13.চেরি পিকিং কুযুক্তি | Cherry picking fallacy

ভূমিকা:

চেরি পিকিং কুযুক্তি তখন ঘটে যখন কেউ প্রমাণ বা তথ্যের মধ্যে থেকে শুধুমাত্র নিজের পক্ষে যায় এমন অংশ বেছে নেয় এবং বাকি প্রমাণগুলো উপেক্ষা করে। এটি যুক্তির একটি ফাঁক তৈরি করে এবং সত্যের পূর্ণ চিত্র না দিয়ে আংশিক বা ভুল ধারণা তৈরি করে। এই প্রবন্ধে চেরি পিকিং কুযুক্তির প্রকৃতি, এর প্রভাব এবং কিছু নতুন উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

চেরি পিকিংয়ের মূল ধারণা:

চেরি পিকিংয়ের মাধ্যমে কিছু তথ্য তুলে ধরে যুক্তি বা দাবির সমর্থনে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তা পুরো তথ্য বা বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কোনো একজন গবেষক যখন একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখছেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন গবেষণার ফলাফলের উল্লেখ করতে পারেন যা তার দাবিকে সমর্থন করে, কিন্তু সেই গবেষণার অন্যান্য বিরোধী ফলাফলের কথা উল্লেখ করেন না। এটি একটি কৌশল যা সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্ত করে।

  • উদাহরণ ১: কোরআনে বিগ ব্যাং
    • দাবীঃ কোরআনে বলা হয়েছে, পৃথিবী এবং আকাশ(মহাবিশ্ব) এক সময় একসাথে ছিল। আল্লাহ পাক তা আলাদা করেন যা বিগ ব্যাং তত্ত্বের দিকেই নির্দেশ করে।
    • প্রশ্নঃ বিগ ব্যাং তত্ত্বে কোথাও বলা হয় নি, পৃথিবী নামক গ্রহ এবং মহাবিশ্ব এক সময় একই বিন্দুতে ছিল। আমাদের অবজারভেবল মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। এবং পৃথিবীর বয়স ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ, পৃথিবী নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরের ঘটনা। তাহলে, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব একসাথে ছিল, এরকম বলার পেছনে যুক্তি কী?
    • এছাড়াও, কোরআন অনুসারে পৃথিবীকে আগে সৃষ্টি করা হয়েছে(সুরা ফুসসিলাত আয়াত ৯-১২), এরপরে আল্লাহ আকাশের দিকে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ আকাশে আমরা যা দেখতে পাই, কোরআন অনুসারে সে সবের বয়স পৃথিবী থেকে কম। অথচ, আমাদের কাছে এরকম তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্র পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরনো, অনেক প্রাচীন। তাহলে, কোরআনের দাবীগুলো সত্য কীভাবে? [ বিস্তারিতঃ ইসলাম এবং বিজ্ঞান শিক্ষার দ্বন্দ্ব ]
    • > লক্ষ্য করুন, প্রথম কথাটির দাবীদার চেরি পিকিং করছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তথ্যের সাথে যতটুকু মিলছে, ততটুকুই উনি বলছেন। অন্যান্য বিষয়াদি উহ্য রেখে। তাই এটি একটি ফ্যালাসি, যাকে আমরা বলি চেরি পিকিং।
  • উদাহরণ ২: রাজনৈতিক প্রার্থীর উপস্থাপনা
    • ধরা যাক, একজন রাজনৈতিক প্রার্থী তার সৎ ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রমাণ করতে বলেন, “আমি প্রতি রবিবার চার্চে যাই, এবং দান করি।” তবে, তিনি তার অন্যান্য নেতিবাচক কাজ, যেমন আর্থিক দুর্নীতি বা বেআইনি কাজগুলো উল্লেখ করেন না। এটি চেরি পিকিংয়ের একটি উদাহরণ যেখানে সুবিধাজনক তথ্য বেছে নিয়ে নিজের পক্ষে প্রচার করা হচ্ছে।
  • উদাহরণ ৩: সিভি ও রেজিউমের চেরি পিকিং
    • চাকরির ক্ষেত্রে চেরি পিকিংয়ের উদাহরণ হলো সিভি বা রেজিউমে কেবল প্রার্থীর ভাল দিকগুলো উল্লেখ করা, এবং নেতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি সিভিতে লিখেছেন, তিনি প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন। কিন্তু এড়িয়ে গেছেন যে, তিনি একইসঙ্গে সময় ব্যবস্থাপনায় দুর্বল এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ সামলাতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে, নিয়োগকর্তা এই আংশিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
  • উদাহরণ ৪: ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে লেখার ভুল ব্যাখ্যা
    • যদি কেউ ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরোধিতা করে লিখেন, তাহলে তাকে ধর্ষকদের সমর্থক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হতে পারে। কিন্তু এটি চেরি পিকিং কৌশল। গণপিটুনির বিরোধিতাকতার মানদণ্ডকে পাশ কাটানো হয়, যা মানবিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। মানে অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং মব জাস্টিস প্রতিরোধ করা। এখানে চেরি পিকিংয়ের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি আংশিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আসল কারণকে অস্বীকার করে।

চেরি পিকিংয়ের প্রভাব:

চেরি পিকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, যা যুক্তি ও সিদ্ধান্তকে ভুল পথে চালিত করে। এটি আলোচনার পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না এবং শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। বিজ্ঞান বা রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই এই কৌশলটি বাস্তবতার পরিপন্থী এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায়।

এছাড়াও, চেরি পিকিং কৌশলের ব্যবহার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অসংগতির সৃষ্টি করে এবং তা একধরনের তথ্যের অপব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ, কোনো চিকিৎসা গবেষণায় যদি কেবলমাত্র সফল পরীক্ষার ফলাফল দেখানো হয় এবং ব্যর্থ পরীক্ষাগুলো গোপন করা হয়, তাহলে এর ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।