ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রাণীরা নাকি কবরে থাকা মৃত ব্যক্তির চিৎকার শুনতে সক্ষম। অথচ, যদি সত্যিই এমন ঘটনা ঘটত, তাহলে আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি সেই শব্দ তরঙ্গ রেকর্ড করতে সক্ষম হতো। বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে এমন উন্নতমানের যন্ত্র ও প্রযুক্তি রয়েছে, যেগুলো অতি ক্ষুদ্র এবং উচ্চমাত্রার শব্দ তরঙ্গও রেকর্ড করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (LIGO) মহাকাশ থেকে আসা ক্ষুদ্রতম গ্র্যাভিটেশনাল তরঙ্গ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারে, যা আলোর গতির চেয়েও তীব্র কম্পন রেকর্ড করতে সক্ষম। এমনকি, আমরা মহাকাশের দূরবর্তী গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আসা মাইক্রোওয়েভ এবং ইনফ্রারেড তরঙ্গ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, মৃত মানুষের চিৎকার বা শব্দ তরঙ্গ যদি আসলেই ঘটত, তাহলে বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা নিশ্চয়ই সেটি রেকর্ড করতে পারতেন এবং তা অন্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে রূপান্তরিত করে শোনার যোগ্য করে তুলতে পারতেন।
তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে, আল্ট্রাসাউন্ড এবং ইনফ্রাসাউন্ড ডিটেক্টর দিয়ে মানব কানে শোনা যায় না এমন কম্পাঙ্কের শব্দও ধরা সম্ভব। এগুলোকে আমাদের কানের স্বাভাবিক শুনতে পারার সীমার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ফিল্টার এবং সিগন্যাল প্রসেসিং ব্যবহার করা হয়। যদি মৃতদের চিৎকার বা কষ্ট সত্যিই ঘটে, তবে তাদের সেই শব্দ কোনো না কোনো তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে প্রকাশিত হতো, যা বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক ডিভাইসের মাধ্যমে শনাক্ত করতে পারতেন। এমনকি, একটি সাধারণ ইনফ্রাসাউন্ড ডিটেক্টর ২০ হার্জ এর নিচের কম্পাঙ্কের শব্দ ধরা সম্ভব, যা আমরা শুনতে পারি না। এই প্রক্রিয়ায়, বিজ্ঞানীরা অনেক সময় পশুদের যোগাযোগের গোপন ভাষা, এমনকি গাছপালার বিক্রিয়া শনাক্ত করতে পেরেছেন। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়—কেন বিজ্ঞানীরা কবরে থাকা মৃত ব্যক্তিদের চিৎকার শনাক্ত করতে পারেননি? এর সহজ উত্তর হলো, এমন কোনো শব্দ তরঙ্গ বা কম্পন প্রকৃতপক্ষে ঘটে না। এই বিশ্বাস শুধুমাত্র কুসংস্কার এবং ধর্মীয় রূপকথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি অন্ধবিশ্বাস।
বিশেষভাবে, কুকুর এবং শিয়াল শ্রবণশক্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত উন্নত। একটি গড়পড়তা কুকুর ৬৫ হার্জ থেকে ৪৫ কিলোহার্জ (৬৫ Hz – ৪৫ kHz) পর্যন্ত কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে সক্ষম, যা মানুষের ২০ Hz থেকে ২০ kHz কম্পাঙ্কের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে, শিয়াল ৪০ Hz থেকে ৬০ kHz পর্যন্ত কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে সক্ষম। বাড়িতে কুকুর পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত করা হয়, বিশেষভাবে কুকুর অনেক দূরে ঘটে যাওয়া বা অনেক অল্প শব্দও শুনতে পায় এই কারণে। এটি প্রমাণ করে যে, কুকুর ও শিয়াল মানব কানে শোনা যায় না এমন উচ্চ ও নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দও শুনতে সক্ষম। এই উন্নত শ্রবণশক্তির জন্যই তারা বিভিন্ন ক্ষীণ শব্দ বা কম্পন শনাক্ত করতে পারে। তবে, এটি মনে রাখতে হবে যে, কুকুর বা শিয়াল যে কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে সক্ষম, তা কোনো আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত প্রমাণ নয়; বরং এটি তাদের শারীরিক শ্রবণ ক্ষমতার কারণেই সম্ভব। তাহলে, ইসলামী বিশ্বাস মোতাবেক, কুকুর যেহেতু মৃত মানুষদের আর্তনাদ শুনতে সক্ষম, তাই মৃত মানুষ নিশ্চয়ই ঐ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শব্দই উৎপাদন করে। কিন্তু সেই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শব্দ তো যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই রেকর্ড করে আমাদের শোনার উপযোগী করে তোলা সম্ভব।
তদুপরি, বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা থেকে জানা যায়, মৃতদেহের সাথে কোনো শব্দ কম্পন বা কণ্ঠস্বর উৎপন্ন হয় না। মানুষের মৃত্যুর পর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং দেহের কোনো কোষ আর শব্দ উৎপন্ন করতে পারে না। শব্দ উৎপন্ন হওয়ার জন্য একটি উৎস (যেমন—কণ্ঠ, বাতাসের চাপ, মস্তিষ্কের স্নায়বিক সংকেত) প্রয়োজন, যা মৃতদেহে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাই, এই ধরনের বিশ্বাস আসলে কেবল প্রাচীনকালের মানুষের উদ্ভট কল্পনা এবং অন্ধবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। ধর্মীয় বিশ্বাসের আড়ালে প্রচারিত এই ধারণাগুলো বিজ্ঞানের চোখে একেবারেই ভিত্তিহীন, এবং এসব অন্ধবিশ্বাস মানুষের যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে [1]
সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫/ সুন্নাহ
পরিচ্ছেদঃ ২৭. কবরের জিজ্ঞাসাবাদ এবং শাস্তি প্রসঙ্গে
৪৭৫২। আব্দুল ওয়াহাব (রাঃ) সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যখন কোনো লোককে কবরে রেখে তার সঙ্গীরা এতটুকু দূরে চলে যায় যেখান থেকে সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায় তখন তার নিকট দু’ জন ফিরিশতা এসে বলে … অতঃপর প্রথমোক্ত হাদীসের অনুরূপ। তবে এতে কাফিরেরর সঙ্গে মুনাফিকের কথা রয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ আর কাফির ও মুনাফিককে প্রশ্ন করা হবে। তিনি বলবেন, মানব ও জীন ছাড়া যারা কবরের নিকট থাকে সকলেই চিৎকার শুনতে পায়।[1]
সহীহ।
[1]. এর পূর্বেরটি দেখুন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আসুন মুফতি ইব্রাহিমের দুইটি ওয়াজ শুনে নিই,
তথ্যসূত্র
- সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৭৫২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"