বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে একটি প্রচলিত প্রশ্ন আমরা প্রায়ই শুনে থাকি: “বানর থেকে মানুষ আসলে এখন কেন বানররা মানুষে পরিণত হচ্ছে না?” বা, “যদি মানুষ বানর থেকে উদ্ভূত হয়, তবে কেন এখনো বানর আছে?” এই প্রশ্নগুলো প্রায়শই সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বক্তারা উপস্থাপন করেন এবং বিভিন্ন বক্তৃতা বা আলোচনায় এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। প্রশ্নটি শুনেই বোঝা যায় যে, প্রশ্নকারীরা বিবর্তন তত্ত্বের প্রাথমিক তথ্যগুলো সম্পর্কেও অজ্ঞ। এই নিবন্ধে আমরা বিবর্তন তত্ত্বের প্রকৃত ব্যাখ্যা, ভুল ধারণাগুলোর অপসারণ এবং এর প্রমাণসমূহ পর্যালোচনা করব। তার আগে একটি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যাক। বলুন তো, আদমকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়ে থাকলে, এখনো মাটি আছে কেন? এই প্রশ্নের যেই উত্তরটি আপনি মনে মনে ভাবছেন, সেটিই আপনার প্রশ্নেরও উত্তর।
বিবর্তন তত্ত্ব: সাধারণ ভুল ধারণা
প্রথমেই যেটি পরিষ্কার করতে হবে, তা হলো, বিবর্তন তত্ত্ব বলে না যে, বানর থেকে সরাসরি মানুষ তৈরি হয়েছে বা বানরগুলো হঠাৎ করেই একদিন মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বিবর্তন একটি ধীর প্রক্রিয়া, যা লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে ঘটে। আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) এবং আধুনিক বানর বা শিম্পাঞ্জি (Pan troglodytes) উভয়েই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা এখন বিলুপ্ত। আমরা সরাসরি শিম্পাঞ্জি বা অন্যান্য আধুনিক প্রাইমেটদের উত্তরসূরী নই, বরং আমরা এবং তারা উভয়ই একটি বহু পূর্বের প্রজাতির আলাদা শাখায় বিবর্তিত হয়েছি।
সাধারণ পূর্বপুরুষ এবং বিবর্তনবৃক্ষ
প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে, প্রাথমিক প্রাইমেটদের মধ্যে থেকে একটি শাখা বিবর্তিত হয়ে মানব প্রজাতির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। একই সময়ে, অন্য একটি শাখা বিবর্তিত হয়ে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের দিকে নিয়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি একে অপরের থেকে উদ্ভূত নয়, বরং উভয়েই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে।
বিবর্তনের পথচিত্র অনেকটা গাছের মতো যেখানে একটি সাধারণ মূল থেকে বিভিন্ন ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি শাখা একটি নতুন প্রজাতির দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, ওরাং ওটাং, গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ বিভিন্ন সময়ে সেই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে এবং পৃথক প্রজাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছে। [1]
বিবর্তন ও প্রজাতির উদ্ভব
বিবর্তন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণাটি বুঝতে হলে আমাদের “প্রজাতির উদ্ভব” সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটার প্রধান প্রক্রিয়াটি হলো “প্রজননগত বিচ্ছিন্নতা”। যখন একটি প্রজাতির একটি উপগোষ্ঠী কোন কারণে অন্য উপগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন দুটি গোষ্ঠী আলাদা আলাদা পরিবেশগত ও জিনগত প্রভাবের অধীনে বিবর্তিত হতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে এই পরিবর্তনগুলি এতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যে, দুটি গোষ্ঠী প্রজনন করতে সক্ষম হয় না। তখন তারা দুটি ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে, মানুষের পূর্বপুরুষ শিম্পাঞ্জি এবং গরিলার পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে আমরা Homo sapiens এ বিবর্তিত হয়েছি। এটি একটি দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে এবং প্রতিটি ধাপেই ছোট ছোট পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষরা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ক্রমাগত অভিযোজন করেছে, যার ফলস্বরূপ আধুনিক মানুষ তৈরি হয়েছে।
“সব বানর মানুষে পরিণত হয়নি কেন?”
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের প্রথমেই বিবর্তনের বহুমুখী প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে হবে। বিবর্তন মানে এক প্রজাতির পুরোপুরি অন্য প্রজাতিতে রূপান্তর নয়। পরিবেশগত প্রয়োজন, খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রজনন ক্ষমতা, প্রতিযোগিতা, জিনগত কারণ এবং অন্য অনেক কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি প্রজাতি এক ধরণের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে যদি সেটি তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়। যারা এই বৈশিষ্ট্যটি অর্জন করতে সক্ষম হয়, তারা তাদের বংশধরদের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যটি প্রেরণ করে। একইভাবে, যদি কোন প্রজাতির একটি উপগোষ্ঠী পরিবেশগতভাবে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তবে সেই উপগোষ্ঠীটি আলাদা হয়ে একটি নতুন প্রজাতিতে বিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আগের প্রজাতি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই, আধুনিক বানরদের বিবর্তনগত ধারা ভিন্ন পথে চলছে এবং আমরা যে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছি, তা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।
বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রমাণসমূহ
বিবর্তন তত্ত্বের সত্যতা সম্পর্কে অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো:
- ফসিল রেকর্ড: পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে জীবাশ্মগুলোর স্তরের ওপর ভিত্তি করে জীবের ক্রমান্বয়ে বিবর্তন বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আর্কিওপটেরিক্স একটি ট্রানজিশনাল ফসিল যা পাখি এবং সরীসৃপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, দেখায় কিভাবে প্রজাতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। মানবজাতির ফসিল রেকর্ড, যেমন “লুসি” (Australopithecus afarensis), মানুষের বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে ধরা হয়।
- জিনগত প্রমাণ: মানব ও শিম্পাঞ্জির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে তাদের ডিএনএ ৯৮.৮% মিল আছে। এই উচ্চতর মিল মানব ও শিম্পাঞ্জির মধ্যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। জিনগত গবেষণা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনীয় সম্পর্ক স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। [2]
- অঙ্গসংস্থানগত প্রমাণ: বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে শরীরের গঠনগত সাদৃশ্য রয়েছে, যা তাদের একক উৎস বা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হওয়ার প্রমাণ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের হাত, তিমির পাখনা, এবং বাদুড়ের পাখার হাড়ের গঠন অনেকটাই একরকম, যদিও তারা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়। এ ধরনের সাদৃশ্য বিবর্তনের প্রমাণ প্রদান করে।
- পর্যবেক্ষণযোগ্য বিবর্তন: জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মাইক্রো-বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বিবর্তিত হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা সরাসরি বিবর্তনের প্রমাণ। এই প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকে এবং প্রজননের মাধ্যমে প্রতিরোধী জিনগুলি ছড়িয়ে দেয়, যা বিবর্তনের একটি উদাহরণ।
বানর এবং মানুষের বিবর্তন: বিজ্ঞান এবং সমাজের ভুল ব্যাখ্যা
বিবর্তন তত্ত্ব একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যা বহু পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এটি কোনো অনুমান নয়, বরং বহু প্রমাণ এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। তবে সমাজে এখনো অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, যেমন “মানুষ সরাসরি বানর থেকে উদ্ভূত হয়েছে” বা “বিবর্তন একটি তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া”। বিবর্তনতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ অনেকেই মনে করেন, একটি বানর হয়তো লাফাতে লাফাতে মানুষে পরিণত হয়েছে, এটিই হয়তো বিবর্তনতত্ত্ব! অথচ, এগুলো একদমই সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের অপপ্রচার। এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয় এবং প্রায়শই ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার
বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং ভুল তথ্যের কারণে অনেক মানুষ বিভ্রান্তিতে ভোগেন। “বানর থেকে মানুষ” ধারণাটি বিবর্তন তত্ত্বের সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা এবং এটি শুধুমাত্র বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। মানুষ এবং বানর উভয়েই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তন নির্ভর করে পরিবেশের প্রয়োজন এবং প্রজননগত বিচ্ছিন্নতার উপর। বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে থাকা বিশাল প্রমাণের আলোকে এটি স্পষ্ট যে, বিবর্তন একটি বৈজ্ঞানিক সত্য, যা আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রজাতির পরিবর্তনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা প্রদান করে।
মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে হলে প্রকৃতিতে এখনও বানর আছে কীভাবে – এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন খ্যাতনামা ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স,
তথ্যসূত্র
- Dawkins, R. (2009). The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution. Bantam Press. [↑]
- Campbell, N. A., & Reece, J. B. (2005). Biology (7th ed.). Pearson. [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"