12.নবীর স্বজনপ্রীতি ও নিকটাত্মীয়দের জান্নাত

নবী মুহাম্মদ তার পরিবারের অনেককেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। শুধু সুসংবাদই নয়, রীতিমত সর্দার হওয়ার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। নবীর পরিবারে ভাগ্যক্রমে জন্ম নেয়া বাদে তারা পৃথিবীর সকল মানুষের চাইতে কোন দিক দিয়ে উন্নত এবং মানুষের উপকারের জন্য তারা কী করেছে, তা বোধগম্য নয়। তথাপি, নবী তার কন্যা ফাতিমাকে জান্নাতে মহিলাদের সর্দার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেছেন। তিনি কী মারিয়া কুরী কিংবা মাদার তেরেসার চাইতেও মহান কিছু কাজ করেছেন? বা হাইপেশিয়া, কিংবা বেগম রোকেয়া? করে থাকলে সেগুলো কী? কোন যোগ্যতায় তিনি জান্নাতে মহিলাদের সর্দার হলেন? নাকি, নবীর মেয়ে হওয়াই জান্নাতের সর্দার হওয়ার যোগ্যতা?

পৃথিবীর সামাজিক কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের জীবনযাত্রা ও পেশা বংশপরম্পরায় নির্ধারিত হয়ে যায়। একজন কৃষকের সন্তান সাধারণত কৃষকই হয়, একজন রিকশাচালকের সন্তান বড়জোর রিকশাচালক কিংবা শ্রমিক হতে পারে, কিন্তু সহজেই কোনো উচ্চপর্যায়ের সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে না। কারণ সমাজে বৈষম্য গভীরভাবে প্রোথিত, যেখানে অর্থ, ক্ষমতা এবং সামাজিক মর্যাদা কেবল নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। একদিকে অভিজাত ও ক্ষমতাশালী পরিবারের সন্তানরা জন্মগতভাবেই সুবিধাপ্রাপ্ত হয়—তারা সেরা স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পায়, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে সহজে চাকরি পেয়ে যায়। অন্যদিকে, একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান যদি সেই একই অবস্থানে পৌঁছাতে চায়, তবে তাকে সীমাহীন পরিশ্রম করতে হয়, বহু বাধা অতিক্রম করতে হয়, এবং তবুও সে নিশ্চিতভাবে সফল হবে কিনা তার নিশ্চয়তা থাকে না। এই বৈষম্য শুধুমাত্র শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান।

রাজনীতিতে এই পারিবারিক উত্তরাধিকার আরও সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। শেখ হাসিনার ছেলে জয় সহজেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হতে পারে, তারেক জিয়া কোনো কষ্ট ছাড়াই বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হয়ে যেতে পারে, কারণ তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার বংশীয় ধারাবাহিকতার অংশ। কিন্তু একজন শ্রমজীবী, কৃষক, বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান যদি রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চায়, তবে তাকে অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তবুও সে কখনোই মূল নেতৃত্বের কাতারে পৌঁছাতে পারে না। ক্ষমতা কেবল ক্ষমতাবানদের কাছেই আবর্তিত হয়, সাধারণ মানুষের জন্য সেখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। এক সময় যাদের জন্য রাজনীতি ছিল আদর্শের জায়গা, এখন তা সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতা ও সুবিধাভোগীদের দখলে চলে গেছে। এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই দেখা যায়। সমাজব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে, ক্ষমতার দরজা সবসময় ধনী ও প্রভাবশালীদের জন্য খোলা থাকে, আর খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য তা বন্ধই থেকে যায়। এগুলো আমরা পৃথিবীর নিয়ম হিসেবে মেনে নিই, তবে এগুলো খুবই অনৈতিক এবং পরিবারতন্ত্রের বাস্তনব উদাহরণ। কিন্তু ইসলামেও যদি ইনসাফের ধারনা এরকম থাকে, তাহলে কীভাবে হবে? আসুন দেখি ইসলামে পরিবারতন্ত্র নিয়ে কী বলা আছে [1]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছেদঃ ২০৯১. রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট আত্মীয়দের মর্যাদা এবং ফাতিমা (রাঃ) বিনতে নবী (সাঃ) এর মর্যাদা। নবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতিমা (রাঃ) জান্নাতবাসী মহিলাগণের সরদার
৩৪৪৭। আবদুল্লাহ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব (রহঃ) … আবূ বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারবর্গের প্রতি তোমরা অধিক সম্মান দেখাবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)

শুধু তাই নয়, তার দুইজন নাতী হাসান এবং হোসেইনকেও জান্নাতের যুবকদের সর্দার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেছেন। [2] [3]

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৪৬/ রাসূলুল্লাহ ও তার সাহাবীগণের মর্যাদা
পরিচ্ছেদঃ ৩১. আল-হাসান ইবনু ‘আলী এবং আল-হুসাইন ইবনু ‘আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাযিঃ)-এর মর্যাদা
৩৭৬৮। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল-হাসান ও আল-হুসাইন (রাযিঃ) প্রত্যেকেই জান্নাতী যুবকদের সরদার।
সহীহঃ সহীহাহ (৭৯৬)
সুফইয়ান ইবনু ওয়াকী’-জারীর ও মুহাম্মাদ ইবনু ফুযাইল হতে, তিনি ইয়াযীদ (রাহঃ) হতে এই সনদে একই রকম বর্ণনা করেছেন। আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবনু আবী নুম হলেন আবদুর রহমান ইবনু আবী নুম আল-বাজালী, কুফার অধিবাসী। তার উপনাম আবূল হাকাম।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ)

সুনানে ইবনে মাজাহ
ভূমিকা পর্ব
পরিচ্ছেদঃ ১৪. ‘আলী বিন আবী ত্বলিব (রাঃ)-এর সম্মান
৫/১১৮। ইবনু উমার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হাসান ও হুসায়ন জান্নাতী যুবকদের নেতা এবং তাদের পিতা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে।
তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: সহীহাহ ৯৭৯। উক্ত হাদিসের রাবী মুআল্লা বিন আব্দুর রহমান সম্পর্কে আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, তার হাদিস দুর্বল এবং তার ব্যাপারে হাদিস বানিয়ে বর্ণনার অভিযোগ রয়েছে। ইবনু আদী বলেন, আশা করি তেমন কোন সমস্যা নেই। আবু হাতীম আর-রাযী বলেন, তার হাদিস দুর্বল। ইমাম দারাকুতনী বলেন, তিনি দুর্বল ও মিথ্যুক। উক্ত হাদিস শাহিদ এর ভিত্তিতে সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমর (রাঃ)

অপরদিকে, আবু লাহাব বা আবু জেহেলের জন্ম যদি নবীর ঘরে হতো, নবীর ছেলে হিসেবে, কিংবা ফাতিমার ছেলে হিসেবে, তাহলে তারাও তো জান্নাতের সর্দার হতে পারতো। তাই না? আমি কিংবা আপনি যদি নবীর নাতি হতাম, তাহলে তো মুফতেই জান্নাতে যেতে পারতাম। আল্লাহর নবীর এরকম স্বজনপ্রীতির কারণ কী? সেটি হয়ে থাকলে, হাসিনার ছেলে জয় কিংবা খালেদার ছেলে তারেকের ক্ষমতা পাওয়াকে আমরা স্বজনপ্রীতি বলি কেন? এগুলো তো সেই প্রাচীন আমলের জমিদারী কিংবা রাজা বাদশাহদেরই প্রথা যে, পারিবারিকভাবে কোন যোগ্যতা ছাড়াই তারা জমিদারী পেয়ে যেতো!

এবারে আসুন আরেকটি হাদিস পড়ি এবং বোঝার চেষ্টা করি যে, ইসলামের এই বিষয়গুলো কেমন [4]

স্বজন

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৪৪৭ []
  2. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ৩৭৬৮ []
  3. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিসঃ ১১৮ []
  4. মিশকাতুল মাসাবীহ ( মিশকাত শরীফ), আধুনিক প্রকাশনী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"