ইসলামের ইতিহাসে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদের চাচা এবং ইসলামের প্রথম যুগের একজন বিশিষ্ট সমর্থক। তবে কিছু বর্ণনায় দেখা যায়, নবীর চাচা হামজা বেশ ভাল পরিমাণ মদ্যপান করতেন এবং এক পর্যায়ে তিনি মদ্যপ অবস্থায় নবীকে ‘তার পিতার গোলাম’ বলে অপমানও করেছিলেন। এমন বক্তব্য প্রশ্ন জাগায়—কেন হামজা এমন মন্তব্য করেছিলেন? মদ্যপ অবস্থায় মানুষের মনের অপ্রকাশিত ভাবনাগুলো বেরিয়ে আসে বলে ধারণা প্রচলিত। যদি তাই হয়, তবে হামজা কি সত্যিই নবীকে তাদের পারিবারিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অবমূল্যায়ন করেছিলেন?
নবী মুহাম্মদের পিতা আবদুল্লাহ খুব অল্প বয়সেই মারা যান, ফলে তিনি অনাথ অবস্থায় বড় হন। প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরবর্তীতে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। তবে আবু তালিব নিজেও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত ছিলেন। ফলে নবী মুহাম্মদ কৈশোরে নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা ও মেষ চরানোর কাজ করতেন। হামজার বক্তব্য যদি সত্যিই উচ্চারণ করা হয়ে থাকে, তবে তা কি মুহাম্মদের শৈশবের আর্থিক দুরবস্থা এবং পরিবারের মধ্যে তার অবস্থানকে লক্ষ্য করে ছিল? যখন একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মদ্যপ অবস্থায় কাউকে অপমান করে, তা প্রায়ই লুকায়িত মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়। হামজার বক্তব্য কি শুধুই মদের প্রভাবে উচ্চারিত হয়েছিল, নাকি এর পেছনে পারিবারিক রহস্য, গোপন তাচ্ছিল্য বা অন্য কোনো মানসিক ব্যাপার কাজ করেছিল? ইসলামি ঐতিহ্য হামজাকে একজন বীর ও শহীদ হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তার অতীতের ঘটনাবলী প্রমাণ করে, মুহাম্মদের সাথে তার কোন না কোন পারিবারিক সমস্যা ছিল [1] [2] –
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩৭/ পানীয় দ্রব্য
পরিচ্ছেদঃ ১. মদ হারাম এবং আঙ্গুরের রস থেকে খুরমা ও কাঁচা-পাকা খেজুর এবং কিসমিস (ইত্যাদি) ও অন্যান্য নেশাকারক দ্রব্য হতে তা তৈরি হওয়ার বর্ণনা
৪৯৬৪। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া তামীমী (রহঃ) … আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে বদর দিবসে আমি গনীমত (যুদ্ধলব্ধ মাল) থেকে একটি বয়স্কা উটনী পেয়েছিলাম। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (খুমুস থেকে) আমাকে আর একটি বয়স্কা উটনী দিয়েছিলেন। একদিন আমি জনৈক আনসারী ব্যক্তির দরজার সামনে সে দুটি বসিয়ে রাখলাম। আমার ইচ্ছা ছিল, সে দুটির পিঠে করে কিছু ইযখির (ঘাস) বয়ে আনবো, আর তা বিক্রয় করে ফাতিমা (রাঃ) এর ওলীমায় সাহায্য নিব। আমার সাথে ছিল বনু কায়নুকা গোত্রের জনৈক স্বর্ণকার। হামযা ইবনু আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) সে বাড়িতেই মদ্যপান করছিল। তার সাথে ছিল একজন গায়িকা। সে (তার গানের মধ্যে) বললোঃأَلاَ يَا حَمْزَ لِلشُّرُفِ النِّوَاءِ অর্থাৎ হে হামযা! হৃষ্টপুষ্ট উটনী দুটির কাছে যাও (এবং তোমার মেহমানদের জন্য তা যবেহ কর)।
এরপর হামযা সে দু’টির কাছে তরবারিসহ ছুটে গেল। পরে দুটিরই কুঁজ কেটে ফেললো এবং তাদের পাঁজর (পেট) ফেঁড়ে ফেললো। এরপর সে এ দু’টির কলিজা বের করে নিল। আমি ইবনু শিহাবকে বললাম, (বর্ণনায় কি এ কথা আছে যে,) তিনি কুঁজ (গোশত) থেকেও নিলেন? তিনি বললেন, (এভাবে আছে) কুঁজ দুটি কেটে সাথে নিয়ে গেলেন।
ইবনু শিহাব বলেন, আলী (রাঃ) বলেন, এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গেলাম। তাঁর কাছে ছিল যায়দ ইবনু হারিসা। তারপর আমি তাঁকে সমস্ত ঘটনা অবহিত করলাম। তিনি যায়দকে সাথে নিয়ে বের হলেন। আমিও তার সঙ্গে চললাম। হামযার কাছে গিয়ে তাকে কিছু কড়া কথা বললেন। হামযা (মাদকগ্রস্ত অবস্থায়) চোখ তুলে বললো, তোমরা তো আমার বাবার গোলাম বৈ কিছু নও। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছু হেঁটে চললেন এবং এভাবে তিনি তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসলেন।
৪৯৬৫। আবদ ইবন হুমায়দ (রহঃ) …ইবন জুরায়জ (রহঃ) থেকে এ সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
বিঃ দ্রঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৯৬৪ পর পর দুইবার উল্লেখ করেছে। প্রথমটি কুরবানী অধ্যায়ের শেষ হাদিস আর পরেরটি এখানে উল্লেখিতটি। সিরিয়াল ধারাবাহিকতার জন্য আমরা ৪৯৬৫ নাম্বার হাদিসের অধীনে ফাউন্ডেশনের ৪৯৬৪ ও ৪৯৬৫ একসাথে দিয়েছি। এতে পরবর্তী নাম্বারগুলো ফাউন্ডেশনের নাম্বারের সাথে মিল থাকবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আলী ইবনু আবী তালিব (রাঃ)

ইতিহাসের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের অতীতকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ দেয়। হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের বক্তব্যের পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করা হলে, তা শুধু ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের অন্তর্গত পারিবারিক জটিলতাই নয়, বরং নবী মুহাম্মদের নিজের চরিত্রের বিকাশ ও চ্যালেঞ্জগুলোও বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। ইসলামি ঐতিহ্য প্রায়শই চরিত্রগুলিকে অতিমাত্রায় পবিত্র হিসেবে উপস্থাপন করলেও, বাস্তব চিত্রটি ভিন্ন রকম।কারণ লক্ষ্য করুন, মুহাম্মদ যখন তার আপন চাচা আবু তালিবের মেয়ে উম্মে হানীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, আবু তালিবের তা নাকচ করে বলেছিলেন, সম্মানীয়দের সমকক্ষ সম্মানীয়রাই হয়ে থাকে। কিন্তু বংশ মর্যাদায় আবু তালিব আর মুহাম্মদ তো সমকক্ষই হওয়ার কথা। তবে আবু তালিব এরকম কেন বললেন? আসুন সেই বিবরণটুকুও পড়ে নিই আসহাবে রাসুলের জীবনকথা গ্রন্থ থেকে [3] –
উম্মু হানী বিন্ত আবী তালিব (রা)
ইতিহাসে তিনি উম্মু হানী – এ ডাকনামে প্রসিদ্ধ । আসল নাম ফাতা, মতান্তরে হিন্দ। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মুহতারাম চাচা আবূ তালিব এবং মুহতারামা চাচী ফাতিমা বিত আসাদের কন্যা। ‘আকীল, জা’ফার, তালিব ও আলীর (রা) সহোদরা(১)। তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবনের কথা তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বিয়ে সম্পর্কে দু’একটি বর্ণনা দেখা যায়। যেমন রাসূল (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে চাচা আবূ তালিবের নিকট উম্মু হানীর বিয়ের পয়গাম পাঠান। একই সংগে হুবায়রা ইবন ‘আমর ইবন ‘আয়িয আল-মাখযূমীও পাঠান । চাচা হুবায়রার প্রস্তাব গ্রহণ করে উম্মু হানীকে তার সাথে বিয়ে দেন। নবী (সা) বললেন : চাচা! আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হুবায়রার সাথে তার বিয়ে দিলেন? চাচা বললেন : ভাতিজা! আমরা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করেছি। সম্মানীয়দের সমকক্ষ সম্মানীয়রাই হয়ে থাকে(২)। এতটুকু বর্ণনা। এর অতিরিক্ত কোন কথা কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় না। তবে হুবায়রা ইবন ‘আমরের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, সে কথা বিভিন্নভাবে জানা যায়(৩)।
উম্মু হানী কখন ইসলাম গ্রহণ করেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে একটু ভিন্নতা দেখা যায়। ইমাম আয-যাহাবী বলেনঃ(৪)
تأخر اسلامها وأسلمت يوم الفتح
“তাঁর ইসলাম গ্রহণ বিলম্বে হয়। তিনি মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন।’
তবে রাসূলুল্লাহর (সা) মি’রাজ সম্পর্কিত যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে উম্মু হানীর (রা) একটি বর্ণনাও বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। তাতে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহর (সা) মি’রাজ উম্মু হানীর ঘর থেকে হয়েছিল এবং তিনি তখন একজন মুসলমান। আর এটা হিজরাতের পূর্বের ঘটনা। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) ইসরা’ (মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাসে রাত্রিকালীন ভ্রমণ) আমার ঘর থেকেই হয়। সে রাতে তিনি ‘ঈশার নামায আদায় করে আমার ঘরে ঘুমান। আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ফজরের অব্যবহিত পূর্বে তিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগান। তারপর তিনি ফজরের নামায পড়েন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়ি। তারপর তিনি বলেন : উম্মু হানী! তুমি দেখেছিলে, গতরাতে আমি এই উপত্যকায় ‘ঈশার নামায আদায় করেছিলাম। তারপর আমি বাইতুল মাকদাসে যাই এবং সেখানে নামায আদায় করি। আর এখন আমি ফজরের নামায তোমাদের সাথে
……………………
১. সীরাতু ইবন হিশাম, ২/৪২০; আ’লাম আন-নিসা, ৪/১৪ আল-ইসতী আব, ২/৭৭২ ২. আ’লাম আন-নিসা-৪/১৪ ৩. উসুদুল গাবা- ৫/624 ৪. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/৩১

তথ্যসূত্র
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৯৬৪ [↑]
- সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ১৭-১৮ [↑]
- আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, মহিলা সাহাবী, মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৮ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"