10.আদম ও মুসার বাদানুবাদ

হাদিসে বর্ণিত আদম ও মুসার বিতর্ক থেকে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—যদি আদমের কার্যক্রম (যেমন, নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়া ও জান্নাত থেকে বহিষ্কার হওয়া) তার সৃষ্টির বহু পূর্বেই আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আদমের কাছে সেই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধতা বা অপরাধের কোনো প্রশ্নই উঠে না। এই যুক্তি অনুসারে, যেহেতু তাড়াতে লিখিত ওই বক্তব্য আল্লাহর নিশ্চিত জ্ঞান ছিল, তাই আদম মূলত এমন একটি কাজ করেছেন যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং তিনি কোনোভাবেই তা পরিবর্তন করতে পারতেন না। সুতরাং, মুসার অভিযোগ, আদম তাদের জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছেন, যুক্তিসঙ্গত নয় এবং আদমের জন্য অন্যায় শাস্তি বা দায় আরোপ করা একদমই যৌক্তিক নয়। যদি আল্লাহ আদমের কর্ম এবং পরবর্তী পরিণতি আগেই নির্ধারণ করে রাখেন, তাহলে আদমের সেই কর্মে কোনো ব্যক্তিগত দোষ বা অবহেলার প্রশ্ন উঠে না, বরং সেটি আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার অংশমাত্র।

এই ধারণা দার্শনিকভাবে অসঙ্গত ও সমস্যাযুক্ত, কারণ এতে আল্লাহর ন্যায়বিচার নিয়ে বড় ধরণের প্রশ্নবোধকতা দেখা দেয়। যদি আল্লাহর তাকদীরের জ্ঞান নিশ্চিত জ্ঞান হয়, সবকিছু পূর্বনির্ধারিত থাকে এবং ব্যক্তি কি করবে না করবে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই ব্যক্তির প্রতি শাস্তি বা পুরস্কার প্রদান কতটুকু ন্যায়সঙ্গত? এটি আসলে একটি জটিল দার্শনিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে—যেখানে আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা ও পূর্বনির্ধারণের ধারণা এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও দায়বদ্ধতার ধারণা পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এই হাদিসের আলোকে, ইসলামের তাকদীর সম্পর্কিত মৌলিক নীতির সাথে ন্যায়বিচারের ধারণার অসামঞ্জস্যতা ফুটে ওঠে, কারণ এখানে আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত তাকদীর ও মানবজাতির ইচ্ছাশক্তি একে অপরকে বাতিল করে দেয়। যদি আল্লাহ আদমের ভুলের জন্য তাকে শাস্তি না দেন, তবে তা ন্যায়সঙ্গত, কিন্তু যদি তাকে শাস্তি দেওয়া হয়, তবে সেটি অন্যায়ের শামিল, কারণ আদমের কর্ম পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, ইসলামের ন্যায়বিচার ও আল্লাহর জ্ঞানের সর্বোচ্চতা নিয়ে গভীর যৌক্তিক ও দার্শনিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা ইসলামের ধারণাগত কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে [1] [2]

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৮/ তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ২. আদম (আঃ) ও মুসা (আঃ) এর বিতর্ক
৬৫০১। মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম, ইবরাহীম ইবনু দীনার, ইবনু আবূ উমর মাক্কী ও আহমাদ ইবনু আবদ দাব্বিয়্যু ও তাঊস (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও মূসা (আলাইহিস সালাম) এর মধ্যে বিতর্ক হয়। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আদম! আপনি আমাদের পিতা, আপনি আমাদের বঞ্চিত করেছেন এবং জান্নাত থেকে আমাদের বের করে দিয়েছেন। তখন আদম (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, আপনি তো মূসা। আল্লাহ তা’আলা আপনার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে মনোনীত (সম্মানিত) করেছেন এবং আপনার জন্য তার হাতে লিখে (কিতাব তাওরাত) দিয়েছেন। আপনি কি এমন বিষয়ে আমাকে তিরস্কার করছেন যা আমার সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বে আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ আদম (আলাইহিস সালাম) মূসা (আলাইহিস সালাম) এর উপর তর্কে বিজয়ী হলেন।

আর ইবনু আবূ উমর ও ইবনু আবাদাহ বর্ণিত হাদীসে তাদের একজন বলেছেন,خَطَّ অন্যজন বলেছেন,كَتَبَ তিনি তার হাতে তোমার জন্য তাওরাত লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৮/ তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ২. আদম (আঃ) ও মুসা (আঃ) এর বিতর্ক
৬৫০২। কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও মূসা (আলাইহিস সালাম) পরস্পরে বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি তো সেই আদম (আলাইহিস সালাম) যিনি লোকদের গোমরাহ করেছেন এবং জান্নাত থেকে তাদের বহিস্কার করেছেন। তখন আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি তো সেই ব্যক্তি (নবী) যাতে আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয়ে ইলম দান করেছেন এবং রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, হ্যাঁ। আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি আমাকে এমন একটি ব্যাপারে ভৎসনা করেছেন, যা আমার সৃষ্টির পূর্বে আমার উপর নির্ধারণ করা হয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৮/ তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ২. আদম (আঃ) ও মুসা (আঃ) এর বিতর্ক
৬৫০৩। ইসহাক ইবনু মূসা ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু মূসা, ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ইয়াযীদ আনসারী (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁদের প্রতিপালকের কাছে তর্কে অবতীর্ণ হলেন। আদম (আলাইহিস সালাম) মূসা (আলাইহিস সালাম) এর উপর বিজয়ী হলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি তো সেই আদম (আলাইহিস সালাম) যাকে আল্লাহ তা’আলা আপন হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনার মাঝে তিনি তাঁর রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, তিনি তাঁর ফিরিশতাদের দ্বারা আপনাকে সিজদা করিয়েছেন এবং তাঁর জান্নাত আপনাকে বসবাস করতে দিয়েছেন। এরপর আপনি আপনার ভুলের দ্বারা মানুষকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছেন।
আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি তো সেই মূসা (আলাইহিস সালাম) যাকে আল্লাহ তা’আলা রিসালাতের দায়িত্ব ও তার কালামসহ বিশেষ মর্যাদায় মনোনীত করেছেন এবং আপনাকে দান করেছেন ফলকসমূহ (তাওরাত কিতাব), যাতে সব কিছুর বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে এবং একান্তে কথোপকথনের জন্য অন্যান্যকে নৈকট্য দান করেছেন। আচ্ছা আমার সৃষ্টির কত বছর আগে আল্লাহ তায়ালা তাওরাত লিপিবদ্ধ করেছেন বলে আপনি দেখতে পেয়েছেন? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, চল্লিশ বছর আগে। আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি কি তাতে একথা পেয়েছেন, আদম তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশ অমান্য করেছে এবং পথ হারা হয়েছে। বললেন, হ্যাঁ।
আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন,
এরপর আপনি আমাকে আমার এমন কাজের জন্য কেন তিরস্কার করছেন যা আমাকে সৃষ্টি করার চল্লিশ বছর আগে আল্লাহ তাআলা আমার উপর নির্ধারণ করে রেখেছেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এরপর আদম (আলাইহিস সালাম) মূসা (আলাইহিস সালাম) এর উপর বিজয়ী হলেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

মুসা
মুসা 1
মুসা 3
মুসা 5
মুসা 7

আসুন এই সম্পর্কে আলেমদের বক্তব্য শুনি,

তথ্যসূত্র

  1. সহিহ মুসলিম, ষষ্ঠ খণ্ড , ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৯ []
  2. তাহক্বীক্ব মিশকা-তুল মাসা-বীহ (১ম খণ্ড) []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"