ঈশ্বরের দোহাই বা “Appeal to Heaven” কুযুক্তি তখনই সংঘটিত হয় যখন কোনো দাবিকে যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ না করে ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই দিয়ে সেটিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যুক্তি ও প্রমাণের অভাবে “ঈশ্বরের ইচ্ছা” বা “ঈশ্বরের আদেশ” ব্যবহার করে অন্যায় কাজকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই কুযুক্তি বিপজ্জনক, কারণ এটি যেকোনো কাজকে ন্যায্য হিসেবে উপস্থাপন করে, যার বাস্তবিক কোনো ভিত্তি বা যৌক্তিকতার প্রয়োজন হয় না।
১. ঈশ্বরের আদেশে অপরাধ – উদাহরণ
- উদাহরণ ১:
- বিচারক: কেন তুমি ওদেরকে হত্যা করেছ?
- অভিযুক্ত: কারণ ঈশ্বর আমাকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন।
- এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি সরাসরি ঈশ্বরের আদেশকে হত্যার বৈধতা হিসেবে উপস্থাপন করছে। যদিও আধুনিক বিচারব্যবস্থা ঈশ্বরের আদেশকে কোনো অপরাধের সাফাই হিসেবে গ্রহণ করে না, তবে ধর্মীয় বিশ্বাস বা ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই দিয়ে বহু মানুষ অন্যের ক্ষতি করে থাকে।
- উদাহরণ ২:
- কেন আব্রাহাম ও আইজ্যাকের গল্পটিকে একটি “অসাধারণ” খ্রিস্টীয় গল্প হিসেবে পড়ানো হয়? লোকটা তো তার সন্তানকে প্রায় জীবিত পুড়িয়েই ফেলেছিল!
- কারণ আব্রাহাম ঈশ্বরের ইচ্ছারই অনুসরণ করছিল। এটা আব্রাহামের জন্য অনেক কষ্টকর হলেও সে ঈশ্বরভক্তির কারণে করতে যাচ্ছিল।
- এখানে আব্রাহামের ঈশ্বরের আদেশ মেনে তার সন্তানকে হত্যার প্রয়াসকে “অসাধারণ” বলা হচ্ছে শুধুমাত্র তা ঈশ্বরের আদেশ ছিল বলে। কিন্তু সন্তানের হত্যা চেষ্টার মতো একটি নির্মম কাজ ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে সঠিক হতে পারে না। তাই এই গল্পকে নৈতিক বা অসাধারণ হিসেবে দেখানো যুক্তিকভাবে ভুল এবং বিপজ্জনক।
- উদাহরণ ৩:
- নিজের ধর্ম ব্যাতীত অন্য ধর্মের লোকজন অধস্তন বা নিকৃষ্টতম প্রাণী—এই কথা কোন মানুষ বলেনি, ধর্মগ্রন্থে স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন। এরকম কথা মানুষ বললে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সবার সৃষ্টিকর্তা, তাই তিনি এই কথা বলতেই পারেন।
- এখানে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার মত বিপজ্জনক চিন্তাকে ন্যায্যতা দেয়া হচ্ছে। মানুষ এ ধরনের বক্তব্য দিলে তাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে ধরা হবে, কিন্তু ঈশ্বর এ কথা বলছেন বলেই তা সঠিক হয়ে যাবে? এরকম দাবিতে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি দেখিয়ে যুক্তি ও নৈতিকতার মানদণ্ডকে পাশ কাটানো হয়, যা মানবিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক।
২. ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে কুযুক্তি প্রয়োগের ঝুঁকি
“Appeal to Heaven” কুযুক্তি মানুষকে অন্যায় বা অমানবিক কাজের বৈধতা দিতে সহায়তা করে। এই কৌশলটি ব্যবহৃত হলে, অপরাধমূলক কাজকে সহজেই ন্যায্য করা যায়, কারণ এতে ঈশ্বরের আদেশের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে:
ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক আক্রমণ:
- হিটলার দাবি করতে পারত, ঈশ্বরের আদেশেই সে ৬০ লক্ষাধিক ইহুদি নিধন করেছে।
- মাওলানা মওদুদি যখন আহমদীয়াদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণের উষ্কানি দিয়েছেন, সেও একই দাবী করতে পারত যে এটি আল্লাহর আদেশ।
এই কুযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীরা তাদের কাজকে ঈশ্বরের ইচ্ছার নাম দিয়ে বৈধ করতে পারে, যা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয় বরং মানবিকতারও বিপরীত।
৩. ঈশ্বরের আদেশে অপরাধমূলক কাজের উদাহরণ
ইতিহাসে বহু ঘটনা রয়েছে যেখানে ঈশ্বরের আদেশের দোহাই দিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে:
- Deanna Laney Murders: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডেনা লানি নামে এক নারী দাবি করেন, ঈশ্বর তাকে নির্দেশ দিয়েছেন তার তিন ছেলেকে হত্যা করতে। সে এই আদেশ মেনে দুজন ছেলেকে পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে এবং তৃতীয় ছেলেকে গুরুতর আহত করে।
- Sharon Dalson: শ্যারন দালসন নামে একজন মা ঈশ্বরের আদেশ মেনে তার শিশুকে হত্যা করে। তার দাবি ছিল, ঈশ্বর তাকে আদেশ দিয়েছেন শিশুটিকে ‘পবিত্র’ করার জন্য।
- Samuel Warren Shaffer Case: শ্যাফার, একজন ধর্মীয় পন্ডিত, দাবি করেন যে, ঈশ্বরের আদেশে সে ৮ বছরের এক বালিকাকে বিয়ে করেছে। এতে ধর্মের দোহাই দিয়ে শিশুকন্যার প্রতি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়।
- বাংলাদেশের রেজওয়ানা হত্যাকাণ্ড: কথিত আল্লাহর নির্দেশে মা তার মেয়েকে হত্যা করেছিল, যেখানে হত্যার কারণ হিসেবে ঈশ্বরের ইচ্ছা উল্লেখ করা হয়।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই দিয়ে কুযুক্তি তৈরি করে মানুষ অপরাধমূলক কাজ করতে পারে, যা মানবিকতার ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত। আসুন বহু পুরাতন একটি পত্রিকার অংশ দেখে নিই,
৪. নেতিবাচক প্রভাব এবং কুযুক্তির বিপদ
ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে অপরাধমূলক কাজকে বৈধ করার চিন্তা একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি করে। এর মাধ্যমে সমাজে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে অবহেলা করে ঈশ্বরের আদেশের নামে বর্বর কাজকে সমর্থন দেয়া হয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে অন্যায় কাজ করে, তখন সেই কাজকে সমালোচনা করা কঠিন হয়ে যায়, কারণ তা ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করে প্রচারিত হয়। এ ধরনের কুযুক্তি সমাজে নৈতিকতা, আইনের শাসন, এবং মানবাধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে।
৫. উপসংহার
ঈশ্বরের দোহাই বা “Appeal to Heaven” কুযুক্তি একটি বিপজ্জনক এবং অযৌক্তিক হেত্বাভাস যা অপরাধমূলক এবং অমানবিক কাজকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করে। যুক্তি ও প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই দিয়ে বিপজ্জনক কাজকে বৈধতা দেয়া যেমন বিপজ্জনক, তেমনি মানবিকতার বিরুদ্ধেও কাজ করে। এজন্য মানবজাতিকে যুক্তি ও নৈতিকতার পথে এগিয়ে যেতে হবে এবং ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে করা হিংসাত্মক ও অপরাধমূলক কাজ থেকে সতর্ক থাকতে হবে।