পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানগণ যখন যান, তারা সেই সব দেশে ইসলাম প্রচারের অধিকার এবং অনুমতি চান। প্রতিটি সভ্য দেশেই তাদের নিজ ধর্ম পালন এবং তার প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্র, সংবিধান এবং আইন অনুসারে প্রতিটি সভ্য দেশে মুসলিমরা সমান অধিকার ভোগ করতে পারেন। কারণ, সভ্য দেশগুলো প্রায় সবই ধর্মনিরপেক্ষ; তারা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের অধিকারকে বিবেচনা করে না, বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমানভাবে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মুসলিমরা যখন কোন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তখন তারা সেই দেশে শরিয়া আইন কায়েম করার চেষ্টা করতে থাকে, যা মূলত একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং অধিকার-বঞ্চনামূলক ব্যবস্থার প্রতিফলন। ইসলামী শরিয়া আইনে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়, তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ সীমিত বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়। এই মনোভাব ও আচরণ একটি বিপজ্জনক দ্বৈতনীতি এবং ভণ্ডামির পরিচায়ক যা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি একটি বড় আঘাত।
সভ্য দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ নিয়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রবেশের সুযোগ পান, কেউ তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেয় না, এমনকি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়; কিন্তু যখন মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তখন তারা এই সুযোগের অপব্যবহার করে ইসলামি শরিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এটি একটি বড় ধরণের বৈষম্যমূলক আচরণ যা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ধারণা হলো সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং কোন ধর্মই রাষ্ট্রের ওপর তার আইন চাপিয়ে দিতে পারবে না। ধর্মের ভিত্তিতে কেউ কাউকে বৈষম্য করবে না। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, সেখানে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয় এবং শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করা হয়।
এই আচরণ একটি সরাসরি বৈষম্য যা সভ্য বিশ্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য বিপজ্জনক। মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবি করেন, কিন্তু তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই অমুসলিমদের উপর ধর্মীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেন, যা অত্যন্ত আত্মঘাতী ও বিভাজনমূলক। এই বৈপরীত্যপূর্ণ আচরণ শুধুমাত্র ঐক্যের ভিত্তি দুর্বল করে না, বরং সমাজের মধ্যে অবিশ্বাস এবং হিংসার বীজ বপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এভাবে ইসলামের অনুসারীগণ অন্য ধরণের মৌলবাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করছে। অনেক মুসলিমের এই আচরণ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান বা ইহুদীদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে, এবং তাদেরকেও ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মুসলিমদের উচিত, ধর্মনিরপেক্ষতার সুবিধা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ধর্মীয় শাসন চাপিয়ে না দেওয়া; যেই ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ তারা নিচ্ছে তার আদর্শগুলো সমুন্নত রাখা। তাদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করা। ধর্মীয় উগ্রতা এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি সকলের জন্যেই প্রযোজ্য। সভ্য দেশগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিসেবে যতটা অধিকার ভোগ করতে পারে, তেমনটাই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশেও সংখ্যালঘুদের জন্য নিশ্চিত করা উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরেও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধরে রাখা এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ করা সভ্য ও মানবিক সমাজের লক্ষণ। যদি মুসলমানরা নিজে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ করতে চান, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরেও সেই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তাদের আরও সচেতন এবং সহিষ্ণু হওয়া উচিত। এমন একটি সমাজ গঠন করা যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক সম্মানের উপর ভিত্তি করে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে, সেটিই মানবজাতির জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর পথ। এই বিষয়ে প্রখ্যাত ইসলামিক দাইয়ি জাকির নায়েক কী বলেছেন সেটি দেখে নেয়া যাক-
শরিয়া বা ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নতুন কোন উপাসনালয় তৈরি করা যায় না। হযরত উমর শাম দেশের নাগরিকদের সাথে একটি চুক্তি করেছিলেন, যেই চুক্তিটি ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং এই চুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে অমুসলিমদের সাথে মুসলিমরা চুক্তি করে থাকে। এই চুক্তিটি তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে পড়ে নিই। [1]। এই প্রসঙ্গে একটি ভিডিও দেখে নেয়া যাক,
এখানে পরিষ্কারভাবেই বলা হচ্ছে, অমুসলিমগণ নতুন কোন উপাসনালয় তৈরি করতে পারবে না, মেরামত করতে পারবে না, যেগুলো মুসলিমগণ দখল করেছে তা ফেরত নিতে পারবে না, টুপি পাগড়ি জুতা পরতে পারবে না, ঘোড়ায় চড়লে গদি ব্যবহার করতে পারবে না, ধর্ম প্রচার করতে পারবে না, মৃতদেহ বহনের সময় জোরে কাঁদতে পারবে না, ইত্যাদি।
হানাফী ফিকাহশাস্ত্রের বুনিয়াদি গ্রন্থ আশরাফুল হিদায়াতে এই বিষয়ে যা বলা হয়েছে, সেটিও জেনে নিই, [2]
তথ্যসূত্র
- তাফসিরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৬৬-৫৬৭ [↑]
- আশরাফুল হিদায়া, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৩-৪৯৫ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"