ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প একটি কগনিটিভ বায়াস বা জ্ঞানীয় পক্ষপাত, যেখানে মানুষ মনে করে যে পৃথিবী ও প্রকৃতি সর্বদাই ন্যায়সঙ্গত এবং প্রত্যেক মানুষ তার কাজের জন্য যথাযথ পুরস্কার বা শাস্তি পায়। এই বিশ্বাস অনুসারে, সৎ ব্যক্তি শেষমেশ পুরস্কৃত হন, এবং অন্যায়কারী শাস্তি পান। কোন অলৌকিক উপায়ে প্রকৃতি সবকিছুর হিসেব নিকেশ রাখে, এবং যথাযথভাবে সব বিচার হয়! এই ধারণা একটি মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তা দেয় যে, সমাজে কোনো অপ্রত্যাশিত বা অন্যায় ঘটনা ঘটলেও, তা ন্যায়সঙ্গতভাবে সমাধান হবে। যদিও বাস্তবে এমনটি প্রায়শই ঘটে না। এই অনুকল্পটি মানুষের বিচারক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং নানা রকম কুযুক্তি বা বিকৃত ধারণার জন্ম দেয়।
ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প অনেক সময় সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এটি প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। বিশেষত যখন মানুষ কোনো অপ্রত্যাশিত বা অন্যায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন তারা সহজেই অন্যায়কে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে “ন্যায্য বিশ্ব” ধারণাটি ব্যবহার করে। এর ফলে ভিক্টিম ব্লেমিং বা ভুক্তভোগীকে দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়। এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত কিছু কুযুক্তি উদাহরণসহ নিচে আলোচনা করা হলো:
উদাহরণসমূহ:
উদাহরণ ১:
- দাবী: ধর্ষণের শিকার মেয়েটি যদি এতো রাতে একা বাইরে না যেত, তাহলে তার এই পরিস্থিতি হতো না।
এখানে ভিক্টিম ব্লেমিং দেখা যায়। সমাজের রক্ষণশীল কিছু মানুষ মনে করে যে, ধর্ষণ বা অন্য যে কোনো অপরাধমূলক ঘটনার শিকার হওয়া আক্রান্ত ব্যক্তির দোষেই ঘটেছে, এবং এর মাধ্যমে অপরাধীকে ন্যায়সঙ্গতভাবে দায়মুক্ত করা হয়। ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প অনুযায়ী, মেয়েটির সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে, কারণ সে কিছু না কিছু ভুল করেছে বা তার এটা প্রাপ্য ছিল! কিন্তু এটি এক ধরনের কুযুক্তি, যেখানে অপরাধের প্রকৃত দায় অপরাধীর উপর না দিয়ে, ভুক্তভোগীর উপর চাপানো হয়। একইসাথে, এটি একটি সামাজিক ধারণা তৈরি করে, যেখানে বিচারহীনতা ও আক্রান্তকেই দোষারোপ করার বাজে সংস্কৃতি বিকশিত হয়।
উদাহরণ ২:
- দাবী: গরিব মানুষরা গরিবই থাকে, কারণ তারা পরিশ্রম করে না।
এই কুযুক্তির মাধ্যমে বলা হচ্ছে, গরিব হওয়া গরিব মানুষের নিজস্ব দোষ। অথচ দারিদ্র্যের পেছনে জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক কারণ থাকে, যা কোনো ব্যক্তির পরিশ্রমের অভাবের সাথে সম্পর্কিত নাও হতে পারে। হয়তো কেউ খুব দরিদ্র পরিবারে জন্মেছে, যার ফোলে সে ভালভাবে পড়ালেখার সুযোগটিই পায়নি। ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্পের কারণে, মানুষ মনে করে যে কেউ যদি কষ্ট পায় বা গরিব থাকে, তাহলে সেটি তার প্রাপ্য, এবং সে নিজেই তার দুরবস্থার জন্য দায়ী।
উদাহরণ ৩:
- দাবী: ধনী ব্যক্তি সবসময়ই তার সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাই সে ধনী হয়েছে।
এখানে ধনী ব্যক্তির সফলতার পুরো কৃতিত্ব তাকে দেওয়া হয়, এবং বলা হয় যে তার পরিশ্রমই তার সফলতার একমাত্র কারণ। তবে বাস্তবে অনেক সময় বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা, পিতামাতার সহায়তা বা অন্যান্য বাহ্যিক কারণও মানুষের সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্পের কারণে মানুষ সহজেই বিশ্বাস করতে চায় যে সব ধনী মানুষ তাদের ধনসম্পদ অর্জন করেছেন শুধুমাত্র নিজেদের পরিশ্রমের ফলে, যা সর্বদা সত্য নয়।
উদাহরণ ৪:
- দাবী: কেউ যদি অপরাধ করে এবং শাস্তি না পায়, তাহলে ঈশ্বর বা কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি তাকে একদিন শাস্তি দেবে।
এটি এক ধরনের কাল্পনিক বিশ্বাস, যা ন্যায়সঙ্গত বিশ্বে বিশ্বাসের একটি রূপ। যদিও বাস্তবে অপরাধীরা অনেক সময় শাস্তি পায় না, মানুষ মনে করে যে কোনো অলৌকিক শক্তি তাদের শাস্তি দেবে। এই জীবনে না হলে পরকালে তারা শাস্তি পাবে! এই বিশ্বাসের কারণে মানুষ অনেক সময় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে চুপ করে থাকে, বা অবহেলা করে। এবং অপরাধের প্রকৃত শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। যেমন ধরুন, মাদ্রাসায় একটি বালক তার শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলো। সে তার বাবামাকে বিষয়টি জানাবার পরে, বাবামা আইনের শরণাপন্ন হওয়ার বদলে তাকে বোঝাল যে, এর বিচার আল্লাহই একদিন করবে। বা পরকালে ঐ হুজুরের কঠিন বিচার হবে। এরকম বিশ্বাসের কারণে তারা আর আইন বা বিচার ব্যবস্থার ঝামেলার মধ্যে যেতে চাইবে না। যার ফলাফল হিসেবে ঐ শিক্ষক হয়তো আর কয়েকজন বালককে ধর্ষণ করবে। অথচ, ঐ পিতামাতা শুরুতেই আইনের শরণাপন্ন হলে এরকম পরিস্থিতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হতো!
উদাহরণ ৫:
- দাবী: ঐ ব্যাক্তি এতদিন অসুস্থ ছিল কারণ সে কোনো পাপ করেছিল, আর এটি তার শাস্তি।
এই ধরণের ধারণা সামাজিক ও কাল্পনিক বিশ্বাসের অংশ, যেখানে অসুস্থতা বা বিপদকে পাপের ফল হিসেবে গণ্য করা হয়। বাস্তবিকভাবে অসুস্থতা বা শারীরিক কষ্ট বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে শারীরিক অসুস্থতা বা জিনগত কারণে কোনো রোগের সম্ভাবনাও থাকতে পারে। কিন্তু ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্পের কারণে মানুষ মনে করে যে, সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কিছু ভুল করেছে যার ফলে সে শারীরিক কষ্ট পাচ্ছে।
যেমন ধরুন, কোরআনে খুব পরিষ্কারভাবেই বলা আছে,
নিশ্চয়ই তোমার রব যার জন্য ইচ্ছে তাঁর রিযক বাড়িয়ে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছে তা সীমিত করেন; নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, সর্বদ্রষ্টা
( কোরআন ১৭:৩০ )
তাহলে, অপুষ্টির শিকার এই বালকটির রিজিক কে সংকুচিত করে দিয়েছে? তার রিজিক কে সীমিত করে দিয়েছে?
আবার ধরুন, ছয়মাসের একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ম অনুসারে, ছয়মাসের এই বাচ্চাটির সাথে এ কেমন পরীক্ষা? নাকি, এই শিশুরাই তাদের অবস্থার জন্য দায়ী? অনেক ধার্মিক মানুষই মনে করেন, এগুলো এই মানুষদেরই কর্মফল, পরীক্ষা অথবা যা হচ্ছে ভালোর জন্যেই হচ্ছে!
৩. ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্পের প্রভাব ও পরিণতি
ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প মানুষের মানসিকতায় গভীরভাবে প্রোথিত একটি কগনিটিভ বায়াস। এটি মানুষকে সামাজিক বিচ্যুতির প্রতি অসংবেদনশীল করে তোলে এবং অনেক সময় অন্যায় বা অবিচারকেও ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে। এর ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়:
- ভিক্টিম ব্লেমিং: ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার প্রবণতা তৈরি হয়। যেমন ধর্ষণ, নির্যাতন, বা সামাজিক অবিচারের শিকার মানুষদের দোষী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- অপরাধের প্রতি সমর্থন: অপরাধীদের শাস্তি না পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত পৃথিবী বিশ্বাস করে অপরাধকে মেনে নেওয়া হয়। মানুষ মনে করে যে, অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি না দেওয়া হলেও, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি একদিন তাকে শাস্তি দেবে।
- সামাজিক অসংবেদনশীলতা: সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের প্রতি অসংবেদনশীল মনোভাব তৈরি হয়। গরীব বা দুর্বলদের নিজেদের দোষে তাদের অবস্থান বলে মনে করা হয়, এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি কমে যায়।
৪. উপসংহার
ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প একটি বিপজ্জনক কগনিটিভ বায়াস, যা মানুষের নৈতিক বিচারক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি মানুষকে এমন একটি ভুল ধারণা দেয় যে পৃথিবী ন্যায়সঙ্গত, এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার কাজের জন্য প্রাপ্য পুরস্কার বা শাস্তি পায়। এই ধারণার মাধ্যমে মানুষ সহজেই অন্যায় বা অবিচারকে ন্যায্যতা দিতে পারে, এবং ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করে। সমাজে সমানাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই কুযুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিস্থিতি ও দায়িত্ব সঠিকভাবে বিচার করা উচিত।