ভূমিকা
দুর্ভিক্ষ মানবতার ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। এটি শুধু খাদ্যের অভাব বা অর্থনৈতিক সমস্যার ফলাফল নয়, বরং সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের একটি প্রতীক। দুর্ভিক্ষের সময় একজন মানুষ বা সমাজ যেভাবে তার মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণে ব্যর্থ হয়, সেটি মানুষের অস্তিত্বের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দুর্ভিক্ষের সময় সাধারণ মানুষের মৃত্যু, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি, এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দুর্ভিক্ষের সময় সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করে।
দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞা ও প্রেক্ষাপট
দুর্ভিক্ষ বলতে সাধারণত খাদ্যের চরম অভাবকে বোঝানো হয়, যার ফলে সমাজের একটি বিশাল অংশ অনাহারে ভুগতে থাকে। তবে শুধু খাদ্যের অভাবই নয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটও দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হতে পারে। দুর্ভিক্ষকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘস্থায়ী খাদ্যসংকট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যেখানে সামাজিক বা প্রাকৃতিক কারণগুলোর সমন্বয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, যেমন—১৮৪৫ সালের আইরিশ আলুর দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ, ১৯৫৮ সালের চীনের গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের সময়কার দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৮৪ সালের ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ। এসব দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং অগণিত মানুষ শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভুগেছে।
শিশুদের ওপর দুর্ভিক্ষের প্রভাব
দুর্ভিক্ষের সময় শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে, কারণ তাদের শরীর এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা বেশি। দুর্ভিক্ষের সময় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, রোগপ্রবণতা এবং মৃত্যু হার বৃদ্ধি পায়। অপুষ্টির কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের মেধা এবং শারীরিক সক্ষমতা কম হয়। তাদের শিক্ষাগত অগ্রগতি এবং পেশাগত জীবনে উন্নতি করার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ভিক্ষের সময় পুষ্টির অভাবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে তাদের মধ্যে ডায়রিয়া, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া দুর্ভিক্ষের কারণে শিশুরা মানসিকভাবে ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, যা তাদের পরবর্তী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে, একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষ
ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষকে একটি শাস্তি এবং পরীক্ষা হিসেবে দেখা হয়। হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, নবী মুহাম্মদ শত্রুতাবশত কিছু গোত্র বা জনগোষ্ঠীর ওপর দুর্ভিক্ষের দোয়া করতেন, যেন তাদের ওপর প্রবল দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। হাদিসে বর্ণিত আছে, একবার মুযার গোত্রের ওপর আল্লাহর কঠোর শাস্তির জন্য দোয়া করেছিলেন এবং ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর যমানার দুর্ভিক্ষের ন্যায় কয়েক বছরের জন্য দুর্ভিক্ষের প্রার্থনা করেছিলেন। এ ধরনের অভিশাপ মুহাম্মদের নিচু মন মানসিকতার পরিচয় দেয়, এবং যার ফলে তাকে একজন সাইকোপ্যাথ হিসেবে তাকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। কারণ দুর্ভিক্ষ মানুষ বেছে ক্ষতি করে না। দুর্ভিক্ষের প্রভাব সবচাইতে বেশি ভোগায় অসহায় মানুষদের, নারী শিশু ও প্রতিবন্ধীদের। আসুন এই সম্পর্কিত হাদিসগুলো পড়ে নেয়া যাক,
সহীহ বুখারী
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
অধ্যায়ঃ ১৫/ বৃষ্টির জন্য দু’আ
হাদিস নাম্বার: 952
৯৫২। কুতাইবা ইবনু সায়ীদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শেষ রাকাআত থেকে মাথা উঠালেন, তখন বললেন, হে আল্লাহ! আইয়্যাশ ইবনু আবূ রাবী’আহকে মুক্তি দিন। হে আল্লাহ! সালামা ইবনু হিশামকে মুক্তি দিন। হে আল্লাহ! ওয়ালীদ ইবনু ওয়ালীদকে রক্ষা করুণ। হে আল্লাহ! দুর্বল মু’মিনদেরকে মুক্তি দিন। হে আল্লাহ! মুযার গোত্রের উপর আপনার শাস্তি কঠোর করে দিন। হে আল্লাহ! ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর যমানার দুর্ভিক্ষের বছরগুলোর ন্যায় (এদের উপর) কয়েক বছর দুর্ভিক্ষ দিন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বললেন, গিফার গোত্র, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর আসলাম গোত্র, আল্লাহ তাদেরকে নিরাপদে রাখুন। ইবনু আবূ যিনাদ (রহঃ) তাঁর পিতা থেকে বলেন, এ সমস্ত দু’আ ফজরের সালাত (নামায/নামাজ)-এ ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ বুখারী
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
অধ্যায়ঃ ১৫/ বৃষ্টির জন্য দু’আ
৯৫৩। হুমাইদী ও উসমান ইবনু আবূ শাইবা (রহঃ) … আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন লোকদেরকে ইসলাম বিমুখ ভুমিকায় দেখলেন, তখন দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর যামানার সাত বছরের (দুর্ভিক্ষের) ন্যায় তাঁদের উপর সাতটি বছর দুর্ভিক্ষ দিন। ফলে তাঁদের উপর এমন দুর্ভিক্ষ আপতিত হল যে, তা সব কিছুই ধ্বংস করে দিল। এমনকি মানুষ তখন চামড়া, মৃতদেহ এবং পচা ও গলিত জানোয়ারও খেতে লাগলো। ক্ষুদার তাড়নায় অবস্থা এতদূর চরম আকার ধারণ করল যে, কেউ যখন আকাশের দিকে তাকাত তখন সে ধুঁয়া দেখতে পেত। এমতাবস্থায় আবূ সুফিয়ান (ইসলাম গ্রহনের পূর্বে) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, হে মুহাম্মদ! তুমি তো আল্লাহর আদেশ মেনে চল এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার আদেশ দান কর। কিন্তু তোমার কওমের লোকেরা তো মরে যাচ্ছে। তুমি তাঁদের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ কর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা বলেছেনঃ
আপনি সে দিনটির অপেক্ষায় থাকুন যখন আকাশ সুস্পষ্ট ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে সেদিন আমি প্রবলভাবে তোমাদের পাকড়াও করব”। (৪৪ঃ ১০-১৬)
আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, সে কঠিন আঘাত এর দিন ছিল বদরের যুদ্ধের দিন। ধুঁয়াও দেখা গেছে, আঘাতও এসেছে। আর মক্কার মুশরিকদের নিহত ও গ্রেফতারের যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তাও সত্য হয়েছে। সত্য হয়েছে সুরা রুম-এর এ আয়াতও (রুমবাসী দশ বছরের মধ্যে পারসিকদের উপর আবার বিজয় লাভ করবে)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উপসংহার
দুর্ভিক্ষ মানব ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। এটি কেবলমাত্র একটি জাতির খাদ্য সংকট নয়, বরং তাদের সম্পূর্ণ জীবনযাত্রার ওপর একটি বিরাট আঘাত। দুর্ভিক্ষের সময় শিশু, নারী, বৃদ্ধ, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করে। আমরা আমাদের চরমতম শত্রুকেও কোনদিন দুর্ভিক্ষের অভিশাপ দিতে পারি না। কেউ কোন অন্যায় করলে, শুধুমাত্র সেই অন্যায়কারীকেই আমরা তার জন্য দায়বদ্ধ করতে পারি, এবং তার বিচার কামনা করতে পারি। কিন্তু যারা এই অন্যায়ের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, তারাও যদি ক্ষতিগ্রন্থ হয়, ভুক্তভোগী হয়, তাহলে আমরাও সেখানে এক একজন অন্যায়কারীতেই তো পরিণত হলাম। তাহলে সেই অন্যায়কারী আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য রইলো কোথায়?