13.সর্বজ্ঞানী হওয়ার মারাত্মক সমস্যাবলী

ভূমিকা

“ঈশ্বর সর্বজ্ঞ”—এই ঘোষণা প্রায় সকল একেশ্বরবাদী ধর্মে, বিশেষ করে ইসলামে, একটি মৌলিক বিশ্বাস। কোরআন আল্লাহকে পরিচিত করায় ‘আল-আলিম’ (সর্বজ্ঞ), যিনি সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল জ্ঞানের অধিকারী। অর্থাৎ, তার জ্ঞান সীমাহীন এবং সময় ও স্থান থেকে মুক্ত। আল্লাহর জ্ঞানকে এমন এক অবস্থা হিসেবে ধরা হয় যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল বিষয়বস্তু জুড়ে বিস্তৃত।

কিন্তু যদি এই সর্বজ্ঞানের ধারণা বিচার করা হয় দার্শনিক অর্থে, বিশেষ করে ‘অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান’ (experiential knowledge) বা ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’ (knowledge by experience) এর আলোকে, তাহলে আমরা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হই। অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান বলতে আমরা বোঝাই কোনো ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা, কোনো অনুভূতি বা বেদনা সরাসরি উপলব্ধি করা। উদাহরণস্বরূপ,

  • সন্তানহারা মায়ের অন্তরাত্মার যন্ত্রণা ও শোক,
  • ধর্ষিত শিশুর একাকীত্ব ও আতঙ্ক,
  • ক্ষুধার্ত মানুষের তীব্র আর্তনাদ ও দুর্বিষহ কষ্ট।

এই মানবিক অভিজ্ঞতাগুলো কেবল ‘জ্ঞাত’ (known) নয়, বরং ‘অনুভূত’ (felt) ও ‘অভিজ্ঞত’ (experienced)। অর্থাৎ এই মানবিক অভিজ্ঞতাগুলো সম্পর্কে জানাশোনা এগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান দান করে না। এগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে হলে এই সব অভিজ্ঞতাকে ‘অনুভূত’ (felt) ও ‘অভিজ্ঞত’ (experienced) করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ কি এই সকল অভিজ্ঞতাকে শুধুমাত্র ধারণা হিসেবে জানেন, নাকি তিনি সেগুলোকে অনুভবও করতে পারেন? যদি তিনি কেবল ‘জ্ঞাত’ হন, অর্থাৎ তথ্যের স্তরে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তবে কি তিনি সত্যিকার অর্থে সর্বজ্ঞ? ‘সর্বজ্ঞ’ শব্দটি তো আমাদের ধারণা দেয় যে তিনি শুধু তথ্য জানেন না, বরং মানুষের জীবন ও মানসিকতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রাখেন। যদি মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্মতা, বেদনা, প্রেম, ভালোবাসা, শোক, আতঙ্ক—এসব তার কাছে কেবলই তাত্ত্বিক জ্ঞান হয়, তাহলে কি তিনি প্রকৃত সর্বজ্ঞ?

এই দ্বন্দ্ব আমাদের সামনে একটি মৌলিক সমস্যা তুলে ধরে: সর্বজ্ঞতার অর্থ কী? শুধুমাত্র তথ্যগত জ্ঞান, নাকি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্তি? এবং যদি সর্বজ্ঞতা অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে কি ঈশ্বরের ঐ অভিজ্ঞতা মানব অভিজ্ঞতার অনুরূপ হতে পারে? এই প্রশ্নগুলো ইসলামিক ঈশ্বরতত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদেরকে চিন্তা করতে বাধ্য করে যে, আল্লাহর সর্বজ্ঞতা কি শুধু একটি অন্ধবিশ্বাসীদের নির্বোধ দাবী, নাকি তা মানব জীবনের অভিজ্ঞতাগত গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত? এই লেখায় আমরা বিশ্লেষণ করবো কিভাবে ইসলামের আল্লাহর ধারণা এই অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এবং কেন এই দ্বন্দ্ব ঈশ্বরতত্ত্বে এক মৌলিক সমস্যা সৃষ্টি করে।


সর্বজ্ঞ কাকে বলে, এর অর্থ কী

‘সর্বজ্ঞ’ শব্দটি অনেক সময়েই আমরা ব্যবহার করি অত্যন্ত অবলীলায়, বিশেষত ঈশ্বরবিষয়ক আলোচনায়। কিন্তু দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় ‘সর্বজ্ঞ’ (omniscient) সত্তার ধারণা একটি জটিল ও গভীর বিষয়। এখানে ‘জ্ঞান’ বলতে কেবল কিছু তথ্য জানা বোঝায় না; বরং এর ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন স্তরের ও প্রকৃতির জ্ঞান। ‘সর্বজ্ঞ’ সত্তা বলতে বোঝানো হয় এমন একজন, যিনি সকল সত্য—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সম্পর্কে নিখুঁত ও পরিপূর্ণভাবে অবগত। এই জ্ঞানের পরিধি কেবল বাহ্যিক ঘটনার তথ্য নয়, বরং প্রত্যেক জীবের মনের অন্তর্জালে যে অনুভব, আবেগ, যন্ত্রণা বা আনন্দ প্রবাহিত হচ্ছে—তাও এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। অর্থাৎ, ঈশ্বর যদি সত্যিকার অর্থে ‘সর্বজ্ঞ’ হন, তবে তিনি শুধু জানেন না যে কেউ কষ্টে আছে, বরং সেই কষ্টটি কেমন লাগে, তা-ও তিনি অনুভব করেন। যদি অনুভব না করেন, তবে তা কেবল তথ্যগত সর্বজ্ঞতা—যা দর্শনের দৃষ্টিতে খণ্ডিত। তাই ‘সর্বজ্ঞ’ শব্দটির অর্থ হতে হবে এমন এক পরিপূর্ণ জানার ক্ষমতা, যা অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং বাস্তবতার প্রতিটি সূক্ষ্ম স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত।


যৌক্তিক জ্ঞান বনাম উপলব্ধিগত জ্ঞান

এই আলোচনার প্রেক্ষিতে, আমরা জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি—প্রস্তাবনামূলক জ্ঞান (propositional knowledge) এবং অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান (experiential knowledge)

প্রস্তাবনামূলক জ্ঞান হলো এমন জ্ঞান যা যুক্তি ও তত্ত্বের মাধ্যমে অর্জিত হয়, সরাসরি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যেমন, “বরফ ঠাণ্ডা” এই বাক্যটি আমরা বোধগম্য করতে পারি কারণ এটি একটি সাধারণ সত্য। ধরুন, আমাদের হাতে দুটি পাত্র আছে: একটিতে দুইটি আপেল, আরেকটিতে আবার দুইটি আপেল। আমরা যদি দুইটি পাত্রের আপেলগুলো যোগ করি, দেখতে পাবো মোট চারটি আপেল। এবার আমরা ধরে নিতে পারি, একই নিয়ম অনুসারে, যদি দুটি পাত্রে দুইটি দুইটি কমলা রাখা হয়, তাহলে যোগ করলে মোট চারটি কমলা হবে—এটি আমরা সরাসরি কমলা দেখার বা পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছাড়াই যুক্তি দ্বারা অনুমান করতে পারি। এবং এই অনুমান নিছক কোন ভাবাবেগের দ্বারা অনুপ্রাণিত অনুমান নয়, বরঞ্চ যুক্তি প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি যৌক্তিক অনুমান।

অন্যদিকে, অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান (experiential knowledge) হল সরাসরি কোনো বিষয় বা অনুভূতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞান। যেমন, শরীরের মাধ্যমে বরফ স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার স্মৃতি মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে, এবং ঠাণ্ডার প্রকৃত অনুভূতি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি বুঝতে পারেন যিনি বরফ স্পর্শ করেছেন। যিনি কখনো বরফ স্পর্শ করেননি বা ঠাণ্ডার সাথে পরিচিত নন, তার পক্ষে এই অনুভূতি উপলব্ধি করা বা জ্ঞান থাকা অসম্ভব।

সদৃশভাবে, সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কেবল সেই মা-ই বুঝতে পারেন যিনি নিজে তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। অথবা বৃষ্টিতে ভিজে নাচার অনুভূতি, কিংবা একটি গান শুনে মনের ভেতর উদ্ভূত অনুভূতি—এসব কেবল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধি সম্ভব। অন্যের কাছ থেকে শুনে বা জেনে বা শুধুমাত্র তথ্যটি জেনে এই অনুভূতি উপলব্ধি করা অসম্ভব।

এই থেকেই মূল প্রশ্নটি উঠে আসে: আল্লাহ যদি কোনো মানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজে না যান, তবে তিনি কি সেই অভিজ্ঞতা বাস্তব অর্থে জানেন? তিনিও কী সেই অনুভূতি বোধ করেন?


ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্বে আল্লাহর ধারণা

ইসলামে আল্লাহ হলেন অতুলনীয়—“لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ” (তার মতো কোনো কিছুও নেই)। তিনি আদি ও অনন্ত, সময় ও স্থান থেকে মুক্ত, এবং সমস্ত জ্ঞান ও বোধের অধিকারী। কোরআনের বর্ণনায় আল্লাহ সবকিছু জানেন, মস্তিষ্কের গভীরতম কোণ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের তথ্য সম্পর্কে তার অবগতির অভাব নেই। মানব মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিসহ সমস্ত বিষয় তিনি জানেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপলব্ধি ছাড়া সেই জানার প্রকৃতি কেমন?

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহর পক্ষে কোনো শারীরিক বা মানসিক মানবিক যন্ত্রণা ভোগ করা সম্ভব নয়। কারণ ঈশ্বর সর্বোচ্চ, পূর্ণতায় অঙ্গীভূত এবং সীমাবদ্ধতার বাইরে। তিনি সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ।

এখন ভাবুন, একটি শিশুর পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে। এই ব্যাথার তীব্রতা, অবস্থান (ডানপাশে না বামপাশে), ব্যথার প্রকৃতি—এসব কেবল ঐ শিশুরই জানা সম্ভব। কারণ এটি একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যার সঙ্গে কেউ অন্য কেউ সরাসরি মিলিয়ে দেখতে পারে না। এর কোন পরিমাণ হয় না, এর কোন রেকর্ড সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠে: এই শিশুর ব্যথার সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি আল্লাহর জানা কি রকম হতে পারে? যদি আল্লাহ শুধুমাত্র “জানেন,” অর্থাৎ তথ্যগত জ্ঞান রাখেন, তবে কি তিনি সত্যিকার অর্থে “সর্বজ্ঞ” — যিনি সব অভিজ্ঞতার গভীরতায় প্রবেশ করেন? উপলব্ধি করেন? আল্লাহ কি শিশুর সেই ব্যথা অনুভবও করেন?

যদি আল্লাহ সেই ব্যথার অনুভূতি না পান, তাহলে শিশুর সেই ব্যথার পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান আল্লাহর কাছে থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে, আল্লাহর “সর্বজ্ঞতা” কেবল গালভরা বুলিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়, যা মানব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির গভীরতা স্পর্শ করতে পারে না। এই যুক্তি আমাদের সামনে ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্বের এক জটিল ও মৌলিক সমস্যা উত্থাপন করে—অর্থাৎ, উপলব্ধি ছাড়া সর্বজ্ঞতার দাবী কীভাবে হয়?


মানব অভিজ্ঞতার পুনঃনির্মাণ

ভাবুন, যদি এমন একটি মেশিন তৈরি করা যায়… (কাল্পনিক চিত্রকল্প) যদি এমন একটি মেশিন তৈরি করা যায়, যা কোনো মানুষের প্রতিটি অনুভূতি, আবেগ, ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা—যেমন ত্বকের স্পর্শানুভূতি, চোখের অশ্রু, হৃদয়ের আতঙ্ক, প্রেমে পড়ার উত্তাপ, প্রথম প্রেমের প্রেমিকার হাত ধরার কাঁপা অনুভূতি, নিজের কন্যাকে প্রথমবার কোলে নেয়ার অনুভূতি, কিংবা সন্তান হারানোর অসহ্য বেদনা—সব কিছু রেকর্ড করে রাখতে পারে, এবং সেই ডেটা বিশ্লেষণ করে ঐ ব্যক্তির মানসিক অবস্থার প্রতিটি সূক্ষ্ম দিক বুঝে ফেলতে পারে, তাহলে সেই মেশিনটির কাছে ঐ ব্যক্তির অভিজ্ঞতাগুলো সম্পূর্ণভাবে “জানা” হয়ে যাবে। সেই জ্ঞান কেবল বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ নয়—তা হবে অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের পুনঃনির্মাণ। এই মেশিন কোনো কিছুই এড়িয়ে যেতে পারবে না; সে সব কিছু জানতে বাধ্য হবে।

এখানে এক গভীর দার্শনিক প্রশ্ন উঠে আসে। বিখ্যাত দার্শনিক থমাস ন্যাগেল তাঁর প্রবন্ধ “What is it like to be a bat?” (১৯৭৪) তে আলোচনায় আনে যে, প্রত্যেক জীবের অভিজ্ঞতার একটি ‘সাবজেক্টিভ’ দিক থাকে — অর্থাৎ, একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থার অনুভূতি, যেটা বাইরে থেকে কেবল তথ্যগতভাবে বোঝা বা রেকর্ড করা সম্ভব নয়। ন্যাগেল বলেন, অন্য কারো অভিজ্ঞতার ‘মনের ভিতরকার ভাব’ বা ‘what it is like’ বুঝতে পারা সম্ভব নয় শুধুমাত্র বাহ্যিক তথ্যের মাধ্যমে।

অর্থাৎ, একটি মেশিন যতই ডেটা সংগ্রহ করুক না কেন, সেটা ‘অভিজ্ঞতার প্রকৃত গভীরতা’ উপলব্ধি করতে পারবে না—কারণ ‘অভিজ্ঞতা’ কেবল তথ্য নয়, এটি একটি প্রত্যক্ষতাস্বরূপ অনুভূতি যা মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।

এবার, যদি ঈশ্বর সত্যিকার অর্থে সর্বজ্ঞ হন, তাহলে তার জ্ঞান অবশ্যই এই অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে—সেখানে কোনো অভিজ্ঞতা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, তা যত যন্ত্রণাদায়ক বা লজ্জাজনকই হোক না কেন। অন্যথায়, ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা হবে আধা-জ্ঞান, তথ্যগত সীমাবদ্ধতা যুক্ত জ্ঞান।

এখন, এখানে আবার রেনে দেকার্তের ‘কার্তেসিয়ান ডুয়ালিজম’ (Cartesian Dualism) এর কথা স্মরণ রাখা জরুরি, যেখানে তিনি বলেছিলেন মনের অভিজ্ঞতা শারীরিক শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যদি ঈশ্বর শুধু একজন বহিরাগত পর্যবেক্ষক হন, তাহলে তার পক্ষে মানুষের অভ্যন্তরীণ মনের অনুভূতি পূর্ণাঙ্গভাবে জানা সম্ভব নয়।


একটি নীতিকথা: বীরবল ও প্রহরীর গল্প

এখানে একটি চতুর নীতিকথা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। একবার নাকি আকবর এক শিকার অভিযানে গিয়ে বীরবলের সাথে প্রথম মুখোমুখি হন। তার কোনো এক বুদ্ধিদীপ্ত কাজে খুশি হয়ে সম্রাট তাকে একটি আংটি দিয়ে প্রাসাদে এসে দেখা করতে বলেন। বীরবল যখন প্রাসাদের প্রধান ফটকে উপস্থিত হন, তখন তার জীর্ণবস্ত্র দেখে প্রহরীরা তাকে বাধা দেয়। সম্রাটের আংটি দেখে তারা বুঝতে পারে যে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে কোনো পুরস্কারের দাবীদার। প্রাপ্ত পুরষ্কারের অর্ধেক তাদের দিতে হবে এই শর্তে প্রহরীরা তাকে ভেতরে যেতে দেয়।

দরবারে সম্রাট যখন বীরবলকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কী পুরষ্কার আশা করেন, তখন বীরবল নিজের জন্য একশোটি চাবুকের আঘাত চেয়ে বসেন। এই বিস্ময়কর আব্দারের কারণ জানতে চাইলে বীরবল পুরো ঘটনা খুলে বলেন। বুদ্ধিমান বীরবল এই পুরষ্কারটি চান, কারণ তিনি সেই প্রহরীকে উচিত শিক্ষা দিতে চাচ্ছিলেন। তার উপস্থিত বুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়ে আকবর তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীদের পঞ্চাশটি করে চাবুকের আঘাত করতে নির্দেশ দেন এবং বীরবলকে তার একজন উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেন।

এই গল্প আমাদের একটি গভীর দার্শনিক বিষয় শেখায়—যে কোন জ্ঞানের দাবি করবে, তাকেও সেই অভিজ্ঞতার দায়ও বহন করতে হবে। যদি ঈশ্বর দাবি করেন যে তিনি মানবিক অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ জ্ঞান রাখেন, তবে তাকে কেবল সেটির ধারণাগত দিক নয়, বরং সেই অভিজ্ঞতার ব্যথা, শোক, অবসাদ, লজ্জা ও অপমানকেও ধারণ করতে হবে।


সন্তানহারা মায়ের কষ্টের উপলব্ধি

যদি আল্লাহ সর্বজ্ঞ হন, তাহলে তার কাছে একজন সন্তানহারা মায়ের মনের হাহাকার, বেদনা ও অসহ্য কষ্টের পূর্ণাঙ্গ উপলব্ধি থাকতে হবে। অর্থাৎ, আল্লাহ শুধুমাত্র ‘জানেন’ বললেই হবে না, তার ‘অভিজ্ঞতা’ এবং একইসাথে ‘উপলব্ধি’ বা অন্তরগত অনুভূতিও সেই একই গভীরতায় উপস্থিত থাকতে হবে।

এখানে দর্শনে ‘ইন্টারস্পেকশন’ বা আত্মপর্যালোচনার ধারণা প্রাসঙ্গিক। ইন্টারস্পেকশন হলো নিজের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বা অনুভূতি সম্পর্কে স্ব-জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া। একজন সন্তানহারা মা নিজের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাকে গভীরভাবে অনুভব করেন, যা কেবল বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ বা তথ্য-জ্ঞান দ্বারা জানা বোঝা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

আবার, ‘এমপ্যাথি’ বা সহানুভূতির তত্ত্ব বলছে অন্যের অভিজ্ঞতা বোঝার জন্য কেবল তথ্য থাকা যথেষ্ট নয়, অন্তত কিছু মাত্রায় সেই অভিজ্ঞতা ‘মনের ভিতর থেকে’ অনুভব করাও জরুরি। অর্থাৎ, অন্য কারো যন্ত্রণাকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে গেলে সেই যন্ত্রণার ‘মনস্তাত্ত্বিক পুনঃঅভিজ্ঞতা’ প্রয়োজন। যদি আল্লাহ সন্তানের বেদনা উপলব্ধি করতে না পারেন, অর্থাৎ তার সেই অভ্যন্তরীণ মানসিক অনুভূতির দ্বারা তৈরি হওয়া ‘এমপ্যাথি’ না থাকে, তাহলে আল্লাহর সর্বজ্ঞতা অপূর্ণ থাকবে। এ কারণে এই ধারণা ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, যেখানে আল্লাহকে সর্বজ্ঞ এবং সর্বদর্শী বলে বিবেচনা করা হয়।


সমকামী পুরুষের যৌনানন্দের উপলব্ধি

ধরে নিই, একজন সমকামী পুরুষ যিনি নিজের শরীরে অন্য পুরুষের পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করিয়ে যৌন তৃপ্তি অনুভব করেন। তিনি যদি বহুজনের সঙ্গে সহবাস করেন, এবং প্রতিবারই সেই যৌনক্রিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত—আবেগ, উত্তেজনা, শারীরিক সংবেদন, অভ্যন্তরের চাপ ও রিলিজের অনুভব—সবই তার মস্তিষ্কে সঞ্চিত হয়, তবে এই প্রতিটি অভিজ্ঞতা কি সর্বজ্ঞ আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়? আল্লাহ কি সেগুলোও উপলব্ধি করেন? অনুভব করেন? সেই উপলব্ধী, অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান, অনুভূতি ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান আল্লাহর না থাকলে, আল্লাহ কীভাবে সর্বজ্ঞানী বলে নিজেকে দাবী করেন? প্রতিবার কোন পুরুষ যখন তার শরীরে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করান, প্রতিবারই তো একই অনুভূতি ও উপলব্ধী আল্লাহরও হবে, যদি তিনি সর্বজ্ঞ বলে নিজেকে দাবী করেন।

এই প্রশ্ন ধর্মতত্ত্বের একটা স্পর্শকাতর অথচ এড়িয়ে যাওয়ার অযোগ্য দিক উন্মোচন করে: সর্বজ্ঞতার দাবি কি এমন সব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির জ্ঞানও দাবি করে, যা ধর্মীয়ভাবে ‘পাপ’ বা ‘অশুচি’ বলে বিবেচিত হয়?

দর্শনের ভাষায়, এখানে উঠে আসে “knowledge by acquaintance” (পরিচয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান) বনাম “knowledge by description” (বর্ণনার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান) তত্ত্ব। বার্ট্রান্ড রাসেল এই দুইয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য টেনেছেন। তার মতে, কারো অভ্যন্তরীণ অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সত্যিকার জ্ঞান কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি যিনি তা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছেন—তিনিই অর্জন করতে পারেন। বর্ণনার মাধ্যমে কেবল একটা ছায়া পাওয়া যায়, মূল জ্ঞান নয়।

যদি আমরা বলি, ঈশ্বর কেবল “বর্ণনার মাধ্যমে” সেই অভিজ্ঞতাগুলি জানেন, তাহলে তার জ্ঞান সীমিত—তার অভিজ্ঞতা second-hand। পক্ষান্তরে, যদি তিনি সত্যিকার অর্থে তা জানেন, তাহলে তার জ্ঞান ওই সমকামী পুরুষের মনের ভেতরকার শিহরণ ও আনন্দসহ অভ্যন্তরীণ অনুভবও ধারণ করে। তাহলে ঈশ্বরের চেতনাতেও সেই যৌনানন্দের একধরনের অংশগ্রহণ থাকে।

এক্ষেত্রে উদ্ভব হয় আরেকটি সমস্যা, যেটি বিশেষ করে ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্বে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে—আল্লাহ পবিত্র, নিষ্পাপ ও ‘অশুচি’ থেকে মুক্ত। তাহলে, কিভাবে তিনি এমন এক অভিজ্ঞতার পুরোটা ধারণ করতে পারেন, যেটি ইসলামী নৈতিকতার পরিপন্থী বলে বিবেচিত?

এই দ্বন্দ্বের ফলাফল আমাদের টেনে নিয়ে আসে একটি গভীর ও দার্শনিক সিদ্ধান্তে: সর্বজ্ঞতা যদি এমন অভিজ্ঞতাও ধারণ করে যা একজন ঈশ্বরের জন্য ‘অশোভন’ বা ‘অনভিপ্রেত’, তবে ঈশ্বরের পবিত্রতা ও সর্বজ্ঞতার ধারণা পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে।

সুতরাং বলা যায়, সর্বজ্ঞতা নিজেই একটি ধরনের দার্শনিক অভিশাপ—একটি অবস্থা, যেখানে ঈশ্বর নিজের ইচ্ছায়ও নিজেকে কিছু জানা থেকে বিরত রাখতে পারেন না, এমনকি যদি সেই জ্ঞান তার স্বভাব ও নৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধেও যায়।


ধর্ষিত শিশুর উপলব্ধি

ধরি, পাঁচ বা ছয় বছরের একটি মাদ্রাসার শিশু তার মাদ্রাসার শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হলো। এতে তার পায়ুপথ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, রক্ত বের হয়ে তার প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগলো। এই শিশুটির ঠিক কেমন লাগছে, ব্যাথা ও যন্ত্রণার পরিমাণ ঠিক কত, তা শুধুমাত্র এই শিশুটির পক্ষেই জানা সম্ভব। যার এই অভিজ্ঞতা নেই, তার পক্ষে পরিপূর্ণভাবে সেটি কোনদিনই জানা সম্ভব নয়। বাইরে থেকে সেই শিশুটির যন্ত্রণা দেখে তার আসলেই কতটা যন্ত্রণা, তা কোনভাবেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এবং আল্লাহও যদি সেটি জেনে থাকেন, তাহলে সেই অভিজ্ঞতার জ্ঞানটি আল্লাহও হতে হবে, অর্থাৎ উপলব্ধিতেও থাকতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর পশ্চাতদেশেও আল্লাহ ঠিক একই ব্যাথা অনুভব করবেন, নতুবা সেই জ্ঞানটি কিছুতেই পরিপূর্ণ জ্ঞান হবে না।


জিজ্ঞাসাঃ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিহীন জ্ঞান কী পরিপূর্ণ?

যদি আল্লাহ ধর্ষিত শিশুর মনের আতঙ্ক কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের ক্ষুধিত মানুষের চেতনা অনুভব না করতে পারেন, তাহলে কিভাবে তিনি “রহমান ও রাহিম” হন? সহানুভূতির শর্ত কি নয়—অন্যের যন্ত্রণাকে নিজে অনুভব করতে পারা? উপলব্ধি করতে পারা? যদি ঈশ্বর কেবল জ্ঞান রাখেন কিন্তু সেই জ্ঞানের সঙ্গে আবেগ, বেদনা, আতঙ্ক, ভয়, লোভ, লালসা, যৌন আনন্দ, হিংসা, ঘৃণা বা দেহজ অনুভূতি না থাকে, তাহলে তা কি সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ জ্ঞান হয়?


উপসংহার

ইসলামী আল্লাহ ধারণাকে দার্শনিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান ও অনুভূতির বাস্তব উপলব্ধির জ্ঞান সত্যিকার অর্থে একটি ভয়াবহ এবং মারাত্মক অভিশাপ। কারণ প্রতিটি মুহূর্তে তার লক্ষ লক্ষ মানুষের সীমাহীন কষ্টের অনুভূতি উপলব্ধি করতে হচ্ছে। মানুষ একটি সময় ভুলে যায়, স্বজন হারানোর বেদনা কিংবা নিজের শারীরিক যন্ত্রণার কথা। মানুষের মস্তিষ্ক এভাবেই ধীরে ধীরে বিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে যে, মানুষ ক্রমশ এগুলো ভুলে যাবে। কিন্তু আল্লাহর তো সেগুলো ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। মানব মনের আবেগ, অনুভূতি, যন্ত্রণার গভীরতা উপলব্ধি নিশ্চিতভাবেই এক মস্তবড় অভিশাপ। এর ফলে “সর্বজ্ঞ” দাবিটি একটি নির্বোধ দাবী, যা আল্লাহর অসহায়ত্বই প্রমাণ করে।