একটি শিশু, তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিকাশের নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। তার মা-বাবা এবং পরিবার যা শেখায়, সেই শিক্ষাই তাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে ধর্মের ক্ষেত্রে, শিশুদের ওপর প্রভাবিত করা আরও সহজ হয়, কারণ তাদের মন তখনো নৈতিক বিচার, স্বাধীন চিন্তা বা কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিপক্বতা লাভ করেনি। এ পরিস্থিতিতে, যদি একটি শিশু তার নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছায় কোন ধর্ম গ্রহণ করতে না পারে এবং তাকে শৈশব থেকে বাধ্য করা হয়, শাস্তি কিংবা মারধোরের মাধ্যমে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, তখন এর নৈতিক ও মানবিক দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠে। হাদিসে উল্লেখ আছে, বাচ্চারা নামাজ না পড়লে মুহাম্মদ তাদের পেটাতে নির্দেশ দিয়েছেন [1] [2] –
সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ২/ সালাত (নামায)
৪৯৫. মুআম্মাল ইবনু হিশাম …………. আমর ইবনু শুআয়েব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তাঁর পিতা এবং দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমাদের সন্তানরা সাত বছরে উপনীত হবে, তখন তাদেরকে নামায পড়ার নির্দেশ দেবে এবং তাদের বয়স যখন দশ বছর হবে তখন নামায না পড়লে এজন্য তাদেরকে মারপিট কর এবং তাদের (ছেলে-মেয়েদের) বিছানা পৃথক করে দিবে।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ২/ সালাত (নামায)
৪৯৪. মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা …….. আবদুল মালিক থেকে পর্যায়ক্রমে তাঁর পিতা এবং তাঁর দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তাদেরকে নামায পড়ার নির্দেশ দাও এবং যখন তাদের বয়স দশ বছর হবে তখন নামায না পড়লে এজন্য তাদের শাস্তি দাও- (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
- ১. শিশুর উপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার নৈতিক দ্বন্দ্ব
- ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে ইসলাম ধর্ম শেখানোর জন্য বাধ্যতামূলক কিছু নিয়ম আছে। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, সন্তানকে নামাজ শেখানো এবং ইসলামিক অনুশাসন মানতে বাধ্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে, যদি শিশু ১০ বছর বয়সে নামাজ না পড়ে, তবে তাকে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, মুহাম্মদ (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন শিশুদের নামাজ শেখানোর জন্য প্রথমে উৎসাহিত করতে, তারপরও না মানলে শাস্তি দিতে, এমনকি শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
- এখানে প্রথম যে নৈতিক সমস্যা দেখা দেয় তা হলো, একটি শিশু কোনো ধর্ম অনুসরণ করবে কি করবে না, সে বিষয়ে কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। যখন একজন শিশু ধর্মীয় বিধান মানতে বাধ্য হয়, তখন তার ইচ্ছার কোনো গুরুত্ব থাকে না। বিশেষত, যখন শারীরিক শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়, তখন তার উপর ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়া হয় যা নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
- ২. শিশুর স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ
- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, শিশুদের শারীরিক শাস্তি বা নির্যাতন কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (UNCRC) অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই সনদে বলা হয়েছে যে, শিশুদের উপর কোনরকম শারীরিক শাস্তি বা নির্যাতন করা যাবে না। তাছাড়া, এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে প্রতিটি শিশুর নিজস্ব চিন্তার অধিকার আছে এবং সে তার নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস মেনে চলতে পারবে।
- কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে, শারীরিক শাস্তির হাদিসটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একটি শিশু যখন ধর্মীয় বিধান মেনে চলতে বাধ্য হয় এবং শাস্তির মাধ্যমে তা তাকে শেখানো হয়, তখন তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে করে শিশুর স্বাধীন চিন্তা এবং তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গঠনের সুযোগ হারিয়ে যায়। ইসলামী শাস্তির এই বিধান মানবাধিকার সংস্থার দৃষ্টিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অমানবিক।
- ৩. শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং চিন্তার স্বাধীনতা
- একটি শিশু যখন কোনো ধর্মীয় আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হয়, তখন তার চিন্তার স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুদের মনের ওপর শারীরিক শাস্তির হুমকি এবং চাপ তাদের স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে বাধা দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা একমত যে, শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় বিধান তাদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং কঠোর বিধি-বিধান তাদের চিন্তার স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্রতাকে বিকশিত হতে বাধা দেয়।
- এতে করে শিশুরা আসলে কোন ধর্ম সঠিক আর কোনটি ভুল তা বিচার করার সুযোগ পায় না। তারা শুধুমাত্র শিখিয়ে দেওয়া ধর্মই অনুসরণ করে। এটি পরবর্তীতে তাদের জীবনদর্শনকে সংকীর্ণ করে দিতে পারে, কারণ তারা কোনো বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলো দেখতে সক্ষম হয় না।
- ৪. বড় হওয়ার পর ধর্মীয় স্বাধীনতার অভাব
- যদিও ইসলামে বলা হয় যে, “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই” (কোরআন ২:২৫৬), তবে বাস্তবিক ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে শিশুদের ক্ষেত্রে এই নীতিটি কার্যকর হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ধর্মীয় আচার পালনে তাদের বাধ্য করা হয় এবং তারা কোন বিকল্প চিন্তা করতে পারে না। বড় হওয়ার পরও অনেকেই ধর্মের বাইরে কোনো চিন্তা করতে পারে না, কারণ ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তাদের মানসিক গঠনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে তারা কখনোই প্রকৃত অর্থে তাদের নিজের বিশ্বাস নিয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সক্ষম হয় না।
- ৫. শারীরিক শাস্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
- একটি শিশুকে শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়ার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। শিশুদের ওপর শারীরিক শাস্তি বা হুমকি তাদের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা একমত যে, শারীরিক শাস্তি শিশুদের মধ্যে ভয় এবং হতাশার জন্ম দেয়, যা তাদের ভবিষ্যত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শাস্তির মাধ্যমে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেখানোর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের চিন্তার স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- ৬. ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্ন
- মানবাধিকার সনদ অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু যখন একটি শিশু বয়সে ছোট থাকে এবং তাকে ধর্মীয় আচার মেনে চলতে বাধ্য করা হয়, তখন তার সেই অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। শিশুদের উচিত তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সময় এবং স্বাধীনতা পাওয়া। ইসলামিক শাস্তির বিধান এই স্বাধীনতাকে খর্ব করে, যা একটি নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
উপসংহার
ইসলামে শিশুকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করা এবং শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান শেখানোর পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। শিশুদের এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া তাদের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্ব গঠনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানবাধিকার সনদ এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শিশুকে ধর্ম শেখানো উচিত তার চিন্তা এবং ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে, কোনো প্রকার শারীরিক শাস্তি বা বাধ্যবাধকতা ছাড়াই।
তথ্যসূত্র
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"