20.মূর্তি বা প্রাণীর ছবি তৈরি হারাম

শিল্প ও সংস্কৃতি মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই প্রাচীন কাল থেকেই চিত্রকলা, ভাস্কর্য, এবং মূর্তি প্রাচীনকাল থেকে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। এসব মাধ্যমে মানুষ ইতিহাস সংরক্ষণ, সৌন্দর্য উপভোগ এবং শিক্ষামূলক বার্তা প্রেরণ করে। ইসলামে মূর্তি ও ছবি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মানুষের এই সৃজনশীলতাকে অযথা দমন করা হয়েছে। যে সংস্কৃতি মানুষের একদম মৌলিক অনুভূতিগুলোকে আপ্লুত করে, চিন্তা এবং জ্ঞানের পথে আহ্বান করে, সেই শিল্প ও সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে একটি মানুষ তখনি অবস্থান নিতে পারে, যখন সে আপাদমস্তক একজন বাটপার হয়।

হাদিসে বলা হয়েছে যে, মূর্তি বা ছবি তৈরি করলে সৃষ্টিকর্তা কিয়ামতের দিন শাস্তি দেবে। প্রশ্ন হলো, যদি সত্যিই একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর থেকে থাকে, তবে তিনি কী এতটাই অনিরাপদ যে, মানুষ একটি মূর্তি বানালেই তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে? একজন সর্বশক্তিমানের এমন সংবেদনশীল ও ভীতিপূর্ণ আচরণ কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে? ইসলামের মূর্তি-বিরোধী অবস্থান ইতিহাসে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম ধ্বংসের পেছনে দায়ী। তালেবানের বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস, আইসিসের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন গুঁড়িয়ে দেওয়া—এই সকল কর্মকাণ্ড ইসলামের মূর্তি-বিরোধী মতবাদের ফল। এভাবে ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহককে নিশ্চিহ্ন করা কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।

সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৬/ আদব
৯৩. স্বপ্ন সম্পর্কে।
৪৯৪০. মুসাদ্দাদ (রহঃ) ….. ইবন আব্বাস (রাঃ) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন মূর্তি তৈরী করবে, এর জন্য আল্লাহ্‌ তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেবেন, যতক্ষণ না সে তাতে প্রাণের সঞ্চার করতে সক্ষম হবে না।
আর যে ব্যক্তি মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করে, কিয়ামতের দিন তাকে নির্দেশ দেয়া হবে দু’টি চুলের মধ্যে গিরা দেয়ার জন্য, (যা অসম্ভব)। আর যে ব্যক্তি কান পেতে অন্যের কথা শোনে, যা তারা তাকে শোনতে চায় না, কিয়ামতের দিন তার কানে শিশা গলিয়ে ঢেলে দেয়া হবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ ১৮/ নিষিদ্ধ বিষয়াবলী
৩০৫ : পাথর, দেওয়াল, ছাদ, মুদ্রা ইত্যাদিতে প্রাণীর মূর্তি খোদাই করা হারাম। অনুরূপভাবে দেওয়াল, ছাদ, বিছানা, বালিশ, পর্দা, পাগড়ী, কাপড় ইত্যাদিতে প্রাণীর চিত্র অঙ্কন করা হারাম এবং মূর্তি ছবি নষ্ট করার নির্দেশ
১/১৬৮৭। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যারা এ জাতীয় (প্রাণীর) মূর্তি বা ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমার যা বানিয়েছিলে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা কর।’’ (বুখারী) (1)
(1) সহীহুল বুখারী ৫৯৫১, ৭৫৫৮, মুসলিম ২১০৮, নাসায়ী ৫৩৬১, আহমাদ ৪৪৬১, ৪৬৯৩, ৪৭৭৭, ৫১৪৬, ৫৭৩৩, ৬০৪৮, ৬২০৫, ৬২২৬, ৬২৯০
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

ইসলামে বলা হয়, মূর্তি বা ছবি পূজা প্রতিরোধের জন্য এগুলো নিষিদ্ধ। কিন্তু মূর্তি বা চিত্রশিল্প মানেই পূজা নয়। এটি কেবলমাত্র একটি শিল্পমাধ্যম। একটি ভাস্কর্য ঘরে শোভামণ্ডন করতে পারে, শিক্ষার্থীদের ইতিহাস পড়াতে সহায়তা করতে পারে বা যাদুঘরে প্রদর্শিত হতে পারে। এগুলোতে পূজা বা উপাসনার ইচ্ছা না থাকলে, এগুলোর বিরোধিতা করা একধরনের অজ্ঞতা ও অপ্রয়োজনীয় কড়াকড়ি। আর পূজা বা উপাসনা করার ইচ্ছা যদি কারো আদৌ থাকেই, সেটি তো তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তাহলে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ কী? ইসলামে মূর্তিপূজা হারাম বলা হলেও মুসলমানরা হজের সময় কাবার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে এবং হাজরে আসওয়াদ নামক একটি পাথর চুম্বন করে। এটি কার্যত পাথরপূজারই সমতুল্য। এই দ্বিচারিতা কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? যখন কাবা বা কালো পাথরের প্রতি এমন ভক্তি দেখানো হয়, তখন অন্য ধর্মের মূর্তির প্রতি ঘৃণা ছড়ানো স্পষ্ট ভণ্ডামি।

চিত্র ও মূর্তি শুধু বিনোদন নয়, শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। শিশুরা ছবি দেখে সহজে শিখতে পারে, মানুষ দৃশ্যমান জিনিস থেকে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়। মূর্তি বা ছবি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ইসলামে মানুষকে একটি সংকীর্ণ মানসিকতার মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছে, যেখানে স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত চেতনার কোনো স্থান নেই। একইসাথে, ইসলামের মূর্তি ও চিত্রশিল্পবিরোধী অবস্থান স্পষ্টতই মানবিক বোধ, শিক্ষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। ধর্মীয় ভীতি ও অন্ধ আনুগত্যের ভিত্তিতে মানুষের সৃজনশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে বন্ধ করার এই চেষ্টা সভ্যতার অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শেখে, শিল্প সৃষ্টি করতে শেখে, তখনই সে প্রকৃত অর্থে বিকশিত হয়। ইসলামের এ ধরনের বিধান সেই বিকাশের শত্রু। সমাজকে মুক্ত ও প্রগতিশীল রাখতে হলে, এ ধরনের মধ্যযুগীয় ও প্রতিক্রিয়াশীল বিধানের কঠোর সমালোচনা এবং প্রতিরোধ আবশ্যক।