অনেক সময়ই ইন্টারনেট কিংবা ইসলামিস্টদের বই পুস্তকে একটি দাবী বারবার দেখা যায়, দাবীটি হচ্ছে, কোরআন নাকি ১৪০০ বছর আগেই বলেছে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল! ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা খুব সফলভাবেই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ধারণাটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। অনেক ইসলামী লেখক ইসলামের স্বপক্ষে তাদের লেখা বইপত্রে কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার একটি প্রমাণ হিসেবে দাবিটি উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের অনেক প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমও ফলাও করে দাবিটি প্রচার করেছে। দীর্ঘদিনের প্রচারণায় দাবিটি সাধারণ মুসলিমদের কাছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের এমন প্রচারণা সাধারণ মুসলিমদের মাঝে একটি দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি করেছে যে, বিজ্ঞান আজ যা আবিষ্কার করেছে, তা কোরআনে বহু আগেই বলা ছিল। যেন আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের চাইতে কোরআনের জ্ঞান অর্জন করাই উত্তম। কারণ বিজ্ঞান তো শেষমেশ কোরআনের জ্ঞানকেই সার্টিফাই করবে! এরকম উন্নাসিক এবং হাস্যকর দাবী বাংলাদেশের আনাচা কানাচে মাঠে ময়দানে হুজুরেরা করে থাকেন, সেই সাথে এটি বলেন যে, পৃথিবীর মস্তবড় বিজ্ঞানীরা আসলে কিছুই বোঝে না, মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের চেয়ে বেশী বিজ্ঞান বোঝে। কারন তারা সর্বজ্ঞানের আধার কোরআন পড়ে!
কিন্তু, দাবিটি কি আদৌও সত্য? কোরআন কি আসলেই বলে যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল? প্রশ্ন হচ্ছে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের জন্য তাহলে ইহুদি নাসারা নাস্তিক বিজ্ঞানীদের কেন ক্রেডিট দেয়া হয়? আল্লাহ বা কোরআনকে কেন একটি নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় না? আর এই বিষয়টি ১৪০০ বছর ধরে মুখস্ত করা মুসলিমরা কেন আগে আবিষ্কার করতে পারলেন না? কেন সবসময় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করার পরেই ধার্মিকরা বুঝতে পারে, এটি তাদের ধর্মীয় কেতাবে আগেই বলা ছিল? কোরআনে বলা হয়েছে, [1]
আমি নিজ হাত দ্বারা আসমান সৃষ্টি করেছি আর আমি অবশ্যই মহা প্রশস্তকারী।
— Taisirul Quran
আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী,
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আমি হাতসমূহ দ্বারা আকাশ নির্মাণ করেছি এবং নিশ্চয় আমি শক্তিশালী।
— Rawai Al-bayan
আর আসমান আমরা তা নির্মাণ করেছি আমাদের ক্ষমতা বলে [১] এবং আমরা নিশ্চয়ই মহাসম্প্রসারণকারী [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে কাসির যা বলেছেন, [2]
“আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তিনি আকাশকে স্বীয় ক্ষমতাবলে সৃষ্টি করেছেন এবং ওটাকে তিনি সুরক্ষিত, সুউচ্চ ও সম্প্রসারিত করেছেন। অবশ্যই তিনি মহাসম্প্রসারণকারী। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত সাওরী (রঃ) এবং আরো বহু তাফসীরকার একথাই বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমি আকাশকে স্বীয় শক্তি বলে সৃষ্টি করেছি। আমি মহাসম্প্রসারণকারী। আমি ওর প্রান্তকে প্রশস্ত করেছি, বিনা স্তম্ভে ওকে দাঁড় করে রেখেছি এবং প্রতিষ্ঠিত করেছি।”
আলোচ্য আয়াতে (কোরআন ৫১:৪৭) وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ (ওয়া ইন্না– লামূছি’উন) অংশটির অর্থ “এবং আমরা অবশ্যই সম্প্রসারণকারী”, “এবং আমরা এখনো সম্প্রসারণ করছি” নয়। এখানে لَمُوسِعُونَ (লামূছি’উন) একটি বিশেষ্যপদ, ক্রিয়াপদ নয়। অর্থ্যাৎ, আয়াতটি নির্দিষ্টভাবে বলে না যে আল্লাহ প্রতিনিয়তই সম্প্রসারণ করছেন। কিন্তু বৃহৎ সম্প্রসারণ তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্ব এখনো সম্প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ চলমান বর্তমান কাল বা প্রেসেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। কিন্তু কোরআনে সেটি বলা হয়নি। বরঞ্চ এই ধরণের বক্তব্য আর অসংখ্য ধর্মগ্রন্থে বহু আগে থেকেই বর্ণিত আছে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই অসংখ্য রূপকথা এবং উপকথাতে একটি গল্প পাওয়া যায় যে, পৃথিবী এবং আকাশ পূর্বে একসাথে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ সালে এথেন্সের নিকটবর্তি সালামিস দ্বীপে জন্ম নেয়া প্রসিদ্ধ গ্রিক ধ্রুপদী নাট্যকার ইউরিপিদেস লিখে গেছেন, তার মায়ের কাছ থেকে শোনা সেই সময়ে প্রচলিত উপকথা থেকে তিনি জেনেছেন, পৃথিবী এবং আকাশ একসময়ে একসাথে ছিল। পরে দেবতাগণ সেটি আলাদা করেন। এই ধারণাটি প্রাচীন মিশরেও প্রচলিত ছিল। মিশরীয় উপকথা অনুসারে, দেবতা শু ( Shu ) আকাশের দেবতা নুটকে পৃথিবীর দেবতা গেব থেকে আলাদা করেছিল যখন তারা গভীর প্রেমে ছিল, এর মাধ্যমেই জগতে দ্বৈততার সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ উপরে এবং নীচে, আলো এবং অন্ধকার, ভাল এবং মন্দ। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে শু যদি নুট (আকাশ) এবং গেব (পৃথিবী) কে আলাদা না করতো তবে পৃথিবীতে জীবনের কোন অস্তিত্ব থাকতো না। আসুন মিশরের সেই উপকথার ওপর তৈরি করা বিখ্যাত প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকর্মটি দেখে নিই,
এবারে আসুন আরেকটি বই থেকে জেনে নেয়া যাক, ইউরিপিদেস এবং প্রাচীন আমলে এই বিষয়ে কী কী উপকথা প্রচলিত ছিল [3] –
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারেও, পৃথিবী ও মহাকাশ পূর্বে একসাথে ছিল বলেই কোরআনে বলা হয়েছে। কোরআন যে বাইবেলের মত স্বাভাবিকভাবেই প্রাচীন উপকথাগুলোর দ্বারা প্রভাবিত, তা সহজেই অনুমেয়। আসুন শুরুতেই সেই আয়াতটি পড়ে নিই, [4] –
অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?
— Taisirul Quran
যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখেনা যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবেনা?
— Sheikh Mujibur Rahman
যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখে না যে, আসমানসমূহ ও যমীন ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল*, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম, আর আমি সকল প্রাণবান জিনিসকে পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না? * আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে আদিতে আকাশ, সূর্য, নক্ষত্র ও পৃথিবী ইত্যাদি পৃথক সত্তায় ছিল না; বরং সবকিছুই ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। তখন মহাবিশ্ব ছিল অসংখ্য গ্যাসীয় কণার সমষ্টি। পরবর্তীকালে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে নক্ষত্র, সূর্য, পৃথিবী ও গ্রহসমূহ সৃষ্টি হয়। এটিই বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থিওরী।
— Rawai Al-bayan
যারা কুফরী করে তারা কি দেখে না [১] যে, আসমানসমূহ ও যমীন মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে, তারপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম [২] এবং প্রাণবান সব কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে [৩]; তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
প্রথমেই জানা দরকার, এই আয়াতের শুরুতে আরবিতে বলা হয়েছে, কাফেররা কী দেখে না। কয়েকটি অনুবাদে আবার খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে দেখে না কথাটি এড়িয়ে ভেবে দেখে না কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে কোন কাফেরের এরকম উপস্থিত থেকে সেটি দেখার কথা নয়। এমনকি, যা তারা দেখেনি, তা তাদের পক্ষে ভেবে দেখাও তো অসম্ভব। তবে এখানে যেই আরও বড় সমস্যাটি দেখা যায় তা হলো, মহাবিশ্বের উৎপত্তির আদিতে পৃথিবী নামক কোন গ্রহের অস্তিত্বই ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, মহাবিশ্বে উৎপত্তি হয়েছে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে, আর পৃথিবী নামক গ্রহটির উৎপত্তি মাত্র ৪.৫৬ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ মাঝখানে প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পৃথিবী নামক কোন গ্রহের অস্তিত্বই ছিল না। পৃথিবী আর মহাবিশ্বের বয়সের মধ্যে রয়েছে এক বিরাট তারতম্য। অনেক সময় আমরা দেখি, শরীর জোড়া লাগানো শিশুদের জন্ম হয়। ধরুন জোড়া লাগানো দুইজন শিশুর জন্ম হলো এবং তাদের আলাদা করা হলো। তাহলে, সেই জোড়া লাগানো শিশু দুইটি জোড়া আলাদা করার দিন থেকে গুনলে বয়স তো সমানই হবে, তাই না?
কোরআন থেকে আমরা জানলাম, পৃথিবী ও আকাশ অর্থাৎ মহাকাশের সকল বস্তু একসময়ে একত্রে ছিল। তাহলে মহাবিশ্বের সকল গ্রহ নক্ষত্রের বয়স তো পৃথিবীর সমান বা কম হবে, তাই না? কিন্তু অসংখ্য নক্ষত্র এবং গ্রহের সন্ধান পাওয়া যায়, যা পৃথিবী থেকে অনেক প্রাচীন। তাহলে এই আয়াতটি সত্য হয় কীভাবে?
তথ্যসূত্র
- কোরআন ৫১:৪৭ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসির, সপ্তদশ খণ্ড, তাফসীর পাবলিকেশন্স কমিটি, পৃষ্ঠা নং ১০৬ [↑]
- The Separation of Sky and Earth at Creation (II) [↑]
- সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৩০ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"