আবু বকর এবং উমর মিলে যেই কোরআন সংকলন করেন তাকে আদি কোরআন বলা হয়।বলা হয়ে থাকে, এই কোরআন মুহাম্মদের বর্ণিত ধারাক্রম অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেখানে সূরাগুলো আলাদা রেখে দেওয়া হয়েছে; সূরার ক্রমধারা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। আর বলা হয়, এটি সাত হরফ বা সাত কেরাতে লেখা হয়েছে। এ কপিটি হীরার হস্তাক্ষরে লেখা হয়েছে। এই কোরআনে শুধুমাত্র সেই সব আয়াত যুক্ত হয়েছিল, যেগুলো রহিত হয়নি। [1]
এই আদি কোরআনটি আবু বকরের পরে হযরত উমর এর কাছে সংরক্ষিত থাকে। এরপরে সেটি আসে হযরত হাফসা এর কাছে, যিনি হযরত মুহাম্মদের স্ত্রী এবং উমরের কন্যা ছিলেন। এরপরে হযরত উসমান কোরআন সংকলনের কাজে হাত দেন, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্রমধারা অনুসারে কোরআন সংকলন করেন। যা ছিল আবু বকরের কোরআন থেকে অনেকটাই ভিন্ন। উসমানের কোরআনের সাথে আবু বকরের আদি কোরআনের পার্থক্য লক্ষ্য করে সেই সময়ে সেই আদি কোরআনটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, উসমানের কোরআন সম্পর্কে যেন কোন প্রশ্ন উত্থাপিত না হয় যে কারণে। সেই কোরআনটি যদি হুবুহু উসমানের কোরআনের অনুরূপই হতো, তাহলে সেটি পুড়িয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না [2] [3] –
শুধু যে আদি কোরআনই পোড়ানো হয়েছিল তাই নয়, কোরআনের আর যত কপি ছিল, সবই উসমানের নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রশ্ন জাগে, সেইসব কোরআন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কেন? সারা পৃথিবীতে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে, পুরনো কপিগুলোকে মিউজিয়ামে কিংবা পুরনো সংরক্ষণাগারে সংরক্ষণ করা এবং নতুন সংশোধিত কপিগুলোকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। মিউজিয়ামে বা সংরক্ষণাগারের কপিগুলোকে গবেষক এবং পণ্ডিতদের জন্য সংরক্ষণ করা ঐতিহাসিক কারণেই অত্যন্ত জরুরি। সারা পৃথিবীতেই এভাবে পুরনো সমস্ত জরুরি নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু উসমান সেই পুরনো কোরআনের কপিগুলো পুড়িয়ে কেন ফেলেছিলেন? আসুন বুখারী শরীফ থেকে আরেকটি হাদিস পড়ে নেয়া যাক, [4] [5]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৩/ ফাজায়ীলুল কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন সংকলন
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৮৭ – ৪৯৮৮
৪৬২৬। মূসা (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) একবার উসমান (রাঃ) এর কাছে এলেন। এ সময় তিনি আরমিনিয়া ও আযারবাইজান বিজয়ের ব্যাপারে সিরীয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের জন্য রণ-প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কুরআন পাঠে তাঁদের মতবিরোধ হুযায়ফাকে ভীষণ চিন্তিত করল। সুতরাং তিনি উসমান (রাঃ) কে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! কিতাব সম্পর্কে ইহুদী ও নাসারাদের মত মত পার্থক্যে লিপ্ত হবার পূর্বে এই উম্মতকে রক্ষা করুন। তারপর উসামান (রাঃ) হাফসা (রাঃ) এর কাছে জনৈক ব্যাক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের সহীফাসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা সেগুলোকে পরিপূর্ণ মাসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আমরা তা আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব।
হাফসা (রাঃ) তখন সেগুলো উসমান (রাঃ) এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর উসমান (রাঃ) যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ), সাঈদ ইবনু আস (রাঃ) এবং আবদুর রহমান ইবনু হারিস ইবনু হিশাম (রাঃ) কে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাসহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। এ সময় উসমান (রাঃ) তিনজন কুরাইশী ব্যাক্তিকে বললেন, কুরআনের কোন বিষয়ে যদি যায়দ ইবনু সাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতপার্থক্য দেখা দেয়, তাহলে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তাই করলেন। যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয়ে গেল, তখন উসমান (রাঃ) মূল লিপিগুলো হাফসা (রাঃ) এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কুরআনের লিখিত মাসহাফ সমূহের এক একখানা মাসহাফ এক এক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এতদভিন্ন আলাদা আলাদা বা একত্রে সন্নিবেশিত কুরআনের যে কপিসমূহ রয়েছে তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
ইবনু শিহাব (রহঃ) খারিজা ইবনু যায়দ ইবনু সাবিতের মাধ্যমে যায়দ ইবনু সাবিত থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা যখন গ্রন্থকারে কুরআন লিপিবদ্ধ করছিলাম তখন সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমার থেকে হারিয়ে যায়; অথচ আমি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পাঠ করতে শুনেছি। তাই আমরা অনুসন্ধান করতে লাগলাম। অবশেষে আমরা তা খুযায়মা ইবনু সাবিত আনসারী (রাঃ) এর কাছে পেলাম। আয়াতটি হচ্ছে এইঃ “মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তাঁরা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি”। (৩৩: ২৩)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
তথ্যসূত্র
- তারিখুল কোরআনিল কারিম, তাহের আল কুরদি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮ [↑]
- উলুমুল কোরআন, তাকী উসমানি, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৭ [↑]
- তারীখে ইসলাম, সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইসলাম, আধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২৮ [↑]
- সহিহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৬২৬ [↑]
- সহিহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩৩৮ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"