ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা বলে দাবী করা হয়, যা নাকি মানবজীবনের সকল দিক—আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং দৈনন্দিন কার্যাবলি—কভার করে। তবে ইসলামের অনেক বিধানই আধুনিক সভ্য সমাজের চোখে অস্বস্তিকর বা অসভ্য কাজ বলে মনে হতে পারে। এর মধ্যে একটি বিষয় হলো, খাদ্য গ্রহণের পর আঙ্গুল ও হাত চাটানো এবং অন্যদের দিয়ে তা চাটানোর বিধান, যা সহীহ মুসলিমের একটি হাদিস-এ উল্লেখ করা হয়েছে। এই হাদিসটি আজকের সভ্য সমাজে কেন ‘অভদ্র’ বা ‘অস্বস্তিকর’ হিসেবে দেখা যেতে পারে, সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
হাদিসের বর্ণনা:
সহীহ মুসলিম-এর হাদিসে উল্লেখ আছে যে, “খানাপিনার পর আঙ্গুল এবং বর্তন চেটে খাওয়া এবং পড়া খাদ্যে যে ধুলাবালু লেগেছে তা মুছে খাওয়া মুস্তাহাব”। হাদিসে বলা হয়েছে, ব্যক্তির হাতে বা খাবারের প্লেটে কোনো অবশিষ্ট অংশ থাকলে, তা চেটে খাওয়া বা অন্যদের দিয়ে চাটানো সুন্নত। তবে, হাত মুছে ফেলা মাকরূহ (অপছন্দনীয়) কারণ এতে খাবারের বরকত চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৭/ পানীয় দ্রব্য
পরিচ্ছেদঃ ১৭. আঙ্গুল ও বর্তন চেটে খাওয়া এবং পড়ে যাওয়া খাদ্যে যে ধুলাবালু লেগেছে তা মুছে খাওয়া মুস্তাহাব। আর চেটে খাওয়ার পূর্বে হাত মুছে ফেলা মাকরূহ। কারণ ঐ অবশিষ্ট অংশের মধ্যে খাদ্যের বরকত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তিন আঙ্গুলে খাওয়া সুন্নত হওয়া প্রসঙ্গে
৫১৩০। ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … সুফিয়ান (রহঃ) থেকে উল্লেখিত সনদে অনুরূপ রিওয়ায়াত করেছেন। তাঁদের উভয়ের হাদীসে আছে, সে যেন তার হাত রুমাল দ্বারা মুছে না ফেলে যতক্ষণ না সে নিজে তা চেটে খায় বা অন্যকে দিয়ে চাটায়। এরপরে অবশিষ্ট অংশ বর্ননা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সুফিয়ান (রহঃ)
সভ্য সমাজে বিশ্লেষণ:
এখন, এই বিধান আধুনিক সভ্য সমাজে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমরা যখন “সভ্য” শব্দটি ব্যবহার করি, তখন তা সাধারণত এমন একটি সমাজের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয় যেখানে শিষ্টাচার, সামাজিক নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা একটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
- সামাজিক শিষ্টাচার এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা: আধুনিক সভ্য সমাজে, খাবারের পর হাত এবং আঙ্গুল চাটা এক ধরনের অপরিষ্কার আচরণ হিসেবে দেখা হয়। এটি ব্যক্তি বা দলের মধ্যে শিষ্টাচারের অভাবকে প্রতিফলিত করতে পারে। খাবারের পর হাত মুছে না ফেলা বা অন্যদের দিয়ে হাত চাটানো সাধারণত অস্বস্তিকর এবং অস্বাস্থ্যকর আচরণ বলেই পুরো সভ্য সমাজে গণ্য হবে। এটি সাদাসিধে শিষ্টাচারিক শর্তগুলো অস্বীকার করে, যেখানে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
- স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ: আধুনিক সমাজের অনেক মানুষ স্বাস্থ্যগত দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত সতর্ক। তারা পরিচ্ছন্নতার উপর গুরুত্ব দেয়, বিশেষত খাদ্য গ্রহণের পরে। হাত বা আঙ্গুল চাটার ক্ষেত্রে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে, যা সভ্য সমাজে অস্বাস্থ্যকর এবং অসভ্য কাজ হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই, এই বিধানকে অনেকেই ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করতে পারেন।
- আধুনিক সংস্কৃতি ও মানসিকতা: সভ্য সমাজে, যেখানে বিশ্বব্যাপী সামাজিক নীতি ও আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে, সেখানে এমন বিধানগুলো অনেকের কাছে পুরোনো, গ্রাম্য বা অসভ্য কাজ মনে হতে পারে। কল্পনা করুন তো, একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ডিনারের টেবিলে রাষ্ট্রনায়কগণ একে অন্যকে দিয়ে তাদের হাত চাটাচ্ছেন, বিষয়টি কেমন দেখাবে?
উপসংহার:
এই হাদিসের আদর্শ, যা খানাপিনার পর অন্যকে দিয়ে নিজের হাত বা আঙ্গুল চাটানোর পক্ষে উপদেশ দেয়, আধুনিক সভ্য সমাজে এক ধরনের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অস্বস্তি তৈরি করে। যদিও এটি ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক এবং সুন্নতি অনুশীলন, আধুনিক সমাজে এটি অস্বাস্থ্যকর এবং অপছন্দনীয় মনে হতে পারে। এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে, কোনও ধর্মীয় বিধান বা আচার সমাজের যুগের সাথে পরিবর্তিত মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।