02.মিলার-উরের পরীক্ষা

১৯৫৩ সালে বিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলার ও তার পরামর্শক হ্যারল্ড উরের পরিচালনায় এক অভাবনীয় রাসায়নিক পরীক্ষা পৃথিবীর প্রাথমিক যুগে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গভীর এক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছিল। এই পরীক্ষাটি “মিলার-উর পরীক্ষা” নামে পরিচিত এবং এটি বৈজ্ঞানিক দুনিয়ায় একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, পৃথিবীর প্রাচীন পরিবেশে স্বাভাবিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জৈব অণু তৈরি হতে পারে। এই পরীক্ষাটি ওপারিন-হ্যাল্ডেন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে করা হয়, যা নির্দেশ করেছিল যে পৃথিবীর প্রাথমিক পরিবেশে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জৈব অণুগুলোর উৎপত্তি ঘটতে পারে।

পরীক্ষার প্রেক্ষাপট: ওপারিন-হ্যাল্ডেন মতবাদ

মিলার-উর পরীক্ষার মূলে ছিল আলেকজান্ডার ওপারিন এবং জে বি এস হ্যাল্ডেনের একটি তত্ত্ব, যা “প্রাইমর্ডিয়াল স্যুপ থিওরি” নামে পরিচিত। এই তত্ত্বে বলা হয়েছিল যে পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়া, এবং পানির মতো সরল গ্যাসীয় যৌগ ছিল, যা বিদ্যুৎ চমকের মতো শক্তি উৎসের মাধ্যমে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে জৈব অণুর জন্ম দিতে পারে। ওপারিন এবং হ্যাল্ডেনের মতে, প্রাচীন পৃথিবীর আবহাওয়ায় অক্সিজেনের উপস্থিতি ছিল না, এবং এর ফলে জটিল জৈব অণুগুলি ভেঙে পড়ার পরিবর্তে জমা হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে প্রাণের উত্থানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

মিলার-উর পরীক্ষার প্রক্রিয়া

মিলার-উর পরীক্ষা পৃথিবীর প্রাচীন বায়ুমণ্ডলের একটি ছোট আকারের মডেল তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। তারা একটি বন্ধ ল্যাবরেটরি সিস্টেম তৈরি করেন, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট গ্যাস রাখা হয়েছিল: মিথেন (CH₄), অ্যামোনিয়া (NH₃), হাইড্রোজেন (H₂), এবং পানি বাষ্প (H₂O)। এই সিস্টেমে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ (একা ৬০,০০০ ভোল্টের স্ফুলিঙ্গ) তৈরি করা হয়েছিল, যা পৃথিবীর প্রাথমিক যুগের বিদ্যুৎ চমক বা বজ্রপাতের প্রতিনিধিত্ব করে। পানির বাষ্পকে এই সিস্টেমের ভেতরে রেখে উত্তপ্ত করা হয়েছিল, যাতে এটি পৃথিবীর প্রাচীন মহাসাগরগুলির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

এরপর এই মডেলটি কয়েকদিন চালানো হয় এবং সিস্টেমের গ্যাসগুলোকে ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জড়িত করা হয়। পরীক্ষার শেষে দেখা গেল যে, গ্যাসের মিশ্রণ থেকে কিছু জটিল জৈব অণু তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড ছিল। অ্যামিনো অ্যাসিড হলো প্রোটিনের মৌলিক গঠন উপাদান, এবং প্রোটিন প্রাণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান।

ফলাফল: জীবনের রাসায়নিক ভিত্তি

মিলার-উরের পরীক্ষায় যে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে গ্লাইসিন, আলানিন, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড এবং গ্লুটামিক অ্যাসিড অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আবিষ্কারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত করেছিল যে পৃথিবীর প্রাচীন পরিবেশে স্বাভাবিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জৈব অণু তৈরি হতে পারে। ফলে, এটি ওপারিন-হ্যাল্ডেনের মতবাদকে শক্তিশালীভাবে সমর্থন করেছিল।

সংশয় ও সমালোচনা

মিলার-উর পরীক্ষার পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রকৃত গঠন নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। মিলার ও উরের পরীক্ষায় যে গ্যাসগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল (মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেন) প্রাচীন পৃথিবীর প্রকৃত বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে পুরোপুরি মিল খায় না বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে ধারণা করা হয় যে প্রাচীন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂), নাইট্রোজেন (N₂), এবং পানি বাষ্প (H₂O) নিয়ে গঠিত ছিল, যা কম হ্রাসকারী পরিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তবে বিজ্ঞানীরা পুনরায় বিভিন্ন পরিবেশগত পরিবর্তনের অধীনে পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেন এবং দেখতে পান যে জৈব অণুগুলি অন্যান্য পরিবেশেও উৎপন্ন হতে পারে। ফলে, মিলার-উরের পরীক্ষাটি কেবলমাত্র পৃথিবীর প্রাথমিক পরিবেশের একটি নির্দিষ্ট মডেল নয়, বরং বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থায় জীবনের মৌলিক রাসায়নিক অণুগুলির উৎপত্তি বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে।

আধুনিক গবেষণা ও নতুন আবিষ্কার

মিলার-উর পরীক্ষার পর থেকে প্রাণের উৎস নিয়ে গবেষণায় নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টস, যেখানে তাপমাত্রা এবং রাসায়নিক শক্তির উচ্চ মাত্রা থাকে, প্রাণের উৎপত্তির জন্য সম্ভবত উপযুক্ত স্থান হতে পারে। এছাড়াও, মহাজাগতিক ধূলিকণা এবং উল্কাপিণ্ডে জৈব অণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর বাইরে থেকেও এই ধরনের অণু পৃথিবীতে আসতে পারে।

এছাড়াও, মিলার তার জীবনের শেষ পর্যায়ে পুরনো নমুনাগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করে আরও জটিল জৈব অণু, যেমন- বিভিন্ন ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড, পেপটাইড ইত্যাদি খুঁজে পেয়েছিলেন। ফলে, তার প্রাথমিক ফলাফল আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় প্রমাণিত হয়।

মিলার-উর পরীক্ষার গুরুত্ব

মিলার-উরের পরীক্ষাটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক, কারণ এটি প্রথমবারের মতো প্রমাণ করেছিল যে, পৃথিবীর প্রাচীন পরিবেশে প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈব অণুগুলি তৈরি হতে পারে। এটি আমাদেরকে পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তির প্রাথমিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। যদিও পরবর্তী গবেষণায় পৃথিবীর প্রাচীন বায়ুমণ্ডলের প্রকৃত গঠন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা হয়েছে, তারপরও মিলার-উরের পরীক্ষা জীবনের উৎপত্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

উপসংহার

মিলার-উরের পরীক্ষা আজও প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ে চলমান গবেষণার মূলে রয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈব অণুগুলির উৎপত্তি সম্ভব এবং পৃথিবীর প্রাচীন পরিবেশ জীবনের সূচনার জন্য উপযুক্ত হতে পারে। যদিও পরীক্ষা সম্পর্কে সমালোচনা রয়েছে, আধুনিক গবেষণায় এর গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

এবারে আসুন বিষয়টি সহজভাবে বুঝি,

বাঙলায় এই বিষয়ে ক্লাস লেকচার শুনতে চাইলে,