18.পরপুরুষের সাথে স্ত্রীকে দেখলে কতল

নবী মুহাম্মদের একজন সাহাবীর নাম সা’দ ইবনু উবাদাহ্। উনি বলেছিলেন, উনার স্ত্রীকে উনি পরপুরুষের সাথে দেখলে ” তাকে আমার তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে তার উপর আঘাত হানব”। এই বক্তব্য নবী মুহাম্মদের কাছে পৌঁছালে, তিনি সাহাবীর এই কথা শুনে প্রশংসা করেন এবং তাকে আত্মমর্যাদাবান বলে অভিহিত করেন। এই হাদিসটি গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এটি নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার প্রতি চরম অবমাননাকর। একটি সভ্য সমাজে নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব এবং সহিংসতা যে কতটা ভয়াবহ এবং অমানবিক হতে পারে, তা কল্পনাতীত!

এই হাদিসে, সাহাবী সা’দ ইবনু উবাদাহ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি তার স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে দেখলে তাকে হত্যা করবেন। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, জিনা বা এই ধরণের অপরাধের প্রমাণের জন্য কমপক্ষে চারজন সাক্ষী থাকা আবশ্যক। কিন্তু সা’দ ইবনু উবাদাহ এই আইন মেনে চলার পরিবর্তে তার নিজের হাতে স্ত্রীর প্রতি সহিংসতা প্রদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবী মুহাম্মদএই বক্তব্য শোনার পর সেই সাহাবীর প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, সা’দ একজন আত্মমর্যাদাবান ব্যক্তি। এই ধরনের মনোভাব নারীর অধিকার এবং তার মর্যাদার প্রতি একধরনের চরম অসম্মান প্রদর্শন।

প্রথমত, এই হাদিস নারীর নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং তার জীবনহানির বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একজন স্ত্রী যদি তার স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করে বা স্বামী যদি সন্দেহ করেন, তবে তাকে হত্যা করার এই ইচ্ছা সরাসরি নারীর মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করে এবং তাকে পুরুষের অধীনস্থ করে তোলে।

এই হাদিসে মূলত পুরুষের মর্যাদা এবং আত্মমর্যাদার একটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একজন পুরুষের আত্মমর্যাদা শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। এটি একটি বিকৃত এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন, যা নারীকে সম্পত্তির মতো দেখায় এবং তার জীবনকে মূল্যহীন করে স্বামীর ইচ্ছা যে স্ত্রীর জীবনের চাইতেও দামী, এরকম একটি বার্তা দেয়। একটি সমাজে যদি নারীর জীবন এবং তার ব্যক্তিগত অধিকারকে পুরুষের ইচ্ছার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়, তবে সেই সমাজ কখনোই নারীর জন্য নিরাপদ হতে পারে না। এর মাধ্যমে নারীর প্রতি যে নিপীড়ন এবং সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে, তা একটি সভ্য সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নারীর অধিকার এবং মর্যাদাকে অগ্রাহ্য করে সহিংসতাকে আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা শুধু নারীদের জন্য নয়, সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। আসুন হাদিসগুলো পড়ে দেখা যাক,

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
২০। লি’আন
পরিচ্ছেদঃ পরিচ্ছেদ নাই
৩৬৫৫-(১৬/…) আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ সা’দ ইবনু উবাদাহ্ (রাযিঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! যদি আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোন পুরুষকে দেখতে পাই তবে চারজন সাক্ষী উপস্থিত না করা পর্যন্ত আমি কি তাকে ধরব না? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, পারবে না। তিনি (সা’দ) বললেনঃ এমনটি কিছুতেই হতে পারে না, সে মহান সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আবশ্য আমি তার (চারজন সাক্ষী উপস্থিত করার) আগেই কাল বিলম্ব না করে তার প্রতি তলোয়ার হানব। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা শোন, তোমাদের নেতা কী বলছেন। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় আত্মমর্যাদার অধিকারী। আর আমি তার চাইতেও অধিকতর আত্মমর্যাদাশীল এবং আল্লাহ আমার চাইতেও অধিক মর্যাদাবান। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৬২১, ইসলামিক সেন্টার ৩৬২১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
২০। লি’আন
পরিচ্ছেদঃ পরিচ্ছেদ নাই
৩৬৫৬-(১৭/১৪৯৯) উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার কাওয়ারীরী ও আবূ কামিল ফুযায়ল ইবনু হুসায়ন জাহদারী (রহঃ) ….. মুগীরাহ শুবাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ সা’দ ইবনু উবাদাহ্ (রাযিঃ) বললেনঃ আমি যদি আমার স্ত্রীর সাথে অন্য কোন পুরুষকে দেখতে পাই তবে নিশ্চয়ই আমি তাকে আমার তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে তার উপর আঘাত হানব- পার্শ্ব দিয়ে নয়। এ কথা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌছল। তিনি বললেনঃ তোমরা কি সাদের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে আশ্চর্য হয়েছ? আল্লাহর কসম! আমি তার চাইতে অধিকতর আত্মমর্যাদাবান। আর আল্লাহ আমার তুলনায় অধিকতর মর্যাদাবান। আল্লাহ তাঁর আত্মমর্যাদার কারণে প্রকাশ্য ও গোপন যাবতীয় অশ্লীল কর্ম হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহর তুলনায় অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কেউ নেই এবং আল্লাহর চাইতে অধিকতর ওযর (স্থাপন) পছন্দকারী কেউ নেই।* এ কারণেই আল্লাহ তার নাবী-রসূলদের সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর চাইতে অধিকতর প্রশংসা পছন্দকারী কেউ নেই। এ কারণে তিনি জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ৩৬২২, ইসলামিক সেন্টার ৩৬২২)
* আল্লাহর চেয়ে ওযর পছন্দকারী কেউ নেই। এখানে ‘ওযর’ ক্ষমা করা ও সতর্ক করা অর্থে এসেছে। শাস্তির জন্য পাকড়াও করার পূর্বে আল্লাহ তা’আলা রসূলদেরকে সতর্ক করার জন্য প্রেরণ করেছেন। (তাহকীক। সহীহ মুসলিম, ফুআদ আবদুল বাকী’, ২য় খণ্ড, ৫৭৪ পৃঃ)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ শু’বা (রহঃ)

এই হাদিসের মাধ্যমে নারীর জীবনের প্রতি সহিংস মনোভাব এবং তাকে হত্যার বৈধতা দেওয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, তা নারীর জন্য সামাজিকভাবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। একটি সমাজে যদি নারীর জীবন এবং নিরাপত্তাকে এইভাবে উপেক্ষা করা হয়, তবে সেই সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষিত হওয়া অসম্ভব। এই ধরনের হাদিস নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় এবং পুরুষদের তাদের স্ত্রী বা নারীদের ওপর একধরনের ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে, যা পুরোপুরি অসভ্য, মধ্যযুগীয় এবং অগ্রহণযোগ্য।

ইসলামের এই হাদিস নারীর জীবন, মর্যাদা এবং অধিকারকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করে। এতে পুরুষদের নারী হত্যার বৈধতা প্রদান করা হয়েছে এবং সহিংসতাকে আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি নারীর মৌলিক অধিকার এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করে এবং তাকে পুরুষের সন্দেহ ও ক্রোধের শিকার হতে বাধ্য করে। মানবাধিকার এবং নারী অধিকারের দৃষ্টিতে, এই হাদিসের বার্তা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এর সমালোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। নারীর মর্যাদা এবং নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এ ধরনের হাদিসকে বাতিল করা এবং নারীর অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নারীর প্রতি সহিংসতা কখনোই আত্মমর্যাদার প্রতীক হতে পারে না, বরং এটি একটি বর্বর এবং অমানবিক মনোভাবের প্রতিফলন।