04.নূহ নবী ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন

ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের সূরা আনকাবুতে (২৯:১৪) বলা হয়েছে, নূহ নবী তার সম্প্রদায়ের মধ্যে ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন। এই দাবি ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, বৈজ্ঞানিকভাবে এর সত্যতা ভয়ঙ্করভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আধুনিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস মানুষের গড় আয়ুর ব্যাপারে যে ধারণা প্রদান করে, তা এই দাবি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রবন্ধটিতে বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে, যেখানে মানুষের গড় আয়ু, ফসিল রেকর্ড এবং জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, নূহ নবী নাকি সেই সময়ে নয়শো পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন [1]

আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম, অতঃপর সে পঞ্চাশ বছর কম হাজার বছর তাদের মাঝে অবস্থান করেছিল। অতঃপর মহাপ্লাবন তাদেরকে গ্রাস করল কারণ তারা ছিল সীমালঙ্ঘনকারী।
— Taisirul Quran
আমিতো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম এবং সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম হাজার বছর অবস্থান করেছিল। অতঃপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে। কারণ তারা ছিল সীমালংঘনকারী।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আমি অবশ্যই নূহকে তার কওমের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করেছিল। অতঃপর মহা-প্লাবন তাদের গ্রাস করল, এমতাবস্থায় যে তারা ছিল যালিম।
— Rawai Al-bayan
আর আমরা তো নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম [১]। তিনি তাদের মধ্যে অবস্থান করেছিলেন পঞ্চাশ কম হাজার বছর। অতঃপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে; এমতাবস্থায় যে তারা ছিল যালিম [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

ইসলামের অনেক দলিল থেকে জানা যায়, প্রাচীন বিশ্বের নবী রাসুলগণ নাকি অনেকেই কয়েকশো বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু আধুনিক সমস্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। প্রাচীন বিশ্বের কোন মানুষই এত বছর জীবিত থাকতে পারতো না। বিজ্ঞানীগণ যে সকল ফসিল রেকর্ড পেয়েছেন, সেগুলো গবেষণা করে জানা যায়, প্রাচীন বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু সাধারণত ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর ছিল। তবে, কিছু ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে কিছু প্রাচীন মানুষ ষাট থেকে সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন। কিন্তু একশো বা তার চাইতে বেশি বয়সেও তারা বেঁচে থাকতেন, এরকম প্রমাণ মেলে না। নয়শো পঞ্চাশ বছর তো অনেক দূরের বিষয়। প্রাচীন কালের মানুষের আয়ু এত হয়ে থাকলে অন্তত কিছু ফসিল তো পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু সেরকম কোন প্রমাণই নেই।

হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ, খ্রিস্টান বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও একই রকমের উদ্ভট কথাবার্তা বলা আছে। আধুনিক সময়ে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, নানা ধরণের ঔষধের আবিষ্কার এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে। গত দুইশো বছরে মানুষের গড় আয়ু অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সময়ে সর্বোচ্চ আয়ুর মানুষ যাকে পাওয়া গেছে, তিনি একজন জাপানের বাসিন্দা ছিলেন। উনার নাম জেনরোম কিউনা। তিনি একশো ষোল বছর, পাঁচ মাস, পনেরো দিন বয়সে মারা যান। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তিনি স্থান পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষ সঠিক চিকিৎসা, শারীরিক পরিশ্রম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে সর্বোচ্চ ১২২ বছর বা এর থেকে কিছু বছর বেশি জীবিত থাকতে পারেন। তবে সেটির সম্ভাবনা খুবই কম।

প্রাচীনকালের মানুষের গড় আয়ু

মানুষের গড় আয়ুর ধারাবাহিক পরিবর্তনের বিষয়ে ধারণা পেতে আমরা প্রাপ্ত প্রমাণ ও গবেষণা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও জীববৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের গড় আয়ু খুবই সীমিত ছিল। প্রাক-আধুনিক যুগে, বিশেষত প্যালিওলিথিক ও নিওলিথিক যুগে, মানুষের গড় আয়ু ছিল ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। উচ্চ মৃত্যুহার, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং প্রতিকূল পরিবেশ এই গড় আয়ুর পেছনের প্রধান কারণ ছিল। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছন্নতার অভাব, জ্ঞানের অভাব, রোগের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি নানা কারণ এর জন্য দায়ী।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে জানা গেছে, মানুষের জীবদ্দশায় গড় আয়ু আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগে ৯৫০ বছর বেঁচে থাকার কোনো প্রমাণ বৈজ্ঞানিকভাবে পাওয়া যায়নি।

ফসিল রেকর্ড এবং বিবর্তন

মানব বিবর্তনের ফসিল রেকর্ডে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রথম দিকের হোমিনিডদের (মানবজাতির পূর্বপুরুষ) গড় আয়ু খুবই কম ছিল। প্রায় ২০০,০০০ বছর আগের হোমো স্যাপিয়েন্স এর প্রাচীনতম ফসিলগুলো থেকে জানা যায়, এদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩০-৩৫ বছর। এমনকি নব্যপ্রস্তর যুগে (Neolithic Age) যখন কৃষিকাজ শুরু হয় এবং মানুষের সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠে, তখনো গড় আয়ু ছিল ৪০-৫০ বছর।

যদি আমরা নূহ নবীর সময়ের কথা বিবেচনা করি, তবে এই সময়টি কোনো ভাবেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক হিসেব অনুযায়ী নয়শো পঞ্চাশ বছরের মতো দীর্ঘ জীবন হওয়ার উপযুক্ত ছিল না। সেই সময়ের ফসিল রেকর্ড ও প্রমাণ অনুযায়ী, মানুষদের জীবদ্দশা ছিল সংক্ষিপ্ত, এবং কোনো প্রাকৃতিক বা জীববৈজ্ঞানিক কারণ নয়শো পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকার দাবি সমর্থন করে না।

মানুষের গড় আয়ুর ক্রমবর্ধমান ধারা

মানুষের গড় আয়ু নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানবজাতির ইতিহাসে গড় আয়ু অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্যযুগেও মানুষের গড় আয়ু ৩০-৪০ বছরের মধ্যে ছিল। তবে বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভাব, যেমন: ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, মানুষের গড় আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বের গড় আয়ু ছিল ৭২.৬ বছর।

জীববৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা

মানবদেহের কোষগুলো ক্রমাগত পুনর্জন্ম এবং পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে জীবিত থাকে। কিন্তু মানবদেহের কোষগুলোর পুনর্জন্মের একটি প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা হেইফ্লিক লিমিট (Hayflick Limit) নামে পরিচিত। এই ধারণা অনুযায়ী, মানুষের কোষগুলো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যকবার বিভাজিত হওয়ার পরে নিজেদের পুনরুৎপাদন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, এবং এর ফলস্বরূপ বয়স বাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানবদেহের জন্য ১২০ বছরের বেশি বেঁচে থাকা প্রাকৃতিকভাবে অসম্ভব। এই সীমাবদ্ধতা এবং অন্যান্য বায়োলজিক্যাল কারণের ভিত্তিতে নয়শো পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

উপসংহার

কোরআনের দাবি যে নূহ নবী নয়শো পঞ্চাশ বছর বেঁচে ছিলেন, তা একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ, তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনো প্রমাণ নেই। মানুষের গড় আয়ু, ফসিল রেকর্ড, এবং জীববৈজ্ঞানিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন যুগে এত দীর্ঘ জীবন সম্ভব ছিল না। বর্তমান জীববিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষের জীবনের একটি প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞান এবং গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

তথ্যসূত্র

  1. সূরা আনকাবুত, আয়াত ১৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"