গাঁথন (Composition) বা বিভাজনের (Division) কুযুক্তি হলো এমন একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি যেখানে কোনো কিছুর অংশ বা উপাদানের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলির ভিত্তিতে সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিংবা সামগ্রিক অবস্থা থেকে কোনো অংশের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়। এটি একটি ভুল ধারণা যা প্রায়ই যুক্তিতর্কের সময় ব্যবহৃত হয়।
অ্যারিস্টটল তার “Sophistical Refutations” গ্রন্থে এই কুযুক্তির ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে আংশিক সত্যের ভিত্তিতে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয় বা পুরো বিষয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো আংশিক উপাদানের জন্য প্রযোজ্য মনে করা হয়।
গাঁথন বা ফ্যালাসি অব কম্পোজিশন (Fallacy of Composition):
ফ্যালাসি অব কম্পোজিশন ঘটে যখন কোনো কিছুর অংশ বিশেষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে সেটি পুরো বস্তুটির জন্যও প্রযোজ্য হবে।
উদাহরণ:
- ১. পানি এবং এর উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন:
- পানি আমাদের ভিজিয়ে দেয় এবং আমরা এটি পান করি। পানি তৈরি হয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদাভাবে আমাদের ভিজিয়ে দিতে পারবে বা পান করা যাবে। পানি হিসেবে তাদের যৌথ গঠনই তাদের এই বৈশিষ্ট্য দেয়। এই উদাহরণটি কম্পোজিশনের একটি ক্লাসিক উদাহরণ।
- ২. ক্রিকেট দলের উদাহরণ:
- যদি পৃথিবীর সব সেরা ক্রিকেটারদের একত্র করে একটি দল গঠন করা হয়, তবে এই দলটি যে নিশ্চিতভাবেই সেরা হবে, এমনটি বলা যায় না। কারণ একটি দল হিসেবে খেলার জন্য শুধু ভালো ব্যাটসম্যান বা ভালো খেলোয়াড়ের সমন্বয় যথেষ্ট নয়। দলগত খেলা, সহযোগিতা এবং কৌশলগত দক্ষতাও দরকার। যদি তারা একসাথে ভালোভাবে না খেলে বা দলের মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকে, তাহলে দলটি ব্যর্থ হতে পারে।
- ৩. অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মানবচিন্তা:
- মানুষের দেহে বিভিন্ন অঙ্গ রয়েছে যেমন, হাত, পা, হৃদপিণ্ড, কিডনি ইত্যাদি। এসব অঙ্গ আলাদাভাবে চিন্তা করতে পারে না। তাই বলে এই ধারণা করা যাবে না যে, মানুষও চিন্তা করতে পারে না। মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আসলে মস্তিষ্কের মাধ্যমে ঘটে, যা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত হলেও সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কাজ করে। এটি গাঁথনের কুযুক্তির আরেকটি উদাহরণ, যেখানে অংশবিশেষের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমগ্রটি সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।
বিভাজনের কুযুক্তি (Fallacy of Division):
বিভাজনের কুযুক্তি ঘটে যখন সামগ্রিক কোন কিছুর বৈশিষ্ট্যকে তার অংশবিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ, সামগ্রিক সত্যের ভিত্তিতে তার পৃথক অংশগুলো সম্পর্কেও একই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উদাহরণ:
- ১. মানুষ ও তার উপাদান:
- মানুষ হলো একাধিক অণু এবং পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যেহেতু অণু এবং পরমাণুর চেতনা নেই, তাই মানুষও চেতনাহীন। মানুষের চেতনা হলো তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মস্তিষ্কের যৌথ কাজের ফলাফল, যা আলাদা আলাদা অংশের বৈশিষ্ট্য নয়।
- ২. বই ও এর উপাদান:
- একটি বই মূলত কাগজ এবং কালি দিয়ে তৈরি। কিন্তু বইয়ের মধ্যে যা লেখা থাকে, সেটি কেবল কাগজ এবং কালির সমষ্টি নয়। এটি জ্ঞানের বহনকারী এবং নানা ধরণের তথ্য, মতামত ও বোধ প্রকাশ করে। বইয়ের উপাদানগুলোকে দেখে তার প্রকৃত গুরুত্ব বা অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
গাঁথন ও বিভাজনের কুযুক্তির প্রভাব:
এই কুযুক্তিগুলো বিশেষত বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং সামাজিক প্রসঙ্গে বেশ ক্ষতিকারক হতে পারে। মানুষ প্রায়ই এই ভুলটি করে যে, কোনো এক অংশের বৈশিষ্ট্য বা গুণ দেখে পুরো সিস্টেম বা বস্তু সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। আবার সমগ্র সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যকে আলাদা আলাদা অংশেও প্রযোজ্য মনে করে ভুল করে।
আরো কিছু উদাহরণ:
৩. অর্থনীতি:
- যদি একটি দেশে প্রতিটি কোম্পানি ভালো লাভ করে, তার মানে এই নয় যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ভালো হবে। হয়তো কিছু ক্ষুদ্র কোম্পানি লাভ করছে, কিন্তু বড় কোম্পানিগুলো মন্দার মুখে রয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতি কেবল ক্ষুদ্র অংশগুলোর উন্নতি দিয়ে বোঝা যাবে না।
৪. পরিবারের উদাহরণ:
- যদি একটি পরিবার ধনী হয়, তার মানে এই নয় যে সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্য ধনী। হতে পারে পরিবারের প্রধান ব্যক্তি ধনী, কিন্তু অন্য কেউ নাও হতে পারেন।
উপসংহার:
গাঁথন ও বিভাজনের কুযুক্তি হলো এমন একটি লজিক্যাল ভুল যেখানে কোনো কিছুর আংশিক বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি দেখে সামগ্রিক ধারণা তৈরি করা হয়, অথবা সামগ্রিক ধারণা থেকে কোনো অংশের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়। এটি বুঝতে হবে যে, একটি বস্তু বা সিস্টেমের সব অংশ একইভাবে কাজ করে না এবং সামগ্রিক সিস্টেমের গুণাবলি আলাদাভাবে সঠিক নাও হতে পারে। এই কুযুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের যুক্তির ক্ষেত্রে বেশি সাবধান হওয়া উচিত এবং বাস্তবতা ও বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।