প্রথম সূরার মত শেষ সূরা নিয়েও রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। অনেকেই বলে থাকেন, সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতই হচ্ছে কোরআনের শেষ আয়াত, কারণ এখানে বলা হচ্ছে, [1]
আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। অতএব যে ব্যাক্তি তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে; কিন্তু কোন গোনাহর প্রতি প্রবণতা না থাকে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল।
সমস্যা হচ্ছে, দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দেয়ার পরে আল্লাহ পাকের আবারো সূরা নাজিলের কেন প্রয়োজন হলো? দ্বীন যদি ওই আয়াতের মাধ্যমে পুর্নাঙ্গই হয়ে গিয়ে থাকে, এর পরে আবার আয়াত নাজিল হওয়ার তো কথা নয়। এই নিয়েও রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। বিভিন্ন জনার বিভিন্ন অভিমত এখানে উল্লেখ করা হলো।
প্রথম অভিমতঃ রিবা বা সুদ বিষয়ক আয়াত সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত।
ইবনে আব্বাস রাযি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: সর্বশেষে নাযিল-হওয়া আয়াত হলো আয়াতুর রিবা (সুদ বিষয়ক আয়াত) অর্থাৎ [2]
‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও’
হজরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ [3] [4]
আল কুরআনের সর্বশেষ যা নাযিল হয়েছে, তা হলো ‘রিবা’র আয়াত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ব্যাখ্যা করার পূর্বেই পরলোকগত হন। অতএব তোমরা সুদ ও সন্দেহ পরিত্যাগ করো।’
( তাফসীরে তাবারী, খণ্ডঃ ৬, পৃঃ ৩৮ )
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘উমর (রা.) আমাদের উদ্দেশ্য করে খুতবা দিলেন, অতঃপর তিনি বললেন: নিশ্চয় সর্বশেষ নাযিল হওয়া কুরআন হলো ‘রিবা’র আয়াত।’
(সূয়ুতী, আল ইতকান, খণ্ড:৬, পৃ:৩৫)
এছাড়া শায়খ মাহমুদ শাকের বলেছেন যে হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদের (দ্র: তাফসীরে তাবারী, খণ্ডঃ ৬, পৃঃ ৩৯)
দ্বিতীয় অভিমতঃ কিছু কিছু তাফসিরবিদদের মতে আল কুরআনের সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত হলো [5] –
আর তোমরা সে দিনের ভয় কর, যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা উপার্জন করেছে, তা পুরোপুরি দেয়া হবে। আর তাদের যুলম করা হবে না
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল কুরানের সর্বশেষ যা নাযিল হয়েছে, তা হলো وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ (নাসাঈ; বায়হাকী, )
ইবনে মারদুবেহ ও ইবনে জারীর তাবারীও ইবনে আব্বাস (রা.). থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। [6] [7]
তৃতীয় অভিমতঃ কারো কারো মতে আলা কুরআনের সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত হলো সূরা নিসার কালালাহ সম্পর্কিত আয়াতটি। কালালাহ হলো পিতামাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি। ইরশাদ হয়েছে-
তারা তোমার কাছে সমাধান চায়। বল,‘আল্লাহ তোমাদেরকে সমাধান দিচ্ছেন কালালা (‘পিতা মাতাহীন নিঃসন্তানকে ‘কালালা’ বলা হয়) সম্পর্কে। কোনো ব্যক্তি যদি মারা যায় এমন অবস্থায় যে, তার কোনো সন্তান নেই এবং তার এক বোন রয়েছে, তবে সে যা রেখে গিয়েছে বোনের জন্য তার অর্ধেক, আর সে (মহিলা) যদি সন্তানহীনা হয় তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু যদি তারা (বোনেরা) দু’জন হয়, তবে সে যা রেখে গিয়েছে তাদের জন্য তার দুই তৃতীয়াংশ। আর যদি তারা কয়েক ভাই বোন পুরুষ ও নারী হয়, তবে পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান হবে’। আল্লাহ তোমাদেরকে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যাতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও এবং আল্লাহ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সর্বজ্ঞ’-(সূরা আন নিসা: ১৭৬)। (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
উক্ত বর্ণনার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে তা মূলত মিরাছ তথা মৃতব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদের ভাগবণ্টন বিষয়ক হুকুম-আহকাম বর্ণনার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আয়াত।
চতুর্থ অভিমতঃ কারো কারো মতে সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াত হলো সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার বাণী, [8]
‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তা তার জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আত-তাওবা:১২৮)। (বর্ণনায় হাকেম)
এ আয়াতের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তা মূলত সূরায়ে বারাআত তথা সূরা তাওবার শেষ আয়াত। অর্থাৎ সূরা তাওবার আয়াতসমূহের মধ্যে এটি হলো সর্বশেষে নাযিল হওয়া আয়াত।
পঞ্চম অভিমতঃ কারো কারো মতে সূরা আল মায়েদা হলো সর্বশেষ নাযিল হওয়া সূরা। তিরমিযী ও হাকেম আয়াশা (রা.) থেকে এ বিষয়ক একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। এ মতের খণ্ডনে বলা হয়েছে যে সূরা মায়েদা মূলত হালাল হারাম বর্ণনার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সূরা যার কোনো হুকুমই মানসুখ হয়নি।
তথ্যসূত্র
- কোরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত ৩ [↑]
- কোরআন, সূরা আল বাকারা, আয়াত ২৭৮ [↑]
- তাফসীরে তাবারী, খণ্ডঃ ৬, পৃঃ ৩৮ [↑]
- সূয়ুতী, আল ইতকান, খণ্ডঃ ৬, পৃঃ ৩৫ [↑]
- কোরআন, সূরা আল বাকারা, আয়াত ২৮১ [↑]
- আদ্দুররুল মানসুর, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭০[↑]
- তাবারী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১ [↑]
- কোরআন, সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১২৮ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"