ভূমিকা:
কোরআনের অনেক আয়াত এবং অনেক হাদিস, একই সাথে ইসলামী শরীয়া আইনে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, তা আধুনিক সমাজের নারী অধিকার এবং মানবাধিকারের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। ইসলামে নারীর ভূমিকা, তাদের অবস্থান, এবং পুরুষদের সাথে তাদের সম্পর্ককে অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত হেয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি হাদিসে বর্ণিত আছে যে, নবী মুহাম্মদ বন্ধ্যা নারীদের বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন, কারণ তারা সন্তান জন্মদানে সক্ষম নয়। এই হাদিসটি নারীদেরকে শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের একটি মেশিন হিসেবে বিবেচনা করে, যা তাদের প্রকৃত সক্ষমতা, মূল্যবোধ এবং স্বাধীনতা খর্ব করে। প্রবন্ধটিতে আমরা এই হাদিসের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর মাধ্যমে নারীর প্রতি যে অপমান এবং অসম্মান করা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করবো এবং কেন এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর মৌলিক অধিকার এবং সম্মানের পরিপন্থী, তা বিশ্লেষণ করবো।
নারীর ভূমিকা: সন্তান জন্মদানের মেশিন?
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী হচ্ছে সন্তান জন্মদানের একটি মেশিন। বন্ধ্যা নারীরা যেহেতু সন্তান জন্ম দিতে পারে না, তাই তাদের মূল্য ছিল মুহাম্মদের কাছে কম। সেই কারণে নবী মুহাম্মদ বন্ধ্যা নারীদের বিবাহ করতে নিষেধ করতে গেছেন। নারীর জন্য যা অত্যন্ত অবমাননাকর।
সূনান নাসাঈ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২৬/ নিকাহ (বিবাহ)
পরিচ্ছেদঃ ১১. বন্ধ্যা নারীকে বিবাহ করা অনুচিত
৩২৩০. আব্দুর রহমান ইবন খালিদ (রহঃ) … মা’কাল ইবন ইয়াসার (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে আরয করলোঃ আমি এমন এক মহিলার সন্ধান পেয়েছি, যে বংশ গৌরবের অধিকারিণী ও মর্যাদাবান, কিন্তু সে বন্ধ্যা, আমি কি তাকে বিবাহ করবো? তিনি তাকে নিষেধ করলেন। দ্বিতীয় দিন তাঁর নিকট আসলে তিনি নিষেধ করলেন। এরপর তৃতীয় দিন তাঁর খেদমতে আসলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেনঃ তোমরা অধিক সন্তান প্রসবা নারীকে বিবাহ করবে, যে তোমাদেরকে ভালবাসবে। কেননা, আমি তোমাদের দ্বারা সংখ্যাধিক্য লাভ করবো।
তাহক্বীকঃ হাসান। ইরওয়া ১৭৮৪, আদাবুয যিফাফ ১৬, সহীহ আবু দাউদ ১৭৮৯।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ)
সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৬/ বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ ৪. যে মহিলা সন্তান দিতে অক্ষম তাকে বিয়ে করা নিষেধ সম্পর্কে
২০৫০। মা‘কিল ইবনু ইয়াসার (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে বললো, আমি এক সুন্দরী ও মর্যাদা সম্পন্ন নারীর সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু সে বন্ধ্যা। আমি কি তাকে বিয়ে করবো? তিনি বললেনঃ না। অতঃপর লোকটি দ্বিতীয়বার এসেও তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। লোকটি তৃতীয়বার তাঁর নিকট এলে তিনি তাকে বললেনঃ এমন নারীকে বিয়ে করে যে, প্রেমময়ী এবং অধিক সন্তান প্রসবকারী। কেননা আমি অন্যান্য উম্মাতের কাছে তোমাদের সংখ্যাঘিধক্যের কারণে গর্ব করবো।(1)
হাসান সহীহ।
(1). নাসায়ী।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ)
অর্থাৎ, ইসলামে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তাদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই প্রথাগত চিন্তাধারায় নারীদের ভূমিকা শুধুমাত্র সন্তান জন্মদান এবং পুরুষের যৌনসঙ্গী হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই হাদিসে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বন্ধ্যা নারী সন্তান জন্ম দিতে পারেন না, তাই তাদের মূল্য কম। এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের প্রতি একধরনের গভীর অপমান এবং বৈষম্যের উদাহরণ। একটি সমাজ যখন নারীর মূল্যায়ন শুধুমাত্র তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে করে, তখন সেই সমাজের মূল্যবোধ এবং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির অবক্ষয় ঘটে। এটি প্রমাণ করে যে, নারীকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং সন্তান জন্মদানের যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়, যা তার স্বকীয়তা, মর্যাদা এবং স্বাধীনতাকে চরমভাবে খর্ব করে।
হাদিসের সমালোচনা: নারীর সম্মান ও মূল্যবোধের অবমাননা
এই হাদিসটি নারীকে শুধুমাত্র তার শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে মূল্যায়ন করে, যা অত্যন্ত অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক। নারীর মূল্য কেবল তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি নারী শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, সৃজনশীল এবং তার নিজের অধিকারে মূল্যবান। সন্তান জন্মদান একটি নারীর জীবনের একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু এটি তার সম্পূর্ণতা নয়। এই হাদিস নারীদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে অবমূল্যায়িত করে, এবং তাদেরকে শুধু রান্নাবান্না ও প্রজননের দায়িত্বে সীমাবদ্ধ করে রাখে। এভাবে নারীর ক্ষমতা, মর্যাদা, এবং অধিকারকে অগ্রাহ্য করা হয়, যা আধুনিক নারী অধিকারের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। নারীর সক্ষমতা এবং মূল্যকে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা নারীর প্রতি অবমাননা এবং অসম্মান।
সামাজিক প্রভাব: নারীর প্রতি বৈষম্য ও অসম্মান
এই ধরনের হাদিসের কারণে অনেক সমাজে নারীরা তাদের প্রকৃত অধিকার এবং মর্যাদার স্বীকৃতি পায় না। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ্যা নারী বা যারা সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম নয়, তারা পরিবার এবং সমাজের চাপে হেয় প্রতিপন্ন হয় এবং তাদেরকে পুরুষদের দয়ার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। এমনকি অনেক পুরুষ এই হাদিসকে ভিত্তি করে তাদের স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার করেন এবং তাদের ছেড়ে অন্য নারীকে বিয়ে করেন, শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার অনেক নারীই অভিযোগ করেছে, স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের সদস্যগণ তাদের প্রতি সহিংস হয়েছেন শুধুমাত্র এই কারণে যে, তারা সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম নন। এই ধরনের বৈষম্যমূলক মনোভাব নারীর আত্মবিশ্বাস এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। একজন নারীকে শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের মেশিন হিসেবে দেখা হলে, তার ব্যক্তিত্ব এবং মানসিকতার প্রতি বড় ধরণের অসম্মান প্রদর্শন করা হয়। সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকেও বিপর্যস্ত করে এবং তাকে সামাজিকভাবে প্রান্তিক করে তোলে।
উপসংহার
ইসলামের এইসকল হাদিসে নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, তা আধুনিক সমাজের নারী অধিকার এবং মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী। সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা দ্বারা নারীর মূল্যায়ন করা শুধু বৈষম্যপূর্ণ নয়, এটি নারীর প্রতি চরম অবমাননা। নারীদেরকে তাদের প্রকৃত অবস্থানে মূল্যায়ন করতে হবে, যেখানে তারা সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সমান অধিকারভোগী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
ধর্মের নামে নারীর প্রতি এই ধরনের বৈষম্য দূর করতে হলে প্রয়োজন সামাজিক এবং আইনগত পরিবর্তন। নারীদের সম্মান ও মর্যাদাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এবং তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করতে হবে। নারীদেরকে সন্তান জন্মদানের মেশিন হিসেবে নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন এবং সমান মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করাই একটি আধুনিক ও মানবিক সমাজের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।