ভূমিকা:
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ বৈবাহিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, তালাকের অধিকারের প্রধান নিয়ন্ত্রণ স্বামীর হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। স্ত্রী কেবলমাত্র তালাক চাইতে পারেন, কিন্তু নিজ থেকে তালাক দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে, স্ত্রী যদি তালাকের অধিকার পেতে চান, তাহলে স্বামীকে তাকে সেই অধিকার প্রদানে সম্মতি জানাতে হবে। এটি শুধু একটি শর্তসাপেক্ষ অধিকার, যা স্বামী স্ত্রীকে বিবাহের শুরুর সময় বা পরবর্তী সময়ে লিখিতভাবে প্রদান করতে পারেন। এর ফলে, স্ত্রী স্বতন্ত্রভাবে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হন এবং তালাকের জন্য স্বামীর দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র অল্পকিছু ঘটনার ক্ষেত্রে একজন স্ত্রী নিজ ইচ্ছায় তালাক চাইতে পারে, যেমন স্বামী মুরতাদ হয়ে গেলে বা পাগল হয়ে গেলে। এই প্রবন্ধে আমরা তালাক প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকার সীমাবদ্ধতা, এই প্রথার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আধুনিক সমাজে নারীর সমানাধিকারের দৃষ্টিতে এর সমস্যাগুলো তুলে ধরবো।
তালাকের অধিকারে বৈষম্য: ধর্মীয় প্রেক্ষাপট
ইসলামের আইন অনুযায়ী, বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য তালাকের অধিকার একতরফাভাবে স্বামীর হাতে থাকে। স্বামী যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনবার “তালাক” শব্দ উচ্চারণ করে বা লিখিতভাবে জানিয়ে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী নিজ থেকে এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। স্ত্রী যদি তালাক চান, তবে তাকে “খুলা” (বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া, যেখানে স্ত্রী স্বামীর কাছে তালাকের আবেদন করেন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। এতে স্ত্রীর নিজের সম্পদ বা দেনমোহর ফিরিয়ে দিতে হয়, যা কখনও কখনও তার আর্থিক স্বাবলম্বীতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
আসুন দেখে নেয়া যাক, তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনে কী বলা আছে, [1] –
এর অর্থ হচ্ছে, ইসলামি শরিয়তের বিধান হচ্ছে, তালাক দেয়ার অধিকার একমাত্র স্বামীর। স্ত্রীর তালাক দেয়ার কোন অধিকার নেই, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সে তালাক চাইতে পারে। সেখানেও আছে প্রবল সমস্যা [2] –
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
অধ্যায়ঃ পর্ব-১৩ঃ বিবাহ
পাবলিশারঃ হাদিস একাডেমি
পরিচ্ছদঃ ১১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – খুল্‘ই (খুলা‘ তালাক) ও তালাক প্রসঙ্গে
৩২৭৯-(৬) সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে রমণী বিনা কারণে স্বামীর নিকট তালাক চায়, সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ, দারিমী)(1)
(1) সহীহ : আবূ দাঊদ ২২২৬, তিরমিযী ১১৮৭, ইবনু মাজাহ ২৫০০, দারিমী ১৩১৬, আহমাদ ২২৪৪০, ইরওয়া ২০৩৫, সহীহ আল জামি‘ ২৭০৬, সহীহ আত্ তারগীব ২০১৮।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
ব্যাখ্যাঃ
ব্যাখ্যা: তালাক স্বামীর অধিকার, স্ত্রীর নয়। স্ত্রীর সঙ্গত কারণ থাকলে খুলা‘র মাধ্যমে সে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। কোনো মহিলা একান্ত কারণ ছাড়া স্বামীর কাছ থেকে তালাক প্রার্থনা করবে না। কোনো কোনো বর্ণনায় এ কথাও এসেছে, কোনো মহিলা নিজের জন্য অথবা অন্যের জন্য তালাক প্রার্থনা করবে না।
যে নারী বিনা কারণে তার স্বামীর কাছে তালাক প্রার্থনা করবে তার জন্য জান্নাতের ঘ্রাণ হারাম অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটা ভীতি ও ধমকিমূলক বাক্য। মুহসিন বা নেককারগণ যেমন প্রথম ধাপেই জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবেন তারা সেই সুঘ্রাণ পাবে না। ‘আল্লামা কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ এটাও হতে পারে যে, যদি সে জান্নাতে প্রবেশ করে তবে সুঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত থাকবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
এবারে আসুন ফিকহে ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু গ্রন্থ থেকে তৃতীয় খলিফা ওসমানের সময়ে আইনটি দেখে নিই, [3]
এবারে আসুন একটি ফতোয়া দেখে নিই [4] –
ইসলামের প্রথাগত আইন: নারীর প্রতি বৈষম্য
তালাকের প্রথাগত ইসলামী আইনে স্ত্রীকে সম্পূর্ণভাবে তালাকের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এটি পুরুষের হাতে একতরফা ক্ষমতা তুলে দেয়, যা নারীর প্রতি একটি বড় ধরনের বৈষম্যের উদাহরণ। স্বামীর ক্ষমতার কারণে অনেক স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েও বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে অস্বীকৃতি জানালে, স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতে হয়, যা তাদের স্বাধীনতা এবং সম্মানহানির কারণ হতে পারে।
নারী অধিকার এবং মানবাধিকারের দৃষ্টিতে, এই ধরনের বৈষম্যমূলক আইন সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। নারীরও পুরুষের সমানভাবে তালাকের অধিকার থাকা উচিত, কারণ বিবাহ একটি সামাজিক বন্ধন এবং এটি দুইজন মানুষের সম্মতি এবং সমান দায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামের এই তালাক ব্যবস্থা নারীর উপর একতরফা কর্তৃত্ব আরোপ করে, যা তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। ইসলাম কীভাবে একজন নারীর মানবিক মর্যাদাকে ধ্বংস করে, তার একটি নমুনা দেখি,
মানবাধিকার লঙ্ঘন: নারীর স্বাধীনতা খর্ব
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তির সমানভাবে স্বাধীনতা, অধিকার এবং মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা (Universal Declaration of Human Rights) এর ১৬তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিবাহে প্রবেশ এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে।” এ ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হলো—যেকোনো ধরনের বৈষম্য দূর করা এবং নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু ইসলামের প্রথাগত তালাক ব্যবস্থায় এই অধিকার নারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না। একজন পুরুষ যদি যেকোনো সময় তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন, তাহলে একজন স্ত্রী কেন একই অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না? এটি নারীর মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে এবং তাকে বিবাহের সময় স্বামীর ইচ্ছার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল করে তোলে। এমনকি খোলার প্রক্রিয়ায়ও যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে সম্মত না হন, তবে স্ত্রী বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন, যা একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া।
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
তালাক প্রক্রিয়ায় এই ধরনের বৈষম্য শুধুমাত্র নারীর আইনি অধিকারকে খর্ব করে না, এটি তাদের মানসিক এবং সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অনেক নারী এই একতরফা আইন ব্যবস্থার কারণে অবর্ণনীয় মানসিক কষ্ট এবং অবহেলার শিকার হন। স্বামীর হাতে তালাকের ক্ষমতা থাকার ফলে নারীরা নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং অনেক সময় নিগ্রহ, নির্যাতন এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েও বিবাহে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হন।
এই পরিস্থিতিতে, নারী ও পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে সমাজে প্রশ্ন ওঠে। স্বামী যখন চাইলেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে পারেন, অথচ স্ত্রীকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আদালতের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, তখন এটি একটি প্রমাণ যে, নারীকে বিবাহ বন্ধনে বাধ্য করে রাখা হয় এবং তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আইন নারীর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা এবং আত্মমর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করে।
আধুনিক সমাজে নারীর অধিকার এবং স্বাধীনতা
আধুনিক সমাজে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অংশগ্রহণ করছেন। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু ইসলামের প্রথাগত তালাক ব্যবস্থায় নারীর সমানাধিকার এবং স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়, যা আধুনিক সমাজের নীতি এবং মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করা, তাকে একজন পুরুষের অধীনস্থ করে রাখা, এবং তার অধিকারকে অগ্রাহ্য করা একধরনের সামাজিক বৈষম্য এবং নিপীড়ন।
আধুনিক সমাজে নারীর অবস্থান এখন পুরুষের সমকক্ষ। নারী শিক্ষিত, কর্মক্ষেত্রে দক্ষ এবং স্বাবলম্বী। তাহলে কেন তাঁকে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নিচু অবস্থানে রাখা হবে? নারীদের এই ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজন একটি আইনগত এবং সামাজিক পরিবর্তন। নারীদের স্বামীর মতোই তালাকের অধিকার থাকা উচিত, এবং বিবাহ বিচ্ছেদ তাদের ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে সমানভাবে নির্ধারণ করা উচিত।
উপসংহার
ইসলামের শরীয়া আইনে তালাক ব্যবস্থা নারীর মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। স্বামী যদি যেকোনো সময় তালাক দিতে পারেন, তবে একজন স্ত্রী কেন একই অধিকার পেতে পারেন না? এটি একটি বৈষম্যমূলক আইন, যা নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে এবং তাদের পুরুষের চেয়ে নিচু অবস্থানে রাখে। সুতরাং, ইসলামের প্রথাগত তালাক ব্যবস্থার এই বৈষম্য দূর করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক এবং আইনগত পরিবর্তন। নারীদেরও সমানভাবে তালাকের অধিকার প্রাপ্ত হওয়া উচিত, যা তাদের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সমানাধিকারকে নিশ্চিত করবে। আধুনিক সমাজকে ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ না রেখে নারীর প্রকৃত অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করাই আধুনিক সমাজের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র
- তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫০ [↑]
- মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিস একাডেমি, হাদিসঃ ৩২৭৯ [↑]
- ফিকহে ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, ড মুহাম্মদ রাওয়াস কালা’জী, ভাষান্তর ও সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ খলিলুল রহমান মুমিন, আধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১৭৬ [↑]
- ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৮২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"