনো কাদ্দা (চিরলেন) শব্দ আবার কখনো শাক্কা (বিদীর্ণ) শব্দ বলেছেন। রাবী বলেন, আমি আমার পার্শ্বে বসা জারূদ (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, এ দ্বারা কী বুঝিয়েছেন? তিনি বললেন, হলকুমের নিম্নদেশ থেকে নাভী পর্যন্ত। কাতাদা (রহঃ) বলেন, আমি আনাস (রাঃ) কে এ-ও বলতে শুনেছি বুকের উপরিভাগ থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত। তারপর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন) আগন্তুক আমার হৃদপিণ্ড বের করলেন। তারপর আমার নিকট একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হল যা ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর আমার হৃদপিণ্ডটি (যমযমের পানি দ্বারা) ধৌত করা হল এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে পুনরায় রেখে দেয়া হল।
তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার নিকট আনা হল। যা আকারে খচ্চর থেকে ছোট ও গাধা থেকে বড় ছিল? জারূদ তাকে বলেন, হে আবূ হামযা, ইহাই কি বুরাক? আনাস (রাঃ) বললেন, হাঁ। সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। আমাকে তার উপর সাওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) চললেন, প্রথম আসমানে নিয়ে এসে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল, ইনি কে? তিনি বললেন জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। তখন বলা হল, তার জন্য খোশ-আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হল।
আমি যখন পোঁছালাম, তখন তথায় আদম (আলাইহিস সালাম) এর সাক্ষাত পেলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ। তারপর উপরের দিকে চলে দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তারপর বলা হল- তাঁর জন্য খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর খুলে দেওয়া হল। যখন তথায় পৌঁছালাম। তখন সেখানে ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) এর সাক্ষাত পেলাম। তাঁরা দু’জন ছিলেন পরস্পরের খালাত ভাই। তিনি (জিবরীল) বললেন, এরা হলেন ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম)। তাঁদের প্রতি সালাম করুন। তখন আমি সালাম দিলাম। তাঁরা জবাব দিলেন, তারপর বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
এরপর তিনি আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দিকে চললেন, সেখানে পৌঁছে জিবরীল বললেন খুলে দাও। তাঁকে বলা হল কে? তিনি উত্তর দিলেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠান হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর জন্য খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর দরজা খুলে দেওয়া হল। আমি তথায় পৌঁছে ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) কে দেখতে পেলাম। জিবরীল বললেন, ইনি ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) আপনি তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম, তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
তারপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্ব-যাত্রা করলেন এবং চতুর্থ আসমানে পৌঁছলেন। আর (ফিরিশ্তাকে) দরজা খুলে দিতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তখন বলা হল- তাঁর প্রতি খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তখন খুলে দেওয়া হল। আমি ইদ্রীস (আলাইহিস সালাম) এর কাছে পৌঁছলে জিবরীল বললেন, ইনি ইদ্রীস আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনিও জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
এরপর তিনি (জিবরীল) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্ব-যাত্রা করে পঞ্চম আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জিজ্ঞেস করা হল। তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর প্রতি খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তথায় পৌঁছে হারূন (আলাইহিস সালাম) কে পেলাম। জিবরীল বললেন, ইনি হারূন (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম; তিনিও জবাব দিলেন, এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
তারপর আমাকে নিয়ে যাত্রা করে ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। প্রশ্ন করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। ফিরিশ্তা বললেন, তাঁর প্রতি খোশ-আমদেদ। উত্তম আগন্তুক এসেছেন। তথায় পৌঁছে আমি মূসা (আলাইহিস সালাম) কে পেলাম। জিবরীল(আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনি মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম; তিনি জবাব দিলেন, এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
আমি যখন অগ্রসর হলাম তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কিসের জন্য কাঁদছেন? তিনি বললেন আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, যার উম্মত আমার উম্মত থেকে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে নিয়ে আমাকে নিয়ে সপ্তম আকাশের দিকে গেলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল, এ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে ডেকে পাঠান হয়েছে কি? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর প্রতি খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। আমি সেখানে পৌঁছে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কে দেখতে পেলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনি আপনার পিতা। তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ। তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো হল। দেখতে পেলাম, উহার ফল হাজার অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি এই হাতির কানের মত। আমাকে বলা হল, এ হল সিদরাতুল মুন্তাহা (জড় জগতের শেষ প্রান্ত)।
সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম, যাদের দু’টি ছিল অপ্রকাশ্য দু’টি ছিল প্রকাশ্য। তখন আমি জিবরীল (আলাইহিস সালাম) কে জিজ্ঞেস করলাম, এ নহরগুলো কী? অপ্রকাশ্য দু’টি হল জান্নাতের দুইটি নহর। আর প্রকাশ্য দুটি হল নীল নদী ও ফুরাত নদী। তারপর আমার সামনে ’আল-বায়তুল মামুর’ প্রকাশ করা হল, এরপর আমার সামনে একটি শরাবের পাত্র, একটি দুধের পাত্র ও একটি মধুর পাত্র পরিবেশন করা হল। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তখন জিবরীল বললেন, এ-ই হচ্ছে ফিতরাত (দ্বীন-ই-ইসলাম)। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত। তারপর আমার উপর দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত সালাম ফরয করা হল।
এরপর আমি ফিরে আসলাম। মূসা (আলাইহিস সালাম) এর সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে কী আদেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকে দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের আদেশ করা হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতে সমর্থ হবে না। আল্লাহর কসম। আমি আপনার আগে লোকদের পরীক্ষা করেছি এবং বনী ইসরাইলের হেদায়েতের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। তাই আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের(বোঝা) হাল্কা করার জন্য আবেদন করুন।
আমি ফিরে গেলাম। ফলে আমার উপর থেকে (দশ ওয়াক্ত সালাত (নামায/নামাজ) হ্রাস করে দিলেন। আমি আবার মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নিকট ফিরে এলাম তিনি আবার আগের মত বললেন, আমি আবার ফিরে গেলাম। ফলে আল্লাহ তা’আলা আরো দশ ওয়াক্ত সালাত কমিয়ে দিলেন। ফিরার পথে মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নিকট পৌঁছালে, তিনি আবার পূর্বোক্ত কথা বললেন, আমি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ তা’আলা আর দশ (ওয়াক্ত) হ্রাস করলেন। আমি মূসা (আলাইহিস সালাম) নিকট ফিরে এলাম। তিনি আবার ঐ কথাই বললেন আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আমাকে দশ (ওয়াক্ত) সালাতের আদেশ দেওয়া হয়। আমি (তা নিয়ে) ফিরে এলাম। মূসা (আলাইহিস সালাম) ঐ কথাই আগের মত বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম, তখন আমাকে পাঁচ (ওয়াক্ত) সালাতের আদেশ করা হয়।
তারপর মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নিকট ফিরে এলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কী আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম, দৈনিক পাঁচ (ওয়াক্ত) সালাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচ সালাত আদায় করতেও সমর্থ হবে না। আপনার পূর্বে আমি লোকদের পরীক্ষা করেছি। বনী ইসরাইলের হেদায়েতের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আপনি আপনার রবের নিকট ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য আরো সহজ করার আবেদন করুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আমার রবের নিকট (অনেকবার) আবেদন করেছি, এতে আমি লজ্জাবোধ করছি। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং তা মেনে নিয়েছি। এরপর তিনি বললেন, আমি যখন মূসা (আলাইহিস সালাম) কে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম, তখন জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলেন, আমি আমার অবশ্য পালনীয় আদেশটি জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের উপর লঘু করে দিলাম।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ মালিক ইবনু সা‘সা‘আ (রাঃ)
আসুন হাদিস দুইটি পাশাপাশি রেখে পড়ি [3] [4] –
আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, ঘটনা ঘটেছিল উম্মে হানীর ঘর থেকে। উম্মে হানীর মতে, অন্য কোথাও থেকে নয়। অর্থাৎ উম্মে হানী শুধু নিজের বক্তব্যই দেননি, অন্যদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যকে বাতিলও করেছেন। ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলাল্লাহ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মিরাজ হয়েছিল উম্মে হানির ঘর থেকে [5] [6]
রাসুলে করিমের (সা.) মিরাজ সম্পর্কে উম্মে হানী বিনতে আবু তালিব ওরফে হিন্দের কাছ থেকে কিছু বর্ণনা আমি পেয়েছি। তিনি বলেছেন, ‘আমার বাড়িতে থাকা অবস্থায়ই তিনি মিরাজে গেছেন, অন্য কোনো খান থেকে যাননি। সে রাতে তিনি আমার বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। সে রাতে তিনি এশার নামাজ পড়ে ঘুমাতে গেলেন। আমরাও ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরের একটু আগে রাসুলে করিম (সা.) আমাদের জাগিয়ে দিলেন। আমরা ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর তিনি বললেন, “উম্মে হানি, কালকে তো এইখানে এই উপত্যকায় আপনাদের সঙ্গে আমি এশার নামাজ পড়লাম। সে তো আপনি দেখেছিলেন। তারপর আমি জেরুজালেমে গেলাম এবং ওখানে নামাজ পড়লাম। আবার এখানে আমি এক্ষনি আপনাদের সঙ্গে ফজরের নামাজ পড়লাম, এই যেমন দেখলেন । তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আমি তাঁর জামা চেপে ধরলাম, তাতে টান লেগে তাঁর পেট উদাম হয়ে গেল, যেন আমি এক ভাঁজ করা মিসরীর কাপড় ধরে টেনেছিলাম। আমি বললাম, রাসুলুল্লাহ, এ কথা কাউকে যেন বলবেন। না, ওরা বলবে এটা মিথ্যা কথা, আপনাকে তারা অপমান করবে।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তাদের আমি বলবই।’
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, মুহাম্মদ ইবন সাইব কালবী…. উম্মে হানী বিনতে আবু তালিব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর মিরাজ সম্পর্কে বলেন, যেই রাত্রে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর মিরাজ সংঘটিত হয় সেই রাতে তিনি আমার বাড়ীতে শায়িত ছিলেন। ঈশার সলাত শেষে তিনি ঘুমিয়ে যান। আমরাও ঘুমিয়ে যাই। ফজরের সামান্য আগে তিনি আমাদেরকে জাগালেন। তিনি সালাত পড়লেন এবং আমরাও তাঁর সাথে (ফজরের) সালাত পড়লাম তখন তিনি বললেনঃ হে উম্মে হানী, তোমরা তো দেখেছো আমি তোমাদের সাথে ঈশার সালাত পড়ে তোমাদের এখানেই শুয়ে পড়ি। কিন্তু এরপরে আমি বাইতুল মুকাদ্দাস গমন করি এবং সেখানে সলাত আদায় করি। এখন ফজরের সলাত তোমাদের সাথে পড়লাম যা তোমরা দেখলে। উম্মে হানী বলেন, এই বলে তিনি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাঁর চাদরের কিনারা ধরে ফেললাম। ফলে তাঁর পেট থেকে কাপড় সরে গেল। তা দেখতে ভাঁজ করা কিবতী বস্ত্রের মত স্বচ্ছ ও মসৃণ। আমি বললাম : হে আল্লাহর নবী! আপনি এ কথা লোকদের কাছে প্রকাশ করবেন না। অন্যথায় তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং আপনাকে কষ্ট দেবে। কিন্তু তিনি বললেন : আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তাদের কাছে এ ঘটনা ব্যক্ত করব। তখন আমি আমার এক হাবশী দাসীকে বললাম ; বসে আছো কেন, জলদি, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)-এর সঙ্গে যাও, তিনি লোকদের কি বলেন তা শোনো, আর দেখো তারা কী মন্তব্য করে।
তথ্যসূত্র
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৪২ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৬০৮ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১২, হাদিসঃ ৩৬০৮ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০১, হাদিসঃ ৩৪২ [↑]
- সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ), অনুবাদ, শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২১৮ [↑]
- সীরাতুন নবী (সা.), ইবন হিশাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"