কগনিটিভ বায়াস, বা জ্ঞানতাত্ত্বিক পক্ষপাত, একটি মানসিক প্রক্রিয়া যেখানে কোনো ব্যক্তি তার নিজের বিশ্বাস ও ধারণার সাথে মিলে যাওয়া তথ্যকে গ্রহণ করে এবং তার বিপরীত তথ্যকে এড়িয়ে যায়। এটি আরোহী যুক্তির একটি প্রক্রিয়াগত ভুল, যা মানুষের আবেগ, পূর্ব ধারণা এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্যক্তি সাধারণত সেসব তথ্য গ্রহণ করেন, যা তাদের মতামতকে সঠিক প্রমাণ করে এবং এর বিপরীত যুক্তিগুলোকে এড়িয়ে যান।
মানুষের আবেগ, পূর্ব থেকে নিয়ে আসা বিশ্বাস, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম, ছোটবেলা থেকে শিখে আসা সংস্কার, এইসবই তার সামনে থাকা তথ্যপ্রমাণগুলোর মধ্যে গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ সে যা শুনতে চায়, যা শুনলে সে আনন্দিত হয়, যা তার বিশ্বাসকে স্বস্তি দেয়, সেই ধরণের তথ্য প্রমাণ সম্পর্কে অবচেতনভাবেই তার পক্ষপাত। একজন ব্যক্তি যখন বিষয়ীগতভাবে তথ্য সংগ্রহ বা স্মরণ রাখে, তখন তার পূর্ব ধারণা বা সংস্কার বা বিশ্বাসের সাথে যা মিলে যায়, সেই সব তথ্যের প্রতি তার এক ধরণের পক্ষপাত থাকে। তার মধ্যে তাড়না থাকে যে, সে যেই মতবাদ বা বিশ্বাস লালন করে, সেগুলো যেন সত্য প্রমাণ করা যায়। শুধুমাত্র সেইসবের পক্ষে থাকা তথ্যপ্রমাণই তার কাছে সত্যিকারের তথ্যপ্রমাণ বলে মনে হয়। অপরদিকে, যেসব তথ্য প্রমাণ তার মতবাদ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তা যত শক্তিশালী বা স্পষ্টই হোক না কেন, সে সেগুলো এড়িয়ে যায় বা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে। তথ্যপ্রমাণ থেকে যতটুকু তার পক্ষে গেছে, সেগুলো সে কাজে লাগায় এবং মনে রাখে তার বিশ্বাস বা মতবাদকে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই প্রবণতাটিই হলো ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা ‘কগনিটিভ বায়াস‘, যা একটি ভুল পদ্ধতি।
মানব মস্তিষ্কের কাজের পদ্ধতি
মানুষের মস্তিষ্ক প্রাকৃতিকভাবে প্যাটার্ন খুঁজে বের করে। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়েছেন, আমাদের মস্তিষ্ক একটি প্যাটার্ন রিকগনাইজিং মেশিন, যা সবসময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ম খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মেঘের দিকে তাকালে আমরা অনেক সময় সেই মেঘে পরিচিত প্রাণীর আকৃতি দেখতে পাই, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেই মেঘের এমন কোনো বিশেষ রূপ নেই। মস্তিষ্কের এই ক্ষমতা ব্যক্তি তার বিশ্বাসকে দৃঢ় করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
মস্তিষ্ক এমন স্মৃতিগুলোকেই বারবার পুনরায় আনে, যা ব্যক্তিকে আনন্দ দেয় বা তার বিশ্বাসকে সমর্থন করে। এ কারণেই, যখন কোনো ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহ করেন বা স্মরণ করেন, তখন তার মস্তিষ্ক বিশেষভাবে সেসব তথ্যের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, যা তার নিজের মতবাদকে সমর্থন করে।
Confirmation Bias এর উদাহরণ
- ১. ধর্মীয় পক্ষপাত: যদি একজন ব্যক্তি কোনো বিশেষ ধর্মে জন্মগ্রহণ করেন, তাহলে সাধারণত তিনি মনে করেন তার ধর্মই একমাত্র সত্য এবং সঠিক। কারণ তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের পক্ষে থাকা তথ্যগুলোকে গ্রহণ করেন এবং অন্য ধর্মের বিপরীত যুক্তিগুলোকে এড়িয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মুসলিম ব্যক্তি মনে করতে পারেন যে, ইসলামের বাইরের সব ধর্ম ভুল, কারণ তিনি কেবলমাত্র ইসলামিক প্রমাণগুলোকে গুরুত্ব দেন।
- ২. বিজ্ঞান ও গবেষণায় পক্ষপাত: গবেষণায় কনফার্মেশন বায়াসের একটি ক্লাসিক উদাহরণ হলো, একজন বিজ্ঞানী তার তত্ত্বকে সমর্থন করে এমন প্রমাণগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন এবং বিপরীত ফলাফলগুলো এড়িয়ে যান। এর ফলে, গবেষণার ফলাফল বিকৃত হতে পারে এবং গবেষণার উপসংহার সঠিক নাও হতে পারে।
- ৩. রাজনৈতিক বিশ্বাস: রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থকরা প্রায়ই কনফার্মেশন বায়াসের শিকার হন। তারা এমন তথ্য খোঁজেন যা তাদের প্রিয় নেতার সাফল্যকে তুলে ধরে, কিন্তু নেতার ব্যর্থতা বা নেতিবাচক কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য এড়িয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ, একজন সমর্থক কেবল সেই খবরগুলো গুরুত্ব দেন যেখানে তার নেতা প্রশংসিত হয়েছেন, অন্যদিকে সমালোচনামূলক তথ্য এড়িয়ে যান।
বায়াসের প্রভাব:
Confirmation bias মানুষের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বিকৃত করে। এটি ব্যক্তিকে সঠিক বা নিরপেক্ষ তথ্য মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে, কারণ সে ইতোমধ্যেই একটি পক্ষপাত নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এ ধরনের পক্ষপাত বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে বড় বাধা হতে পারে, কারণ এটি সত্যকে খণ্ডিত করে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
বায়াসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:
- ১. বিপরীত প্রমাণের মূল্যায়ন: সত্যিকারের সমালোচনামূলক চিন্তা তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তি তার নিজের বিশ্বাসের বিপরীত প্রমাণগুলোকেও সমানভাবে মূল্যায়ন করেন।
- ২. ফ্যাক্ট চেকিং এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি: কনফার্মেশন বায়াস প্রতিরোধের জন্য ফ্যাক্ট চেকিং এবং তথ্যের গভীর মূল্যায়ন প্রয়োজন। বিশ্বাসের বিপরীতে থাকা প্রমাণকে আমলে নিতে এবং তা যাচাই করতে হবে।
- ৩. আত্মসমালোচনার অনুশীলন: নিজের বিশ্বাস ও ধারণার দিকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে তাকানো এবং নিজের অবস্থানের দুর্বলতা চিন্তা করে তা উন্নত করা উচিত।
উপসংহার:
কগনিটিভ বায়াস বা Confirmation bias মানুষের যুক্তি ও চিন্তাভাবনার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি সত্যের সম্পূর্ণ চিত্র না দিয়ে একটি পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা গঠন করে, যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞান, রাজনীতি, ধর্মে প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রতিকার সম্ভব শুধুমাত্র তখনই যখন আমরা নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং বিপরীত প্রমাণকে গ্রহণ করতে শিখি।