এবারে আসুন কোরআনে বর্ণিত একটি গল্প পড়ে নেয়া যাক। গল্পটি সেই নূহ নবীর সময়ের কথা। নূহ নবী দীর্ঘদিন তার অঞ্চলের অবিশ্বাসীদের দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছিলেন না। অনেক চেষ্টার পরেও যখন বেশিরভাগ অবিশ্বাসীকে হেদায়াত করতে তিনি সমর্থ হলেন না, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, প্লাবনের সময় আল্লাহ যেন প্রতিটি অবিশ্বাসীকে হত্যা করে। যেন নূহের ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া একটি প্রাণও জীবিত না থাকে। অর্থাৎ নারী শিশু প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ সহ সকল কাফের মরে যায়। আল্লাহ যেন সকলকে মেরে ফেলে! আসুন নূহ নবীর প্রার্থনাটি পড়ি [1] [2] –
নূহ বলল, ‘হে আমার রব্ব! ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী কাফিরদের একজনকেও তুমি রেহাই দিও না।
— Taisirul Quran
নূহ আরও বলেছিলঃ হে আমার রাব্ব! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিওনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর নূহ বলল, ‘হে আমার রব! যমীনের উপর কোন কাফিরকে অবশিষ্ট রাখবেন না’।
— Rawai Al-bayan
নূহ্ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোনো গৃহবাসীকে অব্যাহতি দেবেন না [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
কোরআন, সূরা নূহ, আয়াত ২৬
তুমি যদি তাদেরকে রেহাই দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাহদেরকে গুমরাহ করে দেবে আর কেবল পাপাচারী কাফির জন্ম দিতে থাকবে।
— Taisirul Quran
তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুস্কৃতিকারী ও কাফির।
— Sheikh Mujibur Rahman
‘আপনি যদি তাদেরকে অবশিষ্ট রাখেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং দুরাচারী ও কাফির ছাড়া অন্য কারো জন্ম দেবে না’।
— Rawai Al-bayan
আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্ৰান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুস্কৃতিকারী ও কাফির।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
কোরআন, সূরা নূহ, আয়াত ২৭
ভেবে দেখুন, কাফেররা কাফের সন্তান জন্ম দিতে পারে, এই কারণে নূহ নবী সকল কাফের মেরে ফেলার দোয়া করলেন! কী সীমাহীন নির্মমতা! এই আয়াতগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বা বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের উক্তিগুলোর কথা আমাদেকে মনে করিয়ে দেয়। হিটলার যেমন একটি একটি ইহুদি হত্যা করতে বলেছিল, বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইয়াহিয়া খান যেমন একটি একটি বাঙালি হত্যা করতে বলেছিল, ঠিক তেমনি। যেন তাদের বিপক্ষের আর কোন শিশুর জন্মই না হয়। আমরা কেউ কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, একটি শিশু বড় হয়ে ভাল হবে না মন্দ হবে? তারা মন্দই হবে, এরকম ভেবে তাদের মৃত্যু কামনা করা ভয়াবহ অসভ্য আচরণ। এটি সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ কয়েকবারই ইসলামিক জঙ্গিরা হত্যার চেষ্টা করেছিল। বাঙলাদেশে অনেক নাস্তিককে তারা হত্যাও করেছে। কিন্তু তারপরেও আমি কোন মুসলিমের মৃত্যু কামনা করতে পারি না এই ভেবে যে, সে একটি ইসলামিক জঙ্গি সন্তান জন্ম দিতে পারে! যারা অপরাধের সাথে জড়িত, প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের শাস্তি আমি চাইতে পারি, কিন্তু তাদের জাতি বা সম্প্রদায় ধরে সমূলে উৎখাত করতে বা গণহত্যা চালাতে চাইতে পারি না। কারণ সব মুসলিম নিশ্চিতভাবেই জঙ্গি হতে পারে না, মুসলিমদের মধ্যে অনেক ভাল মানুষ নিশ্চয়ই আছেন। আছে শিশু নারী বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী মানুষও। একইভাবে কাশ্মীরে বা প্যালেস্টাইলে কোন মুসলিম শিশুকে যদি এই বলে হত্যা করা হয় যে, এরা তো বড় হয়ে ইসলামিক জঙ্গিই হবে, আল কায়েদা বা বোকো হারামের সদস্যই হবে, এরকম হলেও ব্যাপারটি যেমন সীমাহীন অসভ্যতা আর নির্মমতা হবে, একইভাবে কোন কাফের শিশু জন্মের আগেই তাদের বংশশুদ্ধ মেরে ফেলা এই ভয়ে যে, তারা কাফের সন্তান জন্ম দিবে, এটিও ভয়ঙ্কর অমানবিক ব্যাপার!
এবারে আসুন নবী মুহাম্মদের জীবন থেকে আরেকটি ঘটনা পড়ি। নবী অনেক চেষ্টার পরেও চাচা আবু তালিবকে ইসলামের পথে আনতে পারলেন না। তখন আল্লাহ একটি আয়াত নাজিল করে নবী মুহাম্মদকে জানালেন, হেদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহই। কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না, কাউকে হেদায়াত করা, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করে তাকে হেদায়াত দান করেন। আসুন আয়াতটি পড়ি [3] –
তুমি যাকে ভালবাস তাকে সৎপথ দেখাতে পারবে না, বরং আল্লাহ্ই যাকে চান সৎ পথে পরিচালিত করেন, সৎপথপ্রাপ্তদের তিনি ভাল করেই জানেন।
— Taisirul Quran
তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎ পথে আনতে পারবেনা। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎ পথে আনেন এবং তিনিই ভাল জানেন কারা সৎ পথ অনুসরণকারী।
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন। আর হিদায়াতপ্রাপ্তদের ব্যাপারে তিনি ভাল জানেন।
— Rawai Al-bayan
আপনি যাকে ভালবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহ্ই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
কোরআন, সূরা কাসাস, আয়াত ৫৬
কোরআনে এটিও বহুবারই বলা হয়েছে, আল্লাহ হচ্ছেন পথ দেখাবার এবং পথভ্রষ্ট করার একমাত্র মালিক [4] [5] –
আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।
যাকে আল্লাহ পথ দেখাবেন, সেই পথপ্রাপ্ত হবে। আর যাকে তিনি পথ ভ্রষ্ট করবেন, সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
এবারে বলুন তো, সূরা নূহের ২৬-২৭ নম্বর আয়াত এবং সূরা কাসাসের ৫৬ নম্বর আয়াত পড়ে আপনার মনে কোন প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে কিনা? সৎভাবে ভাবুন তো, কোন প্রশ্নই কি মনে জাগছে না? নূহের সময় কাফেরদের আল্লাহই যদি হেদায়াত না দিয়ে থাকেন, তারা হেদায়াত পাবে কোথা থেকে? আর এই কারণে সব কাফের মেরে ফেলাটিই বা কেমন কথা?
তথ্যসূত্র
- কোরআন, সূরা নূহ, আয়াত ২৬[↑]
- কোরআন, সূরা নূহ, আয়াত ২৭ [↑]
- কোরআন, সূরা কাসাস, আয়াত ৫৬ [↑]
- কোরআন ১৮:১৭ [↑]
- কোরআন ৭:১৭৮ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"